বুধবার ৩ জুলাই, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ।

তাঁর একটিই বই। সে বইয়ের নাম ‘অব্যক্ত’। বইটি প্রকাশের পর পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। বইয়ের সঙ্গে চিঠিও ছিল। চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আজ জোনাকির আলো রবির প্রখর আলোর নিকট পাঠাইলাম।’ হোক না বিজ্ঞানের জগতে ঘোরাফেরা, সাহিত্যেও তিনি সাবলীল। সাহিত্যে কতখানি স্বচ্ছন্দ, সে সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট ধারণা ছিল। ‘অব্যক্ত’-এর রচনাকার জগদীশচন্দ্র সম্পর্কে কবি লিখেছিলেন, ‘বিজ্ঞানের বাণীকেই তুমি তোমার সুয়োরাণী করিয়াছ, তবু সাহিত্যসরস্বতী সে পদের দাবী করিতে পারিত— কেবল তোমার অনবধানেই সে অনাদৃত হইয়া আছে।’

আচার্য জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞানপ্রতিভার কথা সর্বজনবিদিত, দিগন্তবিস্তৃত। তাঁর সাহিত্যপ্রতিভা সেভাবে আলোকিত হয়নি। তিনি যে বইটি রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়েছিলেন, সেই ‘অব্যক্ত’-র পাতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকা সাহিত্যনিদর্শন, তাঁর লেখা গল্প-প্রবন্ধ এত বছর পরেও আমাদের অভিভূত করে। অধিকাংশই ছাপা হয়েছিল শিবনাথ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘মুকুল’ পত্রিকায়। জগদীশচন্দ্র ভগিনী লাবণ্যপ্রভা ও ছোটদের প্রিয় লেখক যোগীন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন ‘মুকুল’-এর সহযোগী সম্পাদক। লাবণ্যপ্রভা তাঁর অগ্রজকে দিয়ে ছোটদের জন্য এসব বিজ্ঞান-রচনা লিখিয়ে নিয়েছিলেন।
আচার্য জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান-রচনা শুধু ‘মুকুল’-এ নয়, প্রকাশিত হয়েছে সমসাময়িক অন্যান্য পত্রিকাতেও। বিশেষত ‘দাসী’, ‘প্রবাসী’, ‘সঞ্জীবনী’ ‘ভারতবর্ষ’ ও ‘সাহিত্য’ পত্রিকায়। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায়, বিলেত থেকে ফেরার পর বাংলা ভাষায় লেখা আচার্য জগদীশচন্দ্রের প্রথম প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায়। গল্পও লিখেছেন তিনি, সংখ্যায় অবশ্য যৎসামান্য, দুইয়ের অধিক নয়। ‘পলাতক তুফান’ ও ‘অগ্নিপরীক্ষা’।

বিজ্ঞানে নিবেদিতপ্রাণ, দিনের অনেকখানিই বিজ্ঞানচর্চার জন্য ব্যয় করতেন আচার্য জগদীশচন্দ্র। এই বিজ্ঞান-ব্যস্ততা পরও সাহিত্যের জন্য তাঁর মনের কোণে আকূলতা রয়ে যেত। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আচার্য জগদীশচন্দ্রের যে অমলিন বন্ধুত্ব, যে নিখাদ সম্পর্ক, তা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সাহিত্যের প্রতি অন্তর-উৎসারিত আগ্রহ-ভালোবাসাও প্রভাব বিস্তার করেছিল।

এই সখ্যকে ঘিরে কত স্মৃতি। সময়ের আঁচড় পড়েনি সেই স্মৃতির গায়ে। যেমন ছিল, রয়েছে তেমনই। আগের মতোই ঝলমলে উজ্জ্বল। রবীন্দ্রনাথ ফিরে গিয়েছেন পুরানো সেই দিনের কথায়, স্মৃতি রোমন্থন করে লিখেছেন, ‘তখন অল্প বয়স ছিল। সামনের জীবন ভোরবেলাকার মেঘের মত, অস্পষ্ট কিন্তু নানা রঙে রঙিন।’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৩: বিপর্যয়ের দিনে বন্ধু রবীন্দ্রনাথ

