শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


জসীমউদ্দীন ও মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়।

ঠাকুরবাড়ির মানুষজন ছিলেন অতিথিপরায়ণ। দূরের মানুষও তাঁদের কাছে সহজেই কাছের হয়ে উঠত। আগতজন আপ্যায়িত হতেন। প্রথানুসারী আপ্যায়ন, তারপরই অতিথি-বিদায়—না, এমন ঘটত না। কেউ কেউ দু-চার দিন থেকেও যেতেন। কবি জসীমউদ্দীনও থেকেছেন। রীতিমতো ঘর ভাড়া নিয়ে জোড়াসাঁকোয় কিছুকাল ছিলেন। অজীন্দ্রনাথের বন্ধু ছিলেন তিনি। অজীন্দ্রনাথ মহর্ষির পৌত্র অরুণেন্দ্রনাথের সন্তান। অবনীন্দ্রনাথের দৌহিত্র মোহনলালও ছিলেন তাঁর বন্ধু। এই জোড়াসাঁকো-বাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে জসীমউদ্দীন একটি বই লিখেছিলেন। সে বইয়ের নাম ‘ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়’। এই বইতে জসীমউদ্দীন লিখেছেন, ‘বন্ধুবর অজীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়টি কোঠাঘর ভাড়া লইয়া আমি একবার প্রায় এক বৎসর ঠাকুরবাড়িতে ছিলাম। সেই উপলক্ষে আমি তাঁদের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশিয়া যাইবার সুযোগ পাইয়াছিলাম।’
জসীমউদ্দীন থাকতেন ঘর ভাড়া নিয়ে। ভাড়া-ছাড়া, বিনি পয়সাতেও কেউ কেউ থেকেছে। এটা-সেটা করে দিয়েছে,ফাইফরমাশ খেটেছে। ঠাকুরবাড়ির কর্তাব্যক্তিরা খুশি হয়েছেন। সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনই একজনের কথা জানিয়েছেন। সুমিতেন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথের পৌত্র। অবনীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র অলকেন্দ্রনাথের সন্তান তিনি। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, ঠাকুরবাড়িতে এক সময় থাকতেন ক্ষিতীশবাবু। ক্ষিতীশবাবুর পদবী অবশ্য জানাননি সুমিতেন্দ্রনাথ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৫: রবীন্দ্রনাথ ভয় পেতেন মহর্ষিদেবকে

শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন

ক্ষিতীশবাবু ছিলেন অত্যন্ত আস্থাভাজন, কাজের মানুষ। উৎসবে, আনন্দে সব ষসময় তাঁকে পাশে পাওয়া যেত। নিজের কাজকম্ম ক’দিনের জন্য বন্ধ রেখে ক্ষিতীশবাবু অনুষ্ঠান সুস্থভাবে সম্পূর্ণ করার জন্য লেগে পড়তেন। ১১ মাঘ ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাদিবস। উৎসবের দিন। প্রতিবছরই উৎসব হত দ্বারকানাথের দালানে। দালান সাজানো হত গাঁদাফুলের মালায়। উৎসবমুখর, অথচ ভাবগম্ভীর পরিবেশ। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সমাগমে, ভাবগম্ভীর পরিবেশে শুধু গান গাওয়া হত না, রকমারি বাদ্যযন্ত্রও বাজানো হত। ইন্দিরা দেবীচৌধুরানী বাজাতেন পিয়ানো। বাজনা সহযোগে বাড়ির ছোটোরাও সংগীত পরিবেশন করত।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এই যে এত আত্মীয়স্বজনের আগমন, তাঁরা অনেকেই আসতেন গাড়িতে। কার গাড়ি কোথায় থাকবে, সেদিকে নজর রাখতে হত ক্ষিতীশবাবুকে। আপ্যায়নে যেন ঘাটতি না পড়ে, সে দিকেও নজর রাখতে হত তাঁকে। অনুষ্ঠান সুন্দর হোক, সকলে আনন্দ করুক— অন্তর থেকে চাইতেন ক্ষিতীশবাবু। তাঁকে পেয়ে ঠাকুরবাড়ির প্রবীণরা অনেকেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন। নির্ভরতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। অবনীন্দ্রনাথও নানা ব্যাপারে তাঁর উপর নির্ভর করতেন।

