শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ।

প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র তিনি। বিলাস-বৈভবে আনন্দ-সুখে তাঁর জীবন কাটবে, এটাই বোধহয় আপাতভাবে স্বাভাবিক ছিল। এমন মনে হলেও তাঁর মতো হৃদয়বান মানুষের পক্ষে কী করেই বা তা সম্ভব! জীবনের শেষবেলায় পৃথিবী জুড়ে যে বিপণ্ণতা তৈরি হয়েছিল, তা কতখানি তাঁকে বিচলিত করেছিল, সে তথ্য তো আমাদের হাতে আছে। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি জানার জন্য সব সময়ই উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। কোথায় বন্যা, কোথায় খরা, কোথায় দুর্ভিক্ষ — মানুষের বিপন্নতা তাঁকে উদ্বিগ্ন করত। রবীন্দ্রনাথ কখনোই কল্পজগতে বাস করেননি। বাস্তবের মাটিতে পা ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, আর কিছু নয়, আমাদের লোক — এটাই তাঁর পরিচয় হয়ে উঠুক। লেখায়, কাগজ-কলমে অনেকেই মানুষের জন্য কাতরতা দেখান। আসলে সেসব লোক-দেখানো, সমাজসংসার, বৃহত্তর মানুষ কোনও কিছুই তাঁদের ভাবায় না। রবীন্দ্রনাথ সে দলের নন, তিনি অনন্য। বরাবরই আর্ত-পীড়িত বিপন্ন মানুষের জন্য তাঁর অন্তরাত্মা কেঁদে উঠেছে। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও নিজেকে উজাড় কর দিয়েছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কার্পণ্য করেননি। মানুষের সংকট কখনো জেলায়, কখনো বা জেলার বাইরে রাজ্য-দেশ ছাড়িয়ে হয়তো দেশান্তরে। যুদ্ধবিধ্বস্ত রাশিয়ার দুর্ভিক্ষ বা জাপানের টোকিও-ইয়োকোহামার ভূমিকম্পও রবীন্দ্রনাথকে ভাবিয়েছে।
১৯২২ যুদ্ধ-বিধ্বস্ত রাশিয়ায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মানুষের বিপন্নতার কথা জানিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল ভিনোগ্ৰাডফ রবীন্দ্রনাথের কাছে আর্থিক সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও অর্থ-সংগ্রহে নেমে পড়েছিলেন। দেশের মানুষের কাছে অর্থ- সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন কবি। শান্তিনিকেতনের ঠিকানায় সাহায্য পাঠাতে বলা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের স্নেহের পাত্ররা, বন্ধুরা অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই তালিকায় অমল হোম এবং ড. দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের মতো সুপরিচিত বিশিষ্টজনেরা ছিলেন।

সংবাদসূত্র থেকে জানা যায়, জনগণের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ আড়াই হাজার টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। জাপানের ভূমিকম্প নিয়েও একইভাবে তিনি সাহায্য-ভাণ্ডার তৈরি করেছিলেন। আশ্রমের ছাত্র-শিক্ষকরা সে অর্থ-ভাণ্ডারে কিছু কিছু সাহায্য করেছিলেন। আশ্রম থেকে সাতশো পঞ্চাশ টাকার মতো সংগৃহীত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজেও কিছু টাকা দিয়েছিলেন। সংগৃহীত অর্থ পাঠানো হয়েছিল জাপানে। এসব কোনও বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়, এমন ঘটনা বারবার ঘটেছে। কখনো তিনি পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য জনগণের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, কখনো নিজে সক্রিয়ভাবে অর্থ সংগ্রহে নেমে পড়েছেন। জীবনভরই এই সক্রিয়তা লক্ষ করা গিয়েছে। তখন তাঁর যুবক-বয়স। নানাভাবে ব্যস্ত। লেখার ব্যস্ততা, সম্পাদনার ব্যস্ততা। ঠাকুরবাড়ি থেকে সেসময় জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সম্পাদনায় ‘বালক’ পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। সম্পাদক হিসেবে কবির বউঠানের নাম ছাপা হলেও পত্রিকা-সম্পাদনার যাবতীয় কাজ একাই সামলাতেন রবীন্দ্রনাথ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮২: রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছেও পড়েছেন

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৩: ত্রিপুরার সমৃদ্ধিতে রাজা বিজয় মাণিক্যের ভূমিকা অপরিসীম

