বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ।

ছোটদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল অফুরান ভালোবাসা। সে ভালোবাসায় কোনও খাদ ছিল না। অন্তর থেকে উৎসারিত। আশ্রম-পড়ুয়াদের জন্য কবির ভাবনা-দুর্ভাবনার অন্ত ছিল না। মধ্যরাতে হয়তো বৃষ্টি পড়ছে, বৃষ্টির শব্দে কবির ঘুম ভেঙে গিয়েছে, সবার আগে মনে পড়েছে ছাত্রাবাসে থাকা ছাত্রদের কথা। আহা, বেচারা! ছেলেগুলো নিশ্চিত ঘরের চাল-গলে পড়া বৃষ্টির জলে ভিজছে। এমনটি মনে হওয়ার পরই বৃষ্টির জলে ভিজে যাওয়া ছাত্রদের সামাল দিতে কবি নিজে ভিজতে ভিজতে ছুটেছেন ছাত্রাবাসে, সে বর্ণনা আছে ঠাকুরবাড়ির বধূমাতা হেমলতা দেবীর লেখায়।
আশ্রম-বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল। তাঁকে কবি জোড়াসাঁকো থেকে চিঠি লিখে নির্দেশ দিতেন, ছেলেদের কীভাবে যত্ন নিতে হবে। কখন স্নান করাবেন, তেল মাখাবেন, সে নির্দেশও থাকত চিঠিতে। কবি জোড়াসাঁকোয় থাকলে মন পড়ে থাকত ভালোবাসার শান্তিনিকেতনে। পড়ুয়াদের নিয়ে কত রকমের ভাবনা। সেসব ভাবনার কথা আশ্রম-অধ্যক্ষকে, আশ্রম-শিক্ষকদের কাউকে কাউকে জানাতেনও।

শিক্ষক যখন কবি।

রবীন্দ্রনাথ আশ্রম-বিদ্যালয় কড়া-হাতে চালাতেন। প্রশাসনিক কাজেও তিনি সুদক্ষ ছিলেন। বিদ্যালয়-পড়ুয়ারা সব সময় তাঁর কাছে প্রাধান্য পেত। তাদের স্বার্থ দেখতন সর্বদা। তাদের জন্য কতখানি ভালোবাসা ছিল, দৈনন্দিন নানা ঘটনায় বারবার স্পষ্ট হয়ে উঠত। ছাত্রদের কবি চোখে চোখে রাখতেন। কোন ছাত্রটি অসুখে পড়েছে, ওজন কমেছে, সব থাকত তাঁর নখদর্পণে। কোনও ছাত্র হয়তো পড়া বুঝতে পারছে না, পিছিয়ে পড়ছে — এমন হলে কবি নিজে তাকে পড়া বোঝাতেন। ছাত্রদের অসুখ-বিসুখ নিয়েও রবীন্দ্রনাথের উদ্বিগ্নতা গোপন থাকত না। হোমিওপ্যাথিক বই পড়ে, রোগের লক্ষণ মিলিয়ে ওষুধ দিতেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের প্রকৃত ম্যানগ্রোভ ও ম্যানগ্রোভ-সহযোগীরা

ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালের লেখায় আছে, ‘সকল শিক্ষকের সহিতই তাঁহার ব্যবহার বড় সদয় ছিল। কিন্তু ছাত্রদের ক্ষতি হইতেছে বুঝিতে পারিলে তিনি তাঁহার প্রিয়পাত্র অধ্যাপকদিগকেও কার্য হইতে সরাইয়া দিতে বিলম্ব করিতেন না।’ ভূপেন্দ্রনাথ এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা জানিয়েছেন। ঘটনাটি এরকম, পুজোর ছুটির পর আবাসিক ছাত্ররা ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছেন শিক্ষক-অধ্যাপকরাও। যেমন প্রতি বছর ঘটে, সেবারও তেমনই ঘটেছিল। তেমন কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। পুজোর ছুটিতে আশ্রম-শিক্ষক জগদানন্দ রায়ও বাড়ি গিয়েছিলেন। হঠাৎ বিপত্তি, ফিরে আসা বিলম্বিত হয় তাঁর।

হেমলতা দেবী।

জগদানন্দ শিলাইদহের জমিদারিতে কাজ করতেন। রবীন্দ্রনাথই সে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পরে কবিই তাঁকে আশ্রম-বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন। পুজোর ছুটির পর সবাই আশ্রমে ফিরে এলেও জগদানন্দ আসেননি। তাঁর তখন নানা বিপর্যয়, সমস্যা। পুত্র-কন্যারা অসুস্থ। স্ত্রী প্রয়াতা হয়েছেন। সমস্যায় সমস্যায় জেরবার জগদানন্দ যথাসময়ে ফিরে আসতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ এসব জানতেন না। দিনের পর দিন নিরুপায় হয়েই অনুপস্থিত থেকেছেন জগদানন্দ। ছাত্রদের ক্ষতি হচ্ছে — একথা ভেবে কবি উদ্বিগ্ন হয়েছেন, উত্তেজিত হয়েছেন। উত্তেজিত কবি ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালকে জগদানন্দের উদ্দেশে লেখা একটি চিঠি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, চিঠিটি জগদানন্দ রায়ের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৭: রাজা বীরবিক্রম মৃত্যুর কিছু দিন আগেই ত্রিপুরার ভারতভুক্তির সিদ্ধান্ত নেন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা