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের বাঘের ভবিতব্য

প্রথম জীবনে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বের এই বন্ধন কখনো শিথিল হয়নি, চিড় ধরেনি। অমলিন-অটুট রয়ে গিয়েছে। আচার্য জগদীশচন্দ্রের লেখায় আছে, ‘আমরা উভয়েই অপ্রসিদ্ধ ছিলাম, তখন আমার চিরবন্ধু রবীন্দ্রনাথ আমার সঙ্গে ছিলেন। সেইসব সংশয়ের দিনেও তাঁহার বিশ্বাস কোনওদিন টলে নাই।’ দূরদর্শিতা রবীন্দ্রনাথের নিত্যসঙ্গী ছিল। প্রতিটি পদক্ষেপেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অনেকের ভিড়ে জগদীশচন্দ্র যে স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল, তা রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়িয়ে যায়নি। নিজেই জানিয়েছেন ‘আমার বন্ধুর মধ্যে আলো দেখেছিলুম।’

সেই আলো দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়ুক, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বন্ধু রহো রহো পাশে, জীবনভর সুখে দুঃখে, আনন্দে আবেগে তিনি জগদীশচন্দ্রের পাশেই থেকেছেন। রবীন্দ্রনাথের তৎপরতা ছাড়া জগদীশচন্দ্রের গবেষণাকর্ম সমাপ্ত হত কিনা, উচ্চতার শিখরে পৌঁছাতে পারতেন কিনা, সেসব নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

আচার্য জগদীশচন্দ্র।

একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। রাজা বীরচন্দ্রের কাল থেকে ত্রিপুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বড় সৌহার্দ্যময় সম্পর্ক। ত্রিপুরারাজের আর্থিক আনুকূল্য না পেলে জগদীশচন্দ্র হয়তো যথাসময়ে গবেষণাকর্ম শেষ করতে পারতেন না। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধ ত্রিপুরারাজ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সাহায্যের হাত, মিলেছিল ঔদার্যের পরিচয়। যুবরাজ বীরেন্দ্রকিশোরের তখন বিবাহের আয়োজন চলেছে। রাজকোষে অর্থের বাড়-বাড়ন্ত। এমন দিনেও রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে ত্রিপুরারাজ পুত্রের বিবাহ-খরচ কাটছাঁট করে মহত্তর কর্মযজ্ঞে শামিল হয়েছেন। জগদীশচন্দ্রের গবেষণা ত্বরান্বিত করার জন্য দিয়েছেন আর্থিক সাহায্য। যে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছিলেন মহারাজ, সত্যি কি তার তুলনা হয়! ত্রিপুরারাজ রাধাকিশোরের মনে হয়েছিল, ‘বর্তমানে আমার ভাবী বধূমাতার দু’ একপদ অলঙ্কর নাই-বা হইল, তৎপরিবর্তে জগদীশবাবু সাগরপার হইতে যে অলঙ্কারে ভারতমাতাকে ভূষিত করিবেন, তাহার তুলনা কোথায়?’
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৪: উদয়পুর অভিযানে মগ সৈন্যরা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের চূড়া ভেঙে দিয়েছিল

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৯: সুরের আকাশে ঘটালে তুমি স্বপ্নের ‘শাপমোচন’

বিজ্ঞানী-বন্ধুর প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসাময় আনুগত্য ছিল, কবিকে ঘিরে বিস্ময় ও মুগ্ধতা ছিল জগদীশচন্দ্রের। রবীন্দ্রনাথ তখনও ‘রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে ওঠেননি। সাহবসুবো-মহলে তাঁকে পরিচিত করে তোলানোর জন্য জগদীশচন্দ্রই প্রথম তৎপর হয়েছিলেন। ‘চিরবন্ধু’ রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘তুমি পল্লীগ্রামে লুক্কায়িত থাকিলে আমি তাহা হইতে দিব না। … তোমার গল্পগুলি আমি এদেশে প্রকাশ করিব।’ ক’দিন পরে আবার আসে জগদীশচন্দ্রের চিঠি। সাগরপার থেকে বন্ধুকে লেখেন, ‘তোমাকে যশোমণ্ডিত দেখিতে চাই। তুমি পল্লীগ্রামে আর থাকিতে পারিবে না। তোমার লেখা তরজমা করিয়া এদেশীয় বন্ধুদিগকে শুনাইয়া থাকি, তাহারা অশ্রু সংবরণ করিতে পারিবে না।’ রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি গল্প সত্যিই অনুবাদ করেছিলেন জগদীশচন্দ্র।