সে সময় পরপর দু’বছর অনাবৃষ্টির ফলে বীরভূমের নলহাটি-সংলগ্ন অঞ্চলে মানুষজনের খুবই দুর্গতি হয়। দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে সে সময় আদি ব্রাহ্মসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। বিপন্ন মানুষের কথা ভেবে ব্রাহ্মসমাজের তরফে একটি সভা আহ্বান করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, আর্ত-পীড়িত মানুষজনের কথা ভেবে গানও রচনা করেছিলেন। গানটি ছিল এ রকম, ‘আজি কাঁদে কারা ওই শুনা যায়, অনাথেরা কোথা করে হাহাকার…।’ রবীন্দ্রনাথ পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আবেদন জানিয়ে একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। প্রবন্ধটি ওই সভায় পাঠও করেছিলেন। পরে সেটি ‘তত্ত্বকৌমদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়।

এটা কোনও বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়, রবীন্দ্রনাথ যুবক বয়স থেকে আর্ত-পীড়িত মানুষের পাশে এই ভাবে দাঁড়িয়েছেন। যুবক-বয়সে কখনো সুন্দরবনের দরিদ্র মানুষজনকে ঘরবাড়ি বানানোর জন্য, কৃষিকাজে সহায়তা করার জন্য অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন, আবার কখনো-বা বাঁকুড়ার দুর্ভিক্ষ-কবলিত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। অর্থ-সংগ্রহের জন্য ‘ফাল্গুনী’ অভিনয়ের ব্যবস্থা করেছেন। তখন তিনি ছিলেন দূরে, শিলাইদহে। নাট্যাভিনয়ের জন্যে দ্রুত ফিরে এসেছিলেন জোড়াসাঁকোয়। ঠাকুরবাড়ির প্রাঙ্গণে টিকিট কেটে ‘ফাল্গুনী’ অভিনীত হয়েছিল। সাধুবাদ জানিয়েছিলেন সকলে। নাট্যাভিনয়ের মধ্য দিয়ে সংগৃহীত অর্থ বিপন্ন মানুষের কাছে প্রেরিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪১: সুন্দরবনে বাঘে-মানুষে সংঘাত

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫০: অর্ধশতাব্দী ছুঁলো ‘অমানুষ’

রাশিয়ায় দুর্ভিক্ষ, জাপানে ভূমিকম্প, দেশে দেশান্তরে যেখানেই কোনও বিপর্যয় ঘটেছে, রবীন্দ্রনাথ বিচলিত হয়েছেন। মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ১৯২৮-এ বীরভূমে তীব্র জলাভাব দেখা দেয়, দুর্ভিক্ষ হয়। দরিদ্র মানুষজনের অভাবনীয় দুর্গতি, গাছের পাতা খেয়েও কাউকে কাউকে দিন কাটাতে হয়েছে। শান্তিনিকেতনে আশ্রম-বালকরা রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে রাস্তায় নেমেছিল অর্থ-সংগ্ৰহে, চাল সংগ্রহে। এই বিপর্যয় মোকাবিলা করার জন্যও অর্থ-ভাণ্ডার খোলা হয়েছিল। কম-বেশি সকলেই সাহায্য করেছেন। রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন হাজার টাকা। সেই সময়ের বিচারে হাজার টাকা খুব কম নয়। কবির দেওয়া টাকায় আশ্রমের অদূরে বল্লভপুরে কূপ খনন, ডাঙ্গাপাড়ায় হয়েছিল পুষ্করিণী খনন। কাছে দূরের অর্থবান মানুষজনরা এগিয়ে এসেছিলেন অর্থ-সাহায্যে। এমনকি রাজকর্মচারী এক ইংরেজও সহৃদয়তার পরিচয় দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। দিয়েছিলেন পাঁচশো টাকা। রবীন্দ্রনাথ দেশবাসীর কাছে সাহায্যের আবেদনও জানিয়েছিলেন। তাঁরই পরামর্শে ‘দুর্ভিক্ষ নিবারণী সমিতি’ গঠন করা হয়েছিল। সেই সমিতির কোষাধ্যক্ষ করা হয় আশ্রম-শিক্ষক জগদানন্দ রায়কে। কোষাধ্যক্ষের নামে, আশ্রমের ঠিকানায় সাহায্যের টাকা পাঠানোর জন্য বলা হয়েছিল।

