
রবীন্দ্রনাথ।
কোনও কোনও সম্পর্ক দ্রুত গভীরে পৌঁছোয়। মুহূর্তেই আপন হয়ে ওঠে। স্থায়িত্ব পায়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যে বহু মানুষের চেনাজানা ছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিনই নতুন করে অনেককে চিনেছেন, আবার ভুলেওছেন। এরমধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। সেটাই স্বাভাবিক। আশুতোষ চৌধুরি, তাঁর সঙ্গে কবির দেখা হয়েছিল, পরিচয় হয়েছিল রেলগাড়ির কামরায় নয়, ভাসমান জলযানে। সহযাত্রীর সঙ্গে দু-চার কথার চালাচালি, একটু গল্পগাছা, যেমন হয়ে থাকে, শুরু তেমনভাবে হলেও তা জাহাজ থেকে অবতরণের পর ওই জলেই বিসর্জিত হয়নি, বরং নিবিড় বন্ধুত্বের বন্ধন তৈরি হয়েছিল। ‘জীবনস্মৃতি’র পাতায় আশুতোষ চৌধুরির কথা লিখতে বসে রবীন্দ্রনাথ নতুন করে উপলব্ধি করেছেন, ‘পরিচয়ের গভীরতা দিনসংখ্যার উপর নির্ভর করে না। একটি অতি সহজ সহৃদয়তার দ্বারা অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি এমন করিয়া আমার চিত্ত অধিকার করিয়া লইলেন যে, পূর্বে তাঁহার সঙ্গে যে চেনাশোনা ছিল না, সেই ফাঁকটা এই কয়দিনের মধ্যেই যেন আগাগোড়া ভরিয়া গেল।’
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আশুতোষ চৌধুরির সেই পরিচয় দ্রুত পূর্ণতার পথে যাত্রা করেছিল। ক্রমেই তৈরি হয় গভীর হৃদ্যতা। আশুতোষ বিলেতে যাচ্ছিলেন, কেমব্রিজে আইন পড়ার উদ্দেশ্যে, ব্যারিস্টার হয়ে ওঠার বাসনায়। বিলেতযাত্রার দীর্ঘপথে আশুতোষকে সঙ্গী হিসেবে পাননি রবীন্দ্রনাথ। পেয়েছিলেন মাদ্রাজ পর্যন্ত। সে সময় সরাসরি জাহাজে কলকাতা থেকে বিলেতে যাওয়া যেত না। মাদ্রাজ পর্যন্ত যেতে হত স্টীমারে। এই স্টিমারে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী ছিলেন আশুতোষ চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিলেন ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ। তিনি বিলেত যাননি, মাদ্রাজ হয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১৪: ঠাট্টা করলে যে বুঝতে পারত, ঠিক সময়ে হাসতে পারত

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৪৮: রান্নার জ্বালানি নারী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ?
আশুতোষ চৌধুরি পাবনার সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারের সন্তান। অত্যন্ত মেধাবী, কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিভিন্ন পরীক্ষায়। পড়তেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরের পড়াশোনা করে পাড়ি দিয়েছিলেন বিলেতে। ভরতি হন কেমব্রিজের সেন্ট জন্স কলেজে। ওদেশে গিয়েও পরিচয় দিয়েছেন গভীর মেধাশক্তির। সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন অঙ্ক ও আইনে। ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফেরার পরে পরেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। আশুতোষ টানা ছিলেন ও দেশে, রবীন্দ্রনাথের মনে তাঁকে ঘিরে যে মুগ্ধতা তৈরি হয়েছিল, তাঁর অনুপস্থিতিতে তা কমেনি, বরং বেড়েছে। বিলেতেও আশুতোষ একের পর এক সাফল্য পেয়েছেন, সে সংবাদ কবির কানে পৌঁছেছে। তিনি স্বদেশে ফেরা মাত্র রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। দ্রুত যোগাযোগের কারণ একটাই, রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন সেজদা হেমেন্দ্রনাথের কন্যা প্রতিভাসুন্দরীর সঙ্গে আশুতোষের বিবাহ হোক। আশুতোষ হোক ঠাকুরবাড়ির জামাতা। এই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য কবির তৎপরতারও অন্ত ছিল না।

