দ্বারকানাথ ঠাকুর।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। সব সময় যে দূরে কোথাও চলে যেতেন, তা নয়, কাছেপিঠেও যেতেন। হিমালয়ের নির্জনবাসের প্রশান্তি হয়তো পেতেন চুঁচুড়োতেও। নদীর প্রতি ছিল অমোঘ আকর্ষণ। যেতেন প্রায়শই জলপথে। জীবনের বেলা শেষে, মহর্ষি তখন রুগ্ন শরীরে সবে ফিরেছেন চৌরঙ্গীর বাড়িতে। অসুস্থতা তখনও রয়ে গিয়েছিল। মন্দের ভালো, দু-জনের কাঁধে ভর দিয়ে একটুআধটু চলতে ফিরতে পারেন। সেই অবস্থাতেও বলেছিলেন, ‘এই কলকাতার বদ্ধ বাতাস ও আকাশের মধ্যে আর আমি থাকতে পারি না। আমি দার্জিলিং যাব।’
দায়দায়িত্ব, বিষয়সম্পত্তির কথা ভুলে ক-দিন যদি কলকাতার ছকে বাঁধা জীবনের বাইরে থাকা যায়, এই চেষ্টা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মধ্যে বরাবর ছিল। বারবার তাই বেরিয়ে পড়েছেন। তখন যাতায়াত তো খুব সহজ ছিল না। সমস্ত প্রতিকূলতা, দুর্গমতা হেলায় অবহেলা করে কখনও দার্জিলিং বা মুসুরি-পাহাড়ে, কখনও মুম্বাইয়ের সমুদ্র-তীরে, এমনকি সুদূর চিনেও। কোথায় না গিয়েছেন ভ্রমণপ্রিয় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ!
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮২: সুন্দরবনের পাখি—টিয়া
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৫: রবীন্দ্রনাথ ভয় পেতেন মহর্ষিদেবকে
মহর্ষির ভ্রমণ-পথ বিঘ্নহীন ছিল,তা নয়। বরং ঘটনার ঘনঘটা ছিল। ঘটনার বাহুল্য, বিপন্নতা কখনোই তাঁকে ভ্রমণ থেকে নিরস্ত করেনি। প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে লক্ষ্যপূরণের পথে এগিয়েছেন তিনি। মহর্ষির ভ্রমণসঙ্গী ঘরেবাইরের আত্মীয়-অনাত্মীয় অনেকেই হয়েছেন। কিশোর রবীন্দ্রনাথ পিতার সঙ্গে গিয়েছিলেন দূর-পাহাড়ে। সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে, পত্নী সারদাসুন্দরীকে নিয়ে আনন্দ-ভ্রমণেও বেরিয়েছেন। সেবার সঙ্গে এক বন্ধু ছিলেন। তিনি রাজনারায়ণ বসু। রাজনারায়ণের সঙ্গে মহর্ষির গভীর সৌহার্দ্যময় সখ্য ছিল। ব্রাহ্মসমাজের প্রচার-প্রসারে মহর্ষি ও রাজনারায়ণ একসঙ্গে পথ হেঁটেছেন। দুই বন্ধু সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন। মহর্ষির সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রেই ঠাকুরবাড়িতে তাঁর ছিল নিত্য যাতায়াত। রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁকে খুব পছন্দ করতেন। রবীন্দ্রনাথকে তিনি পড়িয়েওছেন। সেই রাজনারায়ণ বসু ছিলেন এই পারিবারিক-ভ্রমণে।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ঘোর বর্ষায়, শ্রাবণ মাসে ভ্রমণ। বর্ষাদিনে দ্রুত আবহাওয়া বদলায়, ঝড়-বাদল হয়। ঝড় উঠলে নদীপথ স্বভাবতই বিপদসংকুল হয়ে ওঠে। সেদিনও তেমন হয়েছিল। সাধারণ নৌকোয় ভ্রমণ নয়, এ ভ্রমণ ছিল পিনিসে। মহর্ষির জীবনীকার অজিতকুমার চক্রবর্তীর লেখা থেকে জানা যায়, সারদাসুন্দরী গিয়েছিলেন ‘একটি প্রকাণ্ড পিনিসে।’ অজিতকুমার ‘পিনিস’ বললেও আসলে তা ‘পিনাস’ বা ‘পিনেস’। অভিধান অনুসারে ‘ছোটো দ্রুতগামী নৌকাবিশেষ’।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৭: পাঞ্চালীকে আশীর্বাদ করে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন গান্ধারী