ক্ষিতীশবাবু কখনো অবনীন্দ্রনাথের স্নেহময় হুকুম তামিল করতেন, কখনো তাঁর স্ত্রী সুহাসিনী দেবীর ফাইফরমাশ খাটতেন। ক্ষিতীশবাবু এসব করতেন ক্লান্তিহীনভাবে। কখনও একটুও বিরক্ত হননি। অবনীন্দ্রনাথের সেবাশুশ্রূষাও করতেন। প্রায় রোজই পা মাসাজ করে দিতেন। মাসাজ করতে করতে কত গল্প! অধিকাংশ গল্পই ‘অদ্ভুতকিম্ভুত’। তা হোক, অবনীন্দ্রনাথ মন দিয়ে শুনতেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৬: যদি হই চোরকাঁটা

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮১: সুন্দরবনের পাখি—বেনে বউ

কোথা থেকে এসেছিলেন এই ক্ষিতীশবাবু, কীভাবে তাঁকে পাওয়া গেল, সে বিষয়ে সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘চমৎকার লোক ছিলেন ক্ষিতীশবাবু — আমার আবছা মনে পড়ে ক্ষিতীশবাবুকে। শুনেছি, তিনি এসেছিলেন সুদূর যশোর থেকে হয়তো আমাদের বাড়ির কোন ছেলের বিবাহসূত্রে। কোন আত্মীয় বা আত্মীয়ার দূর সম্পর্কের আত্মীয় হিসেবে। তখন আমাদের বাড়িতে ঐ রকম যশোরের আত্মীয় অনেকেই এসে থাকতেন। আমার প্রতি সন্ধ্যায় তাঁর কাছ থেকে রাংতায়মোড়া টফি একটা বরাদ্দ ছিল।’

ক্ষিতীশবাবুর মাথায় রকমারি ভাবনা খেলা করত। ভেষজ নিয়ে তাঁর ভীষণ আগ্রহ ছিল। করতেন রকমারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা। নিজের ঘরে বসে এক ধরনের মাথায় মাখার সুগন্ধি তেল তৈরি করেছিলেন। সে তেলের একটা সুন্দর নামও দিয়েছিলেন। ‘অলকানন্দা হেয়ার অয়েল’। তেল তৈরির পর মাথায় এক ব্যবসায়িক বুদ্ধি আসে। অনেকানেক তেল তৈরি করবেন, বিক্রি করবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। বোতলে ভরে বিক্রির ব্যবস্থা হয়।

সুহাসিনী দেবী, অবনীন্দ্রনাথের তুলিতে।

বোতলটি সুন্দর ও সুদৃশ্য করা হয়েছিল। বোতলে লাগানোর জন্য ছাপানো হয় লেবেল। সুন্দর করে ছাপা সে লেবেলে চুল-খোলা এক সুন্দরীর ছবিও ছিল। বোতলের পর বোতল তেল ভরে, লেবেল সেটে ঝাঁকামুটের মাথায় করে বাজারে পাঠানোরও ব্যবস্থা করেছিলেন ক্ষিতীশবাবু।
কী করে এই তেলের বিক্রি বাড়ানো যায়, ভাবতে গিয়ে ক্ষিতীশবাবুর মনে হয়, হাতের কাছে রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ রয়েছেন। তাঁরা তেল সম্পর্কে প্রশংসাসূচক কিছু লিখে দিলে হু-হু করে বিক্রি বাড়বে। এমন মনে হওয়ার পরই তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথের কাছে। জানিয়েছিলেন তাঁর আর্জি।

তেলের সার্টিফিকেট লিখে দিতে হবে শুনে অবনীন্দ্রনাথ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হেসেছিলেন। মাথার উপর আছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি লিখে দিলে তো আর কথাই নেই। বিক্রি যে বেড়ে যাবে, তা তো পরীক্ষিত সত্য। অনেকেই বায়নাক্কা করে তাঁর ‘রবিকা’কে দিয়ে সার্টিফিকেট লিখিয়ে নিয়েছেন, সেসব অবনীন্দ্রনাথের অজানা নয়। বলেছেন, ‘শোনো হে ক্ষিতীশ, আগে ও বাড়ির রবিকার কাছ থেকে একটা সার্টিফিকেট নিয়ে এসো। তারপর আমি আমারটা দেব।’
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৫: বিরোধিতায় নয়, মৈত্রীবন্ধনেই রয়েছে পারিবারিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানসূত্র

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

রবীন্দ্রনাথ সে সময় শান্তিনিকেতন থেকে জোড়াসাঁকোয় এসেছিলেন। ফলে সহজেই কবির সঙ্গে ক্ষিতীশবাবুর দেখা হয়ে যায়। অবনীন্দ্রনাথের কথায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষিতীশবাবু হাজির হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। তেল সম্পর্কে ভালো-মন্দ কিছু লিখে দিতে হবে শুনে রবীন্দ্রনাথ জানতে চেয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ কী লিখে দিয়েছেন। ক্ষিতীশবাবু সত্যি কথাটাই জানিয়েছিলেন অকপটে। বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ কী লিখে দেন, তা দেখে তিনি লিখবেন।