ভূপেন্দ্রনাথ সে চিঠি জগদানন্দকে না পাঠিয়ে নিজেই একটি চিঠি লিখেছিলেন। জানিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের কথা ভেবে তাঁর এই অনুপস্থিতিকে মেনে নিতে পারছেন না। সে চিঠি পেয়ে দ্রুত ফিরে এসেছেন জগদানন্দ। আসার পর রবীন্দ্রনাথের চিঠিটি ভূপেন্দ্রনাথকে দেখিয়েছিলেন তাঁকে। স্বভাবতই বিচলিত হয়েছিলেন তিনি। দুশ্চিন্তা নিয়েই বিদ্যালয়ের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে না দেখে ক্ষোভ জানালেও দেখার পর কিছুই বলেননি। জগদানন্দ রায় ফিরে আসায়, কাজে যোগ দেওয়ায়, ছাত্রদের কথা ভেবে বরং স্বস্তিবোধ করেছিলেন।

ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল।

আশ্রম-পড়ুয়াদের ঠিকমতো পড়াশোনা হচ্ছে তো, তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও ভেবেছেন। ছাত্রদের কোনওভাবে যেন ক্ষতি না হয়, সেবিষয়ে সবসময় সতর্ক থাকতেন কবি। একবার ভূপেন্দ্রনাথ বসন্ত রোগে আক্রান্ত তাঁর এক বন্ধুর শুশ্রূষা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাঁচাতেও পারেননি। রবীন্দ্রনাথ তা জানার পর ভূপেন্দ্রনাথকে আশ্রমে কিছুদিন আসতে বারণ করেছিলেন ছাত্ররা যদি আক্রান্ত হয় এই ভেবে। ভূপেন্দ্রনাথ হয়তো জীবাণু বহন করছেন, এ সব সাতপাঁচ ভাবনা কবিকে পীড়িত করেছিল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪২: শ্রীমার ভাইপো খুদি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৯: মহাভারতের বিচিত্র কাহিনিগুলিতে আছে মৃত্যুজয়ের অভয়বাণী

কবির কথামতো ভূপেন্দ্রনাথ বাড়িতেই ছিলেন। দিন পনেরো পর একদিন কাউকে কিছু না বলে ভোরের দিকে আশ্রমে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁর গলা শুনে হই হই করে দেখা করতে এসেছিল ছাত্ররা। তাদের কলকাকলি শুনে ভূপেন্দ্রনাথ তৎক্ষণাৎ আত্মগোপন করেছিলেন। কারও সঙ্গেই দেখা করেননি। খানিক আগেই প্রিয় শিক্ষকের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, অথচ পরমুহূর্তে তাঁর সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। ছেলেরা তো আতঙ্কিত। কেউ কেউ অন্যরকম প্রচারও শুরু করে দিয়েছিল। রটে যায়, ভূপেন্দ্রনাথের অসুখ করেছিল। নিশ্চিত তিনি আর জীবিত নেই। রবীন্দ্রনাথেরও কানে গেল সে কথা। কবিও বিচলিত হলেন। সন্ধের দিকে ভূপেন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা। কবি প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে হেসে বলছিলেন, ‘কি মশায়, আপনি ভূপেনবাবু তো, না ভূপেনবাবুর ভূত, ঠিক করে বলুন। আমরা তো আপনাকে খরচের খাতায় লিখে ফেলেছি।’

জগদানন্দ রায়।

ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালকে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত স্নেহ করতেন। একবার তিনি খুব অসুস্থ হয়ে বর্ধমানের বাড়িতে ছিলেন। দিনে দিনে অসুস্থতা বাড়তে থাকে। ডাক্তার তো জবাব দিয়েই দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বাঁচার আর আশা নেই। একথা আশ্রমের আর এক শিক্ষক বিধুশেখর শাস্ত্রীর কাছে জেনে রবীন্দ্রনাথ ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। কীভাবে রোগীর পরিচর্যা করতে হবে, সে বিষয়ে তাঁর মাকে অবগত করে চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা দিয়েছিলেন। ফেরার সময় ভূপেন্দ্র-জননীকে বলেছিলেন, অর্থের জন্য যেন চিকিৎসার ত্রুটি না হয়। ‘অর্থের চিন্তা করতে হবে না’, এই বলে কবি আশ্বস্ত করেছিলেন। টাকার প্রয়োজন হলে সে ব্যবস্থা তিনি করবেন। নির্দ্বিধায় যেন জানানো হয় তাঁকে। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ এমনই ছিলেন, স্নেহকাতর মানুষ। সে স্নেহের স্পর্শ যাঁরা পেয়েছেন, সত্যিই তাঁরা ধন্য হয়েছেন।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content