বুধবার ৭ মে, ২০২৫


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথের লেখায় হাস্যরস আছে। কখনও নির্মল হাস্যরস, কখনও বা শাণিত ব্যঙ্গ। রবীন্দ্রসাহিত্যে হাস্যরস কখনও মুখ্য হয়ে ওঠেনি। ‘হাস্যকৌতুক’ ও ‘ব্যঙ্গকৌতুক’ নামে তিনি দুটি ছোট বইও লিখেছিলেন। বইয়ের নামে ‘কৌতুক’ থাকলেও রবীন্দ্রসাহিত্য কৌতুকময় নয়। হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো কোথাও কোথাও ঝলমলিয়ে উঠলেও তা গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েনি। সে কৌতুকও ভারি বুদ্ধিদীপ্ত। তাঁর ব্যক্তিজীবন অবশ্য ছিল হাস্যরসময়। সর্বত্র, সারাক্ষণই যে হাস্যরসের প্লাবন, তা নয়। খুবই অন্তরঙ্গ আত্মীয় ও প্রিয়জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল সেই হাস্যরস। হাস্যরসময় নানা ঘটনা, মন্তব্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নানা স্মৃতিচর্চায়। হীরকখণ্ডের মতোই দ্যুতি, আজও ঝলমলে উজ্জ্বল।
কবির অনুচর বনমালিকে নিয়ে অনেক মজার গল্প আছে। শুধু শান্তিনিকেতনে নয়, দূরে কোথাও যাওয়ার সময়ও সে কবির সঙ্গী হয়েছে। বনমালিকে যদি কোনও কাপড় বের করতে বলা হত, তাহলে সিন্দুক থেকে একে একে সব কাপড় বের করে তবেই সে নির্দিষ্ট কাপড়টি খুঁজত। রবীন্দ্রনাথ বনমালির এসব কাণ্ডকারখানার কথা বলতে গিয়ে স্নেহভাজন রাণুকে লিখেছিলেন, ‘মানুষের আয়ু যখন অল্প, সময় যখন সীমাবদ্ধ, তখন এরকম চাকর নিয়ে মর্ত্যলোকে অসুবিধায় পড়তে হয়।’ একেবারে নির্গুণ ছিল না সে, তার সম্পর্কে রাণুকে কবি আরও লিখেছিলেন, ‘ওর একটা মস্ত গুণ এই যে ও ঠাট্টা করলে বুঝতে পারে, ঠিক সময়ে হাসতে জানে।’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১৩: শরৎকুমারী স্নানাগারের সামনে বসে সারাক্ষণই সাজতেন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৩: মা সারদার সঙ্গে সরলাদেবীর কাশীভ্রমণ

কবির কাছে অতিথি আনাগোনার শেষ ছিল না। তাদের আপ্যায়নও করতে হত। একদিন এমনই এক অতিথি এসেছেন। কবি বনমালিকে ফরমাশ করলেন, চা করে আনার জন্য। বনমালি চা করে আনতে অনেক দেরি করছে দেখে রবীন্দ্রনাথ স্বভাবসুলভ রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘বনমালি আমার চা-কর বটে, কিন্তু সু-কর নয়।’ আগত অতিথি একথার মানে বুঝলেন না। ‘চা-কর’ তার কাছে ‘চাকর’, ‘সু-কর’ তার কাছে ‘শূকর’ ঠেকল। ফলে কিছুই বুঝতে না পেরে কবির মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। শব্দ নিয়ে এমন বুদ্ধিদীপ্ত মজায় রবীন্দ্রনাথের জুড়ি ছিল না।

একবার এক ভদ্রলোক কবির কাছে তার বোনকে নিয়ে এসেছিলেন। বোনটি গানবাজনার চর্চা করে। কবির সুপরামর্শে উপকৃত হবে, এমনই ভেবে বোনকে সঙ্গে এনেছিলেন তিনি। কবি গান নিয়ে এ-কথা সে-কথা বলার পর তাঁর বোনকে জিগ্যেস করলেন, ‘তুমি বিনাযন্ত্রে গান গাইতে পারো?’ মেয়েটি কলেজ-পড়ুয়া, চালাকচতুর। সহজেই বুঝে যায়, কবির এ কথার মধ্যে কৌতুক লুকোনো রয়েছে। জানতে চায় সে, কবি ‘বিনাযন্ত্র’ বলতে চাইছেন, নাকি ‘বীণাযন্ত্র’ বলছেন?