অমল হোম।

রবীন্দ্রনাথ লেখায় তো বটেই, বাস্তব জীবনেও বরাবর মানুষের পাশে থেকেছেন। এমনও হয়েছে, অমল হোমকে কবি নিজের জন্মদিন উদযাপনে বারণ করেছেন। সেই টাকা বন্যার্তদের দিতে বলেছেন। শরৎচন্দ্রকে চিঠি লিখেছেন, ‘শুনছি তোমরা আমায় অর্ঘ্যরূপে কিছু টাকা সংগ্রহের সংকল্প করেছ। দেশে এখন দারুণ দুর্দিন।… যদি আমার হাতে কিছু দিতে চাও, তবে সেটার লক্ষ্য হবে দুর্গতদের দুঃখ হরণ। আমিও স্বতন্ত্রভাবে সে জন্য চেষ্টা করচি— কলকাতায় এই উদ্দেশে একটা কিছু পালাগানের কথা চলচে। এই উপায়ে কিছু কুড়ানো যাবে আশা করি।’

শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে প্রবল বর্ষণে প্রায়শই বন্যা হত। অজয়ের বাঁধ কতবার ভেঙে গিয়েছে। আশ্রম-ছাত্ররা প্রতিবারই বিপন্ন মানুষকে বাঁচাতে নানাভাবে সাহায্য করেছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও অর্থ-সাহায্য করেছেন। এমনকি একবার চ্যারিটি ফুটবল ম্যাচের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৮: অভিভাবিকা মা সারদা

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৫: ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা

মানুষ বিপন্ন— তা যে দেশেরই হোক না কেন, রবীন্দ্রনাথের অন্তরাত্মা কেঁদে উঠেছে। কাতর হয়েছেন। বিহারে ভূমিকম্প হয়েছে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আবার, নেপালের ভূমিকম্পেও তিনি কাতর হয়েছেন। বিহারের দুর্গত মানুষের কথা ভেবে কলকাতায় ‘রক্তকরবী’ মঞ্চস্থ করে রবীন্দ্রনাথ অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। কবি নিজেও বারবার দুর্গত মানুষজনের জন্য সাধ্যমতো আর্থিক সাহায্য করেছেন। দেশের মানুষের কাছেও সাহায্যের আবেদন করেছেন। বিহারের বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আবেদনে যথেষ্ট সাড়া পড়েছিল। বিহারের বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আবেদনে সাড়া দিয়ে ‘টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি’-কর্তৃপক্ষ নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দান করেছিলেন। সমপরিমাণ আর্থিক মূল্যের জিনিসপত্রও কিনে দিয়েছিলেন। এমনকি শ্রীমতী টাটাও নগদ দশ হাজার টাকা আর্তপীড়িতজনের উদ্দেশে দান করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ও নাটকের কুশীলব।

রবীন্দ্রনাথের তখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে। অশক্ত শরীর। আগের মতো আর লিখতেও পারেন না। নিজেরই তাঁর মনে হয়েছে, ‘ক্লান্ত কলম নতুন লেখায় প্রবৃত্ত হতে অসম্মত।’ অসুস্থ শরীরেও কবি ভেবেছেন, দুর্গত মানুষজনের কথা। ‘প্রবাসী’ পত্রের সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শুধুই কেজো সম্পর্ক ছিল না। বন্ধন ছিল প্রাণের, বন্ধুত্বের। তাঁকে লেখা এক চিঠি থেকে জানা যায়, সে সময় ‘আনন্দবাজার’ ও ‘দেশ’-এর পুজোসংখ্যার জন্য দুটি কবিতা পাঠানোর আবেদন এসেছিল। শুধুই আবেদন নয়, আবেদনের সঙ্গে ছিল ‘একশো টাকা বায়না’। কবি তখন অসুস্থ শরীরেও বন্যা-কবলিত মানুষজনের জন্য অর্থ-সংগ্রহে ব্যস্ত। বায়নার টাকা হাতে পেয়ে বিপন্ন মানুষের কথা সবার আগে মনে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের। বন্যা-কবলিতদের সাহায্যার্থে যে তহবিল গঠন করা হয়েছিল, সে তহবিলে আগাম পাওয়া টাকা দান করেছিলেন।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content