শুনে রবীন্দ্রনাথ এক মুহূর্তও আর সময় নেননি। ক্ষিতীশবাবুকে বলেছিলেন,’দেখি দাও একটা কাগজ।’ তখনই সার্টিফিকেট লিখে ক্ষিতীশবাবুর হাতে দিয়েছিলেন। তিনি প্রায় ছুটতে ছুটতে অবনীন্দ্রনাথের কাছে এসে হাজির হয়েছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ তখন জোড়াসাঁকোর ৫ নম্বর বাড়িতে। বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বসে ছবি আঁকছিলেন। আনন্দে উচ্ছ্বাসে ক্ষিতীশবাবু বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন। এবার আপনি দিলেই হয়। মাঘ-উৎসবের আগে আগেই ছাপিয়ে ফেলতে হবে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

অবনীন্দ্রনাথ ছবি আঁকার কাজ থামিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন, তাঁর ‘রবিকা’ কী লিখে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখে দিয়েছিলেন, ‘অলকানন্দা তৈল সামান্য মাখিলেই চুল ওঠে।’ এই বাক্যটি লিখে নিচে স্বাক্ষর করেও দিয়েছিলেন।
কবির সার্টিফিকেট দেখে অবনীন্দ্রনাথ মুচকি হেসেছিলেন। ক্ষিতীশবাবুকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন, কবির কথার দু’রকম অর্থ হয়। চুল উঠে গেলে তো ঘোরতর বিপদ!
এত গভীরভাবে ভাবেননি ক্ষিতীশবাবু। হয়তো কবিও এমনভাবে ভাবেননি। ভেবে লেখেননি। ক্ষিতীশবাবু মাথা চুলকাতে চুলকাতে অবনীন্দ্রনাথ-মন্তব্য প্রত্যাশা করেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ তখনই এই তেল সম্পর্কে প্রশংসা সূচক কিছু লিখে দিয়েছিলেন। সেই লেখার মধ্য দিয়ে অবনীন্দ্রনাথ তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৩: বীরবিক্রম ত্রিপুরায় শিক্ষা সম্প্রসারণে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট

হোক না রবীন্দ্রনাথের কথার দু’রকম অর্থ। কেউ এত জটিল করে ভাববে না। সোজাসাপটা অর্থ করবে। এমনটি ভেবে নিয়ে ক্ষিতীশবাবু রবীন্দ্রনাথের দেওয়া ওই সার্টিফিকেট ছেপে ১১ মাঘের অনুষ্ঠানে আগত মানুষজনের কাছে বিলি করেছিলেন। তেল বিক্রি চলছিল,সেই সঙ্গে হ্যান্ডবিল বিলি। হ্যান্ডবিল ছড়াতে ছড়াতে বলে উঠছিলেন, ‘একবার মাখিলেই চুল ওঠে।’

ক্ষিতীশবাবু ছিলেন সজ্জন ব্যক্তি । ভালো মানুষের দুর্গতির বোধহয় শেষ থাকে না। ক্ষিতীশবাবুর শেষ জীবনটা কেটেছে বড়ো কষ্টে। ঘরের এক কোণে রাখা থাকত ভেষজ উপাদান। সেগুলোকে খাবার ভেবে অনেক বড়ো বড়ো ইঁদুর আসত। ক্রমেই ইঁদুরের উৎপাত বাড়ছিল। একদিন ঘুমন্ত ক্ষিতীশবাবুর পায়ে এক ধেড়ে ইঁদুর কামড়ায়। ইঁদুরের কামড় খেয়ে টিটেনাসে আক্রান্ত হন তিনি। সেই টিটেনাসই মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে।

অন্য একটি কেশতৈলর বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্র-মতামত।

সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় আছে, তারপর থেকে জোড়াসাঁকোর ওই ঘরটি খালিই পড়েছিল। সুমিতেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘যেদিন দুপুরে তাঁর মৃতদেহ বাড়ির লোকজন বন্ধুবর্গ নিয়ে গেল সেদিন পশ্চিমের একতলার দক্ষিণের বারান্দার ঘরটা শূন্য হয়ে গেল, পড়ে রইল অলোকানন্দা তেলের কিছু ভেষজ, লেভেল আঁটা খালি বোতল আর ওই ঝুলন্ত দাঁড়িপাল্লা।’

সুমিতেন্দ্রনাথরা যতদিন জোড়াসাঁকোয় ছিলেন, দেখেছেন, ওই ঘরটা একরাশ শূন্যতা নিয়ে খালিই পড়েছিল।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content