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।

মেয়েটির প্রশ্নে কবি হেসে ফেলেছিলেন। প্রশ্ন করার সময় মেয়েটির মুখে যে সলজ্জভাব ছিল, তা নিমেষে উধাও হয়ে যায়। কবির মুখের হাসি মেয়েটির মুখেও ছড়িয়ে পড়ে। শব্দ নিয়ে কত মজা। মজা যেন ঠোঁটের আগায় লেগে থাকত রবীন্দ্রনাথের। শব্দ-কৌতুকে সত্যিই তাঁর জুড়ি ছিল না। রবিজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ছিলেন আশ্রম-গ্রন্থগারিক। চার খণ্ডে প্রকাশিত তাঁর রবীন্দ্রজীবনী রবীন্দ্রচর্চার আকর গ্রন্থ, প্রধান অবলম্বন। কবি সেদিন বসেছিলেন বারান্দায়। বারান্দায় নিরালায় নির্জনে বসে কবির কত প্রহর কাটত। মগ্ন হয়ে সেদিন কী ভাবছিলেন। হঠাৎই ভাবনায় ছেদ পড়ে। লক্ষ করেন, একগোছা বই নিয়ে হনহনিয়ে চলেছেন প্রভাতকুমার। রবীন্দ্রনাথ ডাকলেন তাঁকে, ‘ও বৈবাহিক, শোনো শোনো।’

শুনে তো প্রভাতকুমার হতবাক। ঘোর বিস্ময়ের কারণও রয়েছে। তাঁর বন্ধুরা এক সম্পর্কের সূত্র ধরে ‘বৈবাহিক’ বলে রসিকতা করে বটে, তা বলে কবিও। বন্ধুরা যা বলে তা কি রবীন্দ্রনাথের মুখে মানায়! তাঁর সঙ্গে তো স্নেহ-মধুর সম্পর্ক। বন্ধুদের ভাষায় গুরুদেব রসিকতা করছেন, মেনে নিতে পারলেন না প্রভাতকুমার। শুধু মনে বিস্ময় জাগল, তা নয়, যথেষ্ট ক্ষুণ্ণও হলেন। মুখের ভাবান্তরে রবীন্দ্রনাথের বুঝতে অসুবিধা হল না যে প্রভাতকুমার যথেষ্ট উত্তেজিত ও ক্রুদ্ধ। উত্তপ্ত পরিস্থিতি সহজেই হালকা করে দিলেন কবি। বললেন, ‘আরে না না, ‘বৈবাহিক’ নয়, তোমায় আমি ডাকছি ‘বই-বাহিক’ বলে।’ মুহূর্তে প্রভাতকুমারের সব রাগ গলে জল হয়ে যায়। দু’জনেই সশব্দে হেসে ওঠেন।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৬: পরাগপাখি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১১: বিপদ যখন আসে

ক্ষিতিমোহন সেন রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে যোগ দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে। ক্ষিতিমোহন সেনের বাড়িতে গিয়ে কবি দেখলেন, খেতে বসছেন তিনি। ক্ষিতিমোহনের স্ত্রী রকমারি ব্যঞ্জন প্রস্তুত করেছেন, সযত্নে পরিবেশন করছেন। সে দৃশ্য চাক্ষুষ করে কবির সরস মন্তব্য, ‘পাক তো খুব ভালো হয়েছে দেখছি, এবার পরিপাক হলে হয়।’ শান্তিনিকেতনে উত্তরায়ণের বারান্দায় প্রতিদিনই সকালে নিয়ম করে বসতেন রবীন্দ্রনাথ। চেনা-জানা কেউ কেউ আসতেন। সেদিন এসেছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। অদূরেই আরেকটি চেয়ার, সেই চেয়ারে বসলেন ক্ষিতিমোহন। খানিক পরেই ভৃত্য কবিকে গ্লাস-ভরা কীসের যেন রস দিয়ে যায়। কবি আয়েস করে গ্লাসে একটু একটু চুমুক দিতে থাকেন আর কথা বলে চলেন। ক্ষিতিমোহন বার বার ঘুরেফিরেই গ্লাসের দিকে তাকাচ্ছিলেন। হয়তো ভাবছিলেন, কী উপাদেয় পানীয়ই না পান করছেন গুরুদেব!

ক্ষিতিমোহন সেন।

ক্ষিতিমোহনের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনের কথা মুহূর্তে পড়ে ফেললেন রবীন্দ্রনাথ। হয়তো নিজের মনে হাসলেনও। ভৃত্যকে ডেকে ক্ষিতিমোহনকেও ওই পানীয় দিতে বললেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেই পানীয় টেবিলের ওপর রেখে গেল ভৃত্য। কবির বেশ বড়সড় গ্লাস। তাঁর গ্লাসে পানীয় তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট কম, তলানিতে পড়ে আছে। কম পানীয় পেয়ে মনে মনে একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন ক্ষিতিমোহন। আর তর সইল না, তখুনি সবটুকু গলায় ঢেলে দিলেন। গলায় ঢেলে পড়লেন মহাবিপদে। গলাধঃকরণ করাই যে দায় হয়ে ওঠে। গ্লাসে তো ছিল বিশুদ্ধ নিমপাতার রস। তাঁর অবস্থা দেখে রবীন্দ্রনাথও না হেসে পারেননি।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫৬: সিলেটে দেখা মণিপুরী নাচ কবির নৃত্য ভাবনাকে উস্কে দিয়েছিল

