শনিবার ৬ জুলাই, ২০২৪


সরলা দেবী।

রবীন্দ্রনাথের আশি বছর পূর্তি উপলক্ষে টেলিগ্রামে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। গান্ধীজি লিখেছিলেন, ‘আপনার জীবনের আশি বছর পূর্তি যথেষ্ট নয়—শতবর্ষ জীবন প্রার্থনা করি।’

প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, ‘আশি বছর বেঁচে থাকাটাই বেয়াদবি, একশো বছর তো অসহনীয়।’ বার্ধক্যে, ন্যুব্জদেহে রবীন্দ্রনাথের গলায় এ-কথা শোনা গেলেও তিনি তো জীবনপূজারি, জন্মদিন ভিন্নতর মাধুর্য নিয়ে তাঁর কাছে ফিরে-ফিরে এসেছে। বাইরের বৃহত্তর অঙ্গনে নয়, ঘরের মানুষজনের আন্তরিক আয়োজনেই কবির জন্মদিন প্রথম পালিত হয়েছিল। জন্মদিন ঘিরে ‘আত্মীয়দের সেই আনন্দ-উৎসবের মধ্যে মনুষ্যজন্মের একটি বিশেষ মূল্য’ অনুভব করেছিলেন কবি। জীবনসায়াহ্নে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, শিলাইদহের পদ্মার মতো তাঁর জন্মদিন-উৎসবও গতি পরিবর্তন করেছে। পারিবারিক জীবনের সীমা ছাড়িয়ে বহু দূরে সরে এসেছে। কবি আচ্ছন্ন হয়েছেন অতীতকাতরতায়, ‘তখন আমার তরুণ বয়স। প্রভাত হতে না হতে প্রিয়জনেরা আমাকে কত আনন্দে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, “আজ তোমার জন্মদিন”।’
পরিবারের প্রিয়-সান্নিধ্যে জন্মদিন উদযাপন বাল্য— কৈশোরে বা তরুণবয়সে হয়নি, হয়েছে যৌবনে, তাও সমবেত প্রচেষ্টায় নয়, হয়েছে সরলা দেবীর একক আগ্রহে। কবি সেবার ছাব্বিশ পেরিয়ে সাতাশে পা দিয়েছিলেন। আগের বছর বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা এক চিঠিতে নিজের জন্মদিন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সচেতনতা লক্ষ করা যায়। স্মরণ করেছেন, ‘আজ আমার জন্মদিন—পঁচিশে বৈশাখ— পঁচিশ বৎসর পূর্বে এই পঁচিশে বৈশাখে আমি ধরণীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম।’

প্রিয়ংবদা দেবী।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম জন্মদিন পালন অবশ্য জোড়াসাঁকোয় হয়নি, হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনীর পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে। ‘জীবনের ঝরাপাতা’ বইতে সরলা দেবী লিখেছেন, ‘রবিমামার প্রথম জন্মদিন উৎসব আমি করাই।’

জন্মদিনের সঙ্গে উপহার প্রদান বোধহয় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সরলা দিয়েছিলেন ধুতি- চাদর। ধুতি-চাদর কবির পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাঁকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। বাজার থেকে কেনা ধুতি-চাদরের পাশাপাশি ছিল এক মহার্ঘ উপহার। নিজের হাতে তিনি গেঁথেছিলেন বকুলফুলের মালা। নিজের হাতে গাঁথা সে মালাটিও শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে রেখেছিলেন কবি পায়ের কাছে। সরলা দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, সেই শুরু। এরপর থেকেই ‘রবির জন্মদিন’কে ঘিরে সাড়া পড়ে যেত। প্রথম দিকে এই ‘সাড়া’ অবশ্য পরিবারস্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরিজনরা পরমানন্দে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিবস পালন করত। ক্রমেই তা ছড়িয়ে পড়ে সমাজের সর্বস্তরে। দ্রুত উৎসবের মেজাজ নেয়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৫: ভূপেনবাবুর ভূত

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৬: সুন্দরবনের লৌকিক চিকিৎসায় ম্যানগ্রোভ—হরগোজা ও কেয়া