আশুতোষ চৌধুরি।
বিবাহের পূর্বে পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব রবীন্দ্রনাথ আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিবাহের ঘটকালি করেছিলেন ঠিকই, পরিচয় হওয়ার পর আশুতোষ-প্রতিভাসুন্দরীর মধ্যেও যে অনুরাগ জেগেছিল, পরস্পর আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। আশুতোষ শুধু কৃতি ছিলেন, তা নয়, প্রতিভাসুন্দরীও কম কৃতিত্বের অধিকারিণী ছিলেন না। সঙ্গীতে তাঁর দখল ছিল অসামান্য। স্বরলিপি তৈরি করতেও পারতেন। ভালো অভিনয় করতেন। রবীন্দ্রনাথের নাটকেও অভিনয় করেছেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৫: এ কেমন রঙ্গ জাদু, এ কেমন রঙ্গ…/৩

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৬: মা সারদার প্রথম মন্ত্রশিষ্যা ছিলেন দুর্গাপুরীদেবী
আদি ব্রাহ্মসমাজের নিয়ম মেনে হয়েছিল আশুতোষ ও প্রতিভাসুন্দরীর বিবাহ-অনুষ্ঠান। ঠাকুরবাড়ির সব বিবাহ বা বিবাহ-সম্ভাবনা যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ মেনে নিয়েছেন, তা নয়। বিরূপ মন্তব্যের, বিরোধিতার নজিরও আছে। আশুতোষকে মহর্ষিদেবের মনে ধরেছিল। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছেন, ‘আশু আমার একটা অর্জন। অনেক সাধনায় প্রতিভা এমন পাত্রে পরিণীতা হয়েছে।’ আশুতোষের দিদি প্রিয়ম্বদা দেবীর মা প্রসন্নময়ী দেবীর লেখায় মহর্ষিদেবের এই মনোভাবের কথা ধরা আছে। সমাজজীবনে আশুতোষের প্রতিষ্ঠা, ব্যারিস্টার হিসেবে সাফল্য কিছুই তখনও সূচিত হয়নি, তা সত্ত্বেও তাঁকে মহর্ষির ভালো লেগেছিল। রবীন্দ্রনাথের লেখায় আছে, ‘তখনো ব্যারিস্টারি ব্যবসায়ের ব্যূহের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িয়া ল-য়ের মধ্যে লীন হইবার সময় তাঁহার হয় নাই। মক্কেলের কুঞ্চিত থলিগুলি পূর্ণ বিকশিত হইয়া তখনো স্বর্ণকোষ উন্মুক্ত করে নাই এবং সাহিত্যবনের মধুসঞ্চয়েই তিনি তখন উৎসাহী হইয়া ফিরিতেছিলেন।’

প্রতিভাসুন্দরী দেবী।
পেশা নিয়ে সত্যিই তখনও আশুতোষের মনে ভাবনা-দুর্ভাবনা জাগেনি। সাহিত্যচর্চাতেই আনন্দ, নিজের মতো করে এক আনন্দের জগৎ তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি। কবিতা লিখতেন, পাঠ্যপুস্তক রচনা করতেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সখ্য দিনে দিনে আরও গভীর হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই তাঁর স্কটলেনের বাড়িতে যেতেন। আশুতোষের ভাই প্রমথ চৌধুরি, তিনিও পরবর্তীকালে ঠাকুরবাড়ির জামাই হয়েছিলেন, বিবাহ হয়েছিল কবির ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার সঙ্গে, তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ অন্তত ‘হপ্তায় দু-তিন দিন’ তাঁদের বাড়িতে আসতেন। আসার উদ্দেশ্য একটাই, বন্ধু আশুতোষের সঙ্গে গল্পগাছা, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা, বইপত্তর প্রকাশ নিয়ে ভাবনাচিন্তা। তাঁদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য তেমন ছিল না বলেই ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রতিভাসুন্দরীকে একশো টাকা করে মাসোহারা দেওয়া হত।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১২: প্রশাসক রামচন্দ্রের সাফল্য কী আধুনিক কর্মব্যস্ত জীবনে সফল প্রশাসকদের আলোর দিশা হতে পারে?