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮০: শ্রীশ্রীমার অনুগ্রহ
‘পিনাস’কে আমরা বোধহয় পানসি নামে চিনি। মহর্ষির জীবনীকারের বর্ণনা অনুসারে তা অবশ্য ছোট ছিল না। যথেষ্ট যে দ্রুতগামী ছিল, সেদিনের ঘটনাক্রমেও তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সারদাসুন্দরীর বোটে ছিলেন তাঁর তিন সন্তান, দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও হেমেন্দ্রনাথ। অন্য বোটে বন্ধু রাজনারায়ণকে নিয়ে মহর্ষি। রাজনারায়ণ জলপথে কোথাও গেলেই ডায়েরি লিখতেন। সেদিনও দিনলিপি লেখার কাজে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। দৃশ্যাবলি সরে সরে যাচ্ছে, কত কিছু দু-চোখ ভরে দেখছেন। অনুভব-উপলদ্ধি সব রাজনারায়ণ নিবিষ্ট হয়ে লিখে রাখছিলেন তাঁর দিনলিপির খাতায়।
রাজনারায়ণ বসু।
বোট ছুটছে দুরন্ত গতিতে। নবদ্বীপ পার হয়ে, চুপি পার হয়ে আরও দূরে এগিয়ে চলেছে। লেখার ফাঁকে ফাঁকে চলেছে মহর্ষির সঙ্গে রাজনারায়ণের আলাপচারিতা, গল্পগাছা। দেবেন্দ্রনাথ বন্ধুটিকে সেদিনের মতো লেখার পাট চুকিয়ে ফেলতে বললেন। মজার ছলে বলা। রাজনারায়ণও মজা করে উত্তর দিলেন, আরও কত কিছু ঘটতে পারে। আরও কত কিছু দেখার সৌভাগ্য হতে পারে, দিন শেষ হওয়ার আগে দিনলিপি লেখা শেষ হবে কী করে! রাজনারায়ণ ঠারেঠোরে এসব তাঁর বন্ধুটিকে বোঝানোয় সফল হওয়ার পরে পরেই আকাশের পশ্চিম দিক ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেল। মেঘ দেখে দেবেন্দ্রনাথ স্বভাবতই আতঙ্কিত। বললেন, ঝড়ের সময় এই বোটে থাকা উচিত হবে না। বড়ো বোটটিতে যেতে চাইলেন। রাজনারায়ণকে আহ্বান করলেন, ‘চলো, আমরা পিনিসে যাই।’
আরও পড়ুন:
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৫: শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষতায় বীরবিক্রম
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৭: ভাগ নুনিয়া, ভাগ
তৎক্ষণাৎ মাঝিও হুকুম তামিল করল। ছোট বোটটিকে সেই ‘প্রকাণ্ড’ পিনিসের গায়ে গায়ে প্রায় লাগিয়ে দিল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথকে বরাবরই প্রকৃতি টানে। নৈসর্গ হাতছানি দিয়ে ডাকে। তিনি বোটের ছাদে গিয়ে বসলেন। খানিক পরে ছাদ থেকে নেমেও পড়লেন। তারপরই শুরু হল এলোমেলো দমকা ঝড়োবাতাস। সেই বাতাসে পিনিসের মাস্তুলের একটা অংশ ভেঙে যায়। ভাঙা-অংশ দড়িটড়িসহ পড়ল বোটের ছাদে। ছেঁড়াপালের পিনিস তীব্র গতিতে চলল ছোটো বোটটিকে সঙ্গে নিয়ে। বড়ো বোটের গতির সঙ্গে ছোটো বোট পাল্লা দেবে কী করে! হার মানে, একেবারে কাৎ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়। স্বাভাবিকভাবেই হই হই পড়ে যায়। ‘সামাল-সামাল’ রব ওঠে। মাস্তুলে জড়িয়ে থাকা দড়ি কাটার জন্য শুরু হয় সমবেত চিৎকার, ‘কোথায় দা, কোথায় দা’। শেষে মেলে একটা ভোঁতা দা। সেই দা দিয়ে কোনওরকমে দড়ি কাটা হয়। সকলেই আতঙ্কিত, ধরেই নিয়েছেন মৃত্যু নিশ্চিত। নির্ঘাত বোট ডুবে যাবে। তখনই আবার দমকা বাতাস। আতঙ্কে আশঙ্কায় সবাই চিৎকার করে ওঠেন। পিনিসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দড়ি কাটার পর ছোটো বোটটি বাঁধনহারা হয়ে তিরের বেগে ছুটে যায়। পাড়ের কাছে গিয়ে কোনওরকমে দাঁড়িয়েও পড়ে।
আরও পড়ুন:
শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭০: অনিশ্চিত ফলের পিছনে না ছুটে নিশ্চিত ফল-প্রদায়ক কাজের প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত
যেভাবেই হোক প্রিয়জনদের বাঁচাতে হবে, কী করবেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। রাজনারায়ণ বসুর তো একেবারে দিশেহারা অবস্থা। ঠিক তখনই একটা ছোট ডিঙিনৌকো এসে ওই বোটের গায়ে লাগে। তাঁরা তো ভীষণ ভয় পেয়ে যান। নিশ্চয়ই বোম্বেটে জলদস্যু। এখনই লুটপাট শুরু করবে। এমনটি ভাবতে না ভাবতেই সেই ছোটো ডিঙিনৌকো থেকে একজন লাফিয়ে নামল নদীর পাড়ে। পাড়ে নামা লোকটির মুখের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলেন মহর্ষি। হায়, কাকে দেখে তিনি ভয় পেয়েছেন, এ যে স্বরূপ, বাড়ির স্বরূপ-খানসামা। হঠাৎ তাঁর কেন আগমন? হয়তো আশেপাশে ছিল, বিপদ ঘটবে—এমন ভেবে নিয়ে বাঁচাতে এসেছে সে।
একটু পরেই আগমনের কারণ স্পষ্ট হয়। স্বরূপ-খানসামা মহর্ষির হাতে একটি চিঠি দেয়। কমে আসা ঝাপসা আলোয় মহর্ষি যা পড়লেন, তা বড়োই হৃদয়বিদারক। তেমন সংবাদের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। ভয়ংকর এক দুঃসংবাদ। পিতৃদেব প্রিন্স দ্বারকানাথের মৃত্যু সংবাদ। সেই কোন্ দূর বিদেশে আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে তাঁর। মহর্ষির মনে হয় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল তাঁর।
একটু পরেই আগমনের কারণ স্পষ্ট হয়। স্বরূপ-খানসামা মহর্ষির হাতে একটি চিঠি দেয়। কমে আসা ঝাপসা আলোয় মহর্ষি যা পড়লেন, তা বড়োই হৃদয়বিদারক। তেমন সংবাদের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। ভয়ংকর এক দুঃসংবাদ। পিতৃদেব প্রিন্স দ্বারকানাথের মৃত্যু সংবাদ। সেই কোন্ দূর বিদেশে আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে তাঁর। মহর্ষির মনে হয় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল তাঁর।
সারদাসুন্দরী দেবী।
সেই মুহূর্তেই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, দ্রুত কলকাতায় পৌঁছতে হবে। আকাশ তখনো স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। ঝড়বাদল চলেছে। রাত হয়ে আসছে। তাই আজ আর নয়, পরের দিন বের হবেন, এমনই মনস্থ করে ফেললেন মহর্ষি। পরের দিনও আকাশ স্বাভাবিক হল না। ঝড়-বৃষ্টি সমানে চলেছে। তারই মধ্যে পিনিসে করে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করলেন। পথে ঝড় তীব্র আকার ধারণ করে। ঝড়-তুফানে ডুবে মরার উপক্রম। কোনওরকমে মাঝিরা তীরে নেমে একটা গাছের সঙ্গে নৌকোটিকে বেঁধে ফেলল। ঝড় থামার পর পুনরায় যাত্রা, শেষে পৌঁছলেন পলতায়। পলতায় পৌঁছে বিপদসংকুল জলপথে নয়, স্থলপথে, গাড়িতে কলকাতার দিকে যাত্রা করলেন। এদিকেও ঝড়-বাদল ব্যাপক হয়েছে। পথঘাট জলমগ্ন। দুর্যোগ অতিক্রম করে অনেক রাতে শেষ পর্যন্ত সবাইকে নিয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বাড়িতে পৌঁছলেন। কীভাবে, কবে পিতৃশ্রাদ্ধ করবেন, বিমর্ষ মনে পরের দিন থেকে সে ভাবনাচিন্তা ও প্রস্তুতি শুরু করলেন মহর্ষি। প্রকৃতির ঝড় থেমে গেলও মহর্ষির মনে ওই নদী-তীরে যে ঝড় উঠেছিল, সে ঝড় থামল না।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।।