‘রবিমামা’-র জন্মদিনে শুধু সরলা নন, এই আনন্দে তাঁর অগ্ৰজ জ্যোৎস্নানাথও যোগ দিয়েছিলেন। জন্মদিনে কবিকে তিনি উপহার দিয়েছিলেন, ‘The Poems of Heine’। কবিতার বইটি কবির মনে ধরেছিল। বইয়ের নামপত্রে ‘জন্মদিনের উপহার’, ‘জ্যোৎস্নার কাজ হইতে’—এই কথাটি লিখে রেখেছিলেন কবি।

রবীন্দ্রনাথের প্রিয়জনরা অন্তরের তাগিদে জন্মদিন পালনে যেমন এগিয়ে এসেছেন, তেমনই তাঁর হাতে উপহারও তুলে দিয়েছেন। সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়, কবির ভাগিনেয়, যিনি স্কুলে যাওয়ার জন্য বালক রবিকে কাঁদতে দেখে মন্তব্য করেছিলেন, স্কুলে না-যাওয়ার জন্যও একদিন কাঁদতে হবে তাঁকে। সমবয়েসিদের স্কুলে যেতে দেখে সেদিন রবীন্দ্রনাথ কেঁদেছিলেন সত্য, পরে অবশ্য সত্য-মন্তব্যই অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল। সত্যপ্রসাদ রবীন্দ্রনাথের থেকে বয়সে কিছুটা বড় হলেও পরস্পরের মধ্যে ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। রবীন্দ্র-গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রেও সত্যপ্রসাদ সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে তিনি দিয়েছিলেন ঘড়ি। সে ঘড়ির দাম ছিল চার টাকা।

সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রিয়ংবদা দেবীর মধুর সম্পর্ক ছিল। এমনও শোনা যায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বাধা না দিলে কবির সঙ্গে হয়তো-বা তাঁর বিবাহ হত। পত্নী-বিয়োগের পরে রবীন্দ্রনাথের পুনর্বিবাহের সম্ভাবনা তৈরি হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। প্রিয়ংবদার সঙ্গে কবির এই মাধুর্যময় সম্পর্ক কখনো বিঘ্নিত হয়নি। কবি একবার প্রিয়ংবদার কবিতা নিজের ভেবে ছেপেও ফেলেছিলেন। ঘটনাটি যথেষ্ট বিব্রত হওয়ার মতো মনে হলেও এটি অন্তত স্পষ্ট হয়, প্রিয়ংবদা দেবী ভালো কবিতা লিখতেন। তাঁর কবিতা অন্তর থেকে রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন।

কবির বন্ধু আশুতোষ চৌধুরীর ভাগিনেয়ী প্রিয়ংবদা জন্মদিনে কবিকে একটি নোটবই উপহার দিয়েছিলেন। নোটবইতে নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন, ‘রবিবাবুকে জন্মদিনের উপহার। প্রিয়। ২৫ বৈশাখ ১২৯৮।’
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৮: ভারতভুক্তির পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

রবীন্দ্রনাথ সেবার পদার্পণ করেন ৩১ বছরে। কবি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রদের মধ্যে সুরেন্দ্রনাথকে খুব ভালোবাসতেন। ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকেও কম ভালোবাসতেন না তিনি। ভাই-বোন দুটি মিলে কবিকে জন্মদিনে দিয়েছিলেন হারবার্ট স্পেনসারের ন-টি বই। বইয়ের প্রথম পাতায় লিখে দিয়েছিলেন, ‘রবিকার জন্মদিনে উপহার।’ একবার তাঁরা ‘রবিকা’র জন্মদিনে দিয়েছিলেন বেশ বড়সড় দু-শো আশি পৃষ্ঠার একটি সুদৃশ্য খাতা। এই খাতায় ছিল সাগরপারের সাহেব-কবিদের কবিতার প্রতিলিপি। অধিকাংশ প্রতিলিপি ইন্দিরা নিজের হাতে করেছিলেন। ইন্দিরা দেবীর লেখায় আছে, ‘ছেলেবেলায় আমি আর সুরেন রবিকাকার একটি বিশেষ জন্মদিনে একটি খাতায় আমাদের প্রিয় ইংরেজ কবিদের বিখ্যাত কবিতাগুলি নকল করে তাঁকে উপহার দিয়েছিলাম।’ তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, পৃষ্ঠাগুলি চিত্রিত করেছিলেন সুরেন্দ্রনাথ।