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৫: সর্বত্র বরফ, কোত্থাও কেউ নেই, একেবারে গা ছমছম করা পরিবেশ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই বন্ধুটির কথা ‘জীবনস্মৃতি’তে বিশেষভাবে লিখেছেন। কবি জানিয়েছেন, তিনি তখন ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো লিখছেন। লেখা কবিতাগুলো আশুতোষকে শোনাতেন। পরস্পর আলোচনা করতেন। আশুতোষ বলতেন তাঁর ভালো লাগার কথা। রবীন্দ্রনাথকে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘তোমার এই কবিতাগুলি যথোচিত পর্যায়ে সাজাইয়া আমিই প্রকাশ করিব।’

প্রমথ চৌধুরি।
রবীন্দ্রনাথ আশুতোষের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। কতখানি গুরুত্ব দিতেন, তা বোঝার জন্য এই ঘটনাটিই যথেষ্ট। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে’ — এই চতুর্দশপদী কবিতাটি তিনিই গ্রন্থের প্রথমেই বসাইয়া দিলেন। তাঁহার মতে এই কবিতাটির মধ্যেই সমস্ত গ্রন্থের মর্মকথাটি আছে।’
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৭: পাতি সরালি

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৭: পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যাঁর জীবনের আকাশে কখনও শত্রুতার মেঘ জমেনি
রবীন্দ্রনাথের প্রতি আশুতোষের এই আনুগত্য, শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালোবাসা কখনো নষ্ট হয়ে যায়নি। অচিরেই আশুতোষ চৌধুরির ব্যস্ততা বেড়েছে। পেশাগত ব্যস্ততার জন্য রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অবশ্য দূরত্ব তৈরি হয়নি। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নানাভাবে বারবার স্বীকৃতি দিয়েছেন। বইও উৎসর্গ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথের প্রস্তাব মতো ঠাকুরবাড়িতে ‘খামখেয়ালি সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সভ্যদের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে এই সভার আয়োজন হত। গানবাজনা, সাহিত্যপাঠ, আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে দেদার খাওয়াদাওয়া। ‘খামখেয়ালি সভা’য় আশুতোষ চৌধুরিরও ডাক পড়ত। এমনকি তাঁর বাড়িতেও ‘খামখেয়ালি সভা’র অধিবেশন বসেছে। হাইকোর্টে বিচারক নিযুক্ত হওয়ার পর বন্ধুবান্ধব, নিকটজনের অনুরোধে আশুতোষ বাড়িতে পার্টিও দিয়েছিলেন। সেই পার্টিতে রবীন্দ্র-নাটকও অভিনীত হয়েছিল। আমন্ত্রিতদের রকমারি আমোদ-আনন্দের পাশাপাশি ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন আশুতোষ। রবীন্দ্রনাথ সবসময়ই তাঁর সঙ্গী ছিলেন, কখনো প্রত্যক্ষভাবে, কখনো বা পরোক্ষে।

প্রসন্নময়ী দেবী।
রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছাতেই আশুতোষ চৌধুরি প্রতিভাসুন্দরীকে বিবাহ করে এক সুখী গৃহকোণ তৈরি করেছিলেন। আকস্মিক প্রতিভার মৃত্যু হয় হৃদরোগে। পত্নীর বিয়োগের যন্ত্রণায় একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। শোকবিধ্বস্ত আশুতোষের মর্মযন্ত্রণা কতখানি তীব্র হয়েছিল, তা ধরা আছে ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী লেখায়। জানা যায়, ‘বড়োঠাকুর ছেলেমানুষের মতো ‘প্রতিভা, প্রতিভা’ বলে কেঁদে কেঁদে বেড়াতে লাগলেন, সে ভগ্নস্বর এখনো যেন কানে বাজছে।’ সেই সংকটকালে পুত্র আর্যকুমার সবসময়ই পিতার পাশে থেকেছেন। সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। পুত্রের সে চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। দিনে দিনে আশুতোষ চৌধুরির শরীর ভেঙেছে। অসুস্থ-রুগ্ন মানুষটি পত্নী-বিয়োগের পর বছর দুয়েক বেঁচেছিলেন। প্রতিভার চলে যাওয়া কিছুতেই তিনি মেনে নিতে পারেননি।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।