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৪: গ্রীষ্মকালে আলাস্কা সত্যিই অচেনা এক দেশ

রবীন্দ্রনাথের ছিল বাড়তি দাড়ি-প্রীতি। নিজের দাড়ি নিয়ে নিজেই মজা করেছেন। এক গানের আসরে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন কবি। সেই আসরে ছিলেন গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রসিদ্ধ সংগীতশিল্পী তিনি। কবি তাঁকে খুবই স্নেহ করতেন। গান গেয়ে আসর জমিয়ে দিয়েছিলেন গোপেশ্বর। গান শেষ হওয়া মাত্র অনুরোধ ধেয়ে এল কবির দিকে। সকলেই জানাল গান গাওয়ার অনুরোধ। সকলেই নাছোড়, কবিকে গান গাইতেই হবে। কবি হাসলেন। হেসে বললেন, ‘গোঁপেশ্বরের পরে এবার কি দাড়িশ্বরের পালা?’ এ কথায় সবাই হেসে ফেললেন। হাসলেন কবিও।

গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়।

কোথাও মোটা দাগের স্থূলতা নেই। সূক্ষ্ম, বুদ্ধিদীপ্ত মজা। অনেক সময় সেই মজা বলার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যেত না। একটু মাথা ঘামালেই নির্মল হাস্যরসধারা, মুগ্ধতায় মন ভরে উঠত। কবি একবার পরিচিত একজনের বাড়ি গিয়েছিলেন। মান্য অতিথি, আপ্যায়নের যাতে ত্রুটি না হয়, সে বিষয়ে বাড়ির সকলেরই ছিল সতর্ক নজর। যে চেয়ার এগিয়ে দিয়েছিল, তার উদ্দেশে কবির প্রশ্ন ছিল, ‘চেয়ারটা সজীব নয় তো?’ কবির প্রশ্নে সবাই হতবাক। কাঠের চেয়ারে প্রাণ থাকবে কী করে। চেয়ারের সজীবত্ব বলতে কী বুঝিয়েছিলেন, শেষে রবীন্দ্রনাথই খোলসা করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি বলছি চেয়ারটা স-জীব অর্থাৎ এতে ছারপোকা নেই তো?’
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৯: আধুনিক যুগে দাবানলের ফলে বনদহনের সঙ্গে খাণ্ডব বনদহনের সাদৃশ্য আছে কী?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’

ছারপোকা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক। মশা নিয়েও কি কম আতঙ্কিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ! শান্তিনিকেতনে গাছপালা ঝোপঝাড় বেশি, ফলে মশাও বেশি। মশার জ্বালায় প্রায়শই অতিষ্ঠ হয়ে পড়তেন কবি। সন্ধের দিকে মশককুল ধেয়ে আসত। কাজকর্ম করতে পারতেন না। বিরক্তিতে মন ভরে যেত। শেষে মশককূলের এই সীমাহীন অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার একটা উপায় বার করলেন রবীন্দ্রনাথ। সন্ধের দিকে কাজে বসলে বা অতিথি-অভ্যাগতদের সঙ্গে কথা বলতে বসলে পায়ে ‘মসকুইটল’ নামে একটা তেল মেখে বসতেন।

কবিগুরু।

সে তেলের এমনই মহিমা, কামড় দেওয়া তো দূরের কথা, কোনও মশা ভুলেও কবির পায়ে আর বসত না। বরং সেই তেল থেকে বেরুত লেবুফুলের মনোরম গন্ধ। রবীন্দ্রনাথ ‘মসকুইটল-তেল’ ছোট একটি শিশিতে নিতেই বসতেন। মাঝে মধ্যেই শিশি থেকে একটু তেল হাতে ঢেলে নিয়ে মাখতেন পায়ে সেই সময় অভ্যাগত কেউ এলে, সেই ব্যক্তি যদি নতুন কেউ হন তো কবি তাকে অবশ্যই বলতেন এ কথাটি, ‘ভেবো না আমার বাত হয়েছে। তেল মালিশ করছি।’ আসলে কথাটি বলতেন রসিয়ে, ‘শান্তিনিকেতনের মশারা ভারী নম্র। সুযোগ পেলেই পদসেবা করে, তাই এই ব্যবস্থা।’

কথায় কথায় মজা, কবির কাছাকাছি যাঁরা থাকতেন, তাঁরা এমনভাবেই মজায় মজেছেন, হেসেছেন।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content