ইন্দিরা দেবী ও সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রাণুর প্রতি ছিল রবীন্দ্রনাথের স্নেহময় ভালোবাসা। ছোট্ট রাণুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রে যোগাযোগ। দেখা হয়েছে অনেক পরে। প্রথম দেখা হওয়ার দিনটি ছিল বড়োই বেদনাবহ। কন্যা মাধুরীলতাকে হারিয়ে শোকে বিধ্বস্ত রবীন্দ্রনাথ রাণুর কাছে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, কন্যা হারানোর বেদনা হয়তো-বা রাণুকে কাছে পেয়ে জুড়োবে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৩: শ্রীমার বড় ভাইজিরা—নালু ও মাকু

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬০: আধুনিক ভারতীয় রাজনীতির চালচিত্রে কি দশরথ ও কৈকেয়ীর ছায়া?

জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথকে রাণু একবার উপহার দিয়েছিল একটি রুমাল। ৭ মে ১৯১৯ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখেছিলেন কৌতুকময় একটি পত্র। একটু উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে, ‘ইংরেজি মতে আজ আমার জন্মদিনের পরের দিন, বাংলা মতে আগের দিন। আমার আসল জন্মদিনে ইংরেজি তারিখ ছিল ৬ মে, বাংলা তারিখ ছিল ২৫শে বৈশাখ। তখনকার পঞ্জিকায় দুটিতে বেশ ভাবসাব করে একত্রেই থাকত। কিন্তু তার পরে আজকাল দেখি সেই ইংরেজি তারিখে বাংলা তারিখে ঝগড়া বেধে গেছে, তাদের মুখ-দেখাদেখি বন্ধ। এটা কি ভালো হচ্চে? যাই হোক তোমার রুমালটি বুদ্ধিপূর্বক সেই দুটো দিনের মাঝখানে এসে সেই ঝগড়াটে তারিখ দুটোকে সখ্যবন্ধনে বাঁধবার চেষ্টা করচে। সে চেষ্টা সফল হোক আর না হোক রুমালটি আমার পকেটের ভিতরে দিব্যি গুছিয়ে বসেচে। জন্মদিনের সারাদিন এই রুমালটি আমার পকেটে রাখতে বলেচ—কিন্তু দেখ, তার পকেট-বাসের মেয়াদ অনেক বেড়ে গেল।’

রবীন্দ্রনাথ ও রাণু।

পরিবারের সীমানা পেরিয়ে বৃহত্তর ক্ষেত্রে কবির জন্মদিন পালনকালে তাঁর হাতে ভক্তজন রকমারি উপহারসামগ্রী তুলে দিয়েছেন। সে আরেক প্রসঙ্গ। জন্মদিনে পরিবারের মানুষজনের উপহার কবি আদরে সাদরে গ্রহণ করেছেন। আবার নিজেও নিকটজনদের হাতে উপহার তুলে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জন্মদিনের প্রাক্কালে প্রকাশিতব্য ‘ক্ষণিকা’ কাব্যটি দিতে চেয়েছিলেন সবাইকে। সেই ইচ্ছার কথা জানিয়ে যিনি মুদ্রণ-দায়িত্বে ছিলেন, সেই প্রেমতোষ বসুকে লিখেছিলেন, ‘২৫ বৈশাখ আমার জন্মদিন— ইচ্ছা ছিল সেই নাগাদ বইটি প্রকাশ করিয়া আত্মীয়-স্বজনকে বিতরণ করি কিন্তু ততটা আশা করিতে সাহস হয় না।’ মুদ্রক প্রেমতোষের কাজের ধরনধারণ দেখে কবির এমন মনে হয়েছিল। তাঁর আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়। ‘ক্ষণিকা’ প্রকাশিত হয় জন্মদিনের ক’দিন পর। রবীন্দ্রনাথ নিকটজনের হাতে জন্মদিনে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর ‘কল্পনা’ কাব্যগ্রন্থটি।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content