জগদীশচন্দ্রকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি।

বন্ধুর আমন্ত্রণে জগদীশচন্দ্র গিয়েছিলেন শিলাইদহে। আসার আগে বন্ধুর কাছে একটি শর্ত আরোপ করেছিলেন। শর্তটি আর কিছুই নয়, রবীন্দ্রনাথকে নিত্যনতুন গল্প লিখে শোনাতে হবে। শিলাইদহবাসের সেই আনন্দ-ভরপুর দিনগুলির কথা লেখা আছে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের ‘পিতৃস্মৃতি’ বইতে। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘দিনের বেলাটা এইরকম গল্পগুজবে আলোচনায় কেটে যেত। সন্ধ্যা হলেই উনি কবিকে ধরতেন, লেখা পড়ে শোনাতে হবে। কবিতা, প্রবন্ধ কিছুই বাদ দেবার উপায় ছিল না, কিন্তু জগদীশচন্দ্রের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল ছোটগল্পে।’
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৯: ইন্দুমতী ও সুরবালা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৬: রামায়ণে রামচন্দ্রের যাত্রাপথ সুগম হওয়ার কারণেই কি সীতার উপস্থিতি?

‘গল্পগুচ্ছ’-র বেশ কয়েকটি গল্প এই সময়, শিলাইদহবাসকালে লেখা। জগদীশচন্দ্র যেতেন সাধারণত প্রায় প্রতি শনিবার। সোমবার আবার ফিরে আসতেন। শিলাইদহে পৌঁছেই রবীন্দ্রনাথের কাছে দাবি করতেন, গল্প চাই! লেখা শেষ হলেই শোনাতে হত জগদীশচন্দ্রকে। বন্ধুর সেই দাবি কখনো ‘অগ্রাহ্য’ করেননি রবীন্দ্রনাথ।

জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছিল প্রাণের বন্ধন। চিঠিগুলি পড়লেই বোঝা যায়, কতখানি আপনারজন ছিলেন তিনি। কবি পারিবারিক বিষয়েও তাঁর পরামর্শ নিতেন। দুঃখ-যন্ত্রণার কথা অকাতরে জানাতেন। দুঃখের দিনে জগদীশচন্দ্র ছিলেন বরাবরই সমব্যথী। হৃদয় দিয়ে বন্ধুর দুঃখ বোঝার চেষ্টা করতেন, শোকযন্ত্রণায় সান্ত্বনার প্রলেপ বুলিয়ে দিয়েছেন।

দুই বন্ধু: রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্র।

রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে জগদীশচন্দ্র কতখানি খুশি হয়েছিলেন, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এক চিঠিতে। রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে জগদীশচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীতে তোমাকে এতদিন জয়মাল্য ভূষিত না দেখিয়া বেদনা অনুভব করিয়াছি। আজ সেই দুঃখ দূর হইল।’ আনন্দে উচ্ছ্বাসে তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন তিনি, ছোট একটি মাটির টবে বসানো লজ্জাবতী লতা!

রবীন্দ্রনাথও নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। জগদীশচন্দ্র বসুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। গান বেঁধেছেন। প্রবন্ধ লিখেছেন। বন্ধুকে উৎসর্গ করেছেন একাধিক বই। কবি ও বিজ্ঞানীর মধ্যে এই যে সখ্য, পারস্পরিক বিশ্বাস ও মৈত্রীর বন্ধন, তা কোনওভাবেই বিঘ্নিত হয়নি। বরং এক চিরকালীন দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content