শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথের তুলিতে।

যশোরের সারদাসুন্দরী যখন ঠাকুরবাড়িতে বধূ হয়ে এলেন, দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন, তখন তাঁর বয়স ছয়। কেউ বলে আট। ছয়-আট যাই হোক না কেন, তখন তিনি যে নিতান্তই বালিকা, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ক্রমে তাঁদের পনেরোটি পুত্র-কন্যার জন্ম হয়। একটি পুত্র ও একটি কন্যা অকালে মারা যায়। অল্পায়ু কন্যাটি সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। নামকরণ হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। অকাল-প্রয়াত পুত্রটির নাম পুণ্যেন্দ্রনাথ। বছর ছয়েক তখন বয়েস, পুকুরে ডুবে মারা যায় পুণ্যেন্দ্রনাথ। পনেরোজন পুত্রকন্যার মধ্যে মহর্ষি বোধহয় রবীন্দ্রনাথকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথও লক্ষ করেছিলেন, পিতামহ ‘অত্যন্ত ভালোবাসেন’ তাঁর পিতৃদেবকে। কেন এই বাড়তি ভালোবাসা, রথীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘অপেক্ষাকৃত অপরিণত বয়সে তাঁর মধ্যে অসাধারণ প্রতিভার বিকাশ দেখে তিনি নিশ্চয় গৌরব অনুভব করে থাকবেন। বোধকরি সেই কারণেই বাবার প্রতি তাঁর একটু পক্ষপাতিত্ব ছিল।’
স্নেহ অতি বিষম বস্তু, সেই স্নেহ থেকেই এই পক্ষপাত। বসবাসের জন্য জোড়াসাঁকোয় সবচেয়ে ভালো ঘর রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন মহর্ষি। প্রথম দিকে ঠিকই ছিল, পরে সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে সে ঘরে আর স্থান-সংকুলান হয়নি। কী উপায়, মহর্ষিই মুশকিল-আসান করেছেন। জোড়াসাঁকোর মধ্যেই আলাদা বাড়ি তৈরির অনুমতি দিয়েছেন মহর্ষি। বাড়ি তৈরি তো কম হাঙ্গামার নয়, অনেক অর্থেরও প্রয়োজন। সে অর্থ জুগিয়েছিলেন মহর্ষি নিজে। তৈরি হয়েছে কবির নিজস্ব বাড়ি। লাল ইটের তৈরি সে বাড়ি সবার মুখে মুখে ‘লালবাড়ি’হয়ে যায়। বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন নীতীন্দ্রনাথ। স্থাপত্যবিদ্যা তাঁর অধিগত ছিল। রবীন্দ্রনাথ বাড়ির প্ল্যান-পরিকল্পনার দায়িত্ব তাঁকেই দিয়েছিলেন। তাড়াহুড়োতে এমন এক কাণ্ড ঘটে গিয়েছিল, যা আপাতভাবে অবিশ্বাস্য, শোনার পর হো-হো করে সকলেই হাসবেন। রবীন্দ্রনাথের বাড়ি তো হল। গৃহপ্রবেশের দিন সকলেই হতবাক, একতলা থেকে দোতলায় যে যাওয়া হবে, তার সিঁড়ি কোথায়! রথীন্দ্রনাথের লেখায় আছে কৌতুকবহ সে ঘটনার বিবরণ।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৯: সুন্দরবনের পাখি: টুনটুনি

শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন

রবীন্দ্রনাথের গান শুনে মহর্ষি মুগ্ধ হয়েছিলেন। আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন, চোখের জল বাঁধ মানেনি। কেঁদেও ফেলেছিলেন। কবিতাগুলি ছিল ‘ভক্তিরসাশ্রিত’। রবীন্দ্রনাথকে সদ্য লেখা কবিতা পড়ে শোনাতে মহর্ষিই বলেছিলেন। তিনি জানতেন ‘রবি’র কাব্যচর্চার কথা। একের পরে এক কবিতা পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ, মহর্ষি নিবিষ্ট হয়ে শুনেছেন। একটি-দুটি কবিতা নয়, অনেক কবিতা। পিতৃদেবকে কবিতা শোনানোর পর রবীন্দ্রনাথ গান গেয়েছেন। শোনানো কবিতারই সুরারোপ। সে গান শুনে মহর্ষির চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়েছে। কতখানি আবেগবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন, সহজেই তা অনুমেয়। শেষে পুত্রকে পরামর্শ দিয়েছেন, পঠিত কবিতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের। বললেই তো আর বই ছাপা যায় না। তার জন্য যথেষ্ট অর্থ চাই। মহর্ষি তখনই পুত্রের হাতে বই-প্রকাশের অর্থ তুলে দিয়েছিলেন। সে সব কবিতা নিয়ে ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। ‘সঙ্ অফারিংস’ নামে যে বইয়ের জন্য রবীন্দ্রনাথের নোবেল-লাভ, সে বইতে ‘নৈবেদ্য’-এর অনেকগুলি কবিতাই ছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথের তুলিতে।

রবীন্দ্রনাথের উপর মহর্ষি একটু বেশি রকমই নির্ভর করতেন। তিনি তাঁর কবিস্বভাবের কথা জানতেন, স্বভাব-ঔদাসীন্যর কথা জানতেন। তারপরও রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন জমিদারি দেখভালের দায়িত্ব। জমিদারি দেখাশোনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কত বড়ো উপকার হয়েছিল, তা আমাদের অজানা নয়। শিলাইদহে সাধারণ মানুষের সান্নিধ্যে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন। প্রকৃতিকে চিনেছিলেন, দেখেছিলেন মানুষ কত দুঃখে আছে। সে অভিজ্ঞতা তাঁর লেখার ক্ষেত্রে, বিশেষত গল্প-লেখার ক্ষেত্রে বড় সহায়ক হয়ে উঠেছিল।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৩: বীরবিক্রম ত্রিপুরায় শিক্ষা সম্প্রসারণে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৪: আশ্রমের আনন্দময় পিকনিক

রবীন্দ্রনাথ নিজেও স্বীকার করেছেন সে সময় লেখা গল্পগুলি ‘নেহাত বাস্তব জিনিস। যা দেখেছি, তাই বলেছি।’ জানিয়েছেন কবি। ‘সাধনা-র যুগে প্রধানত শিলাইদহেই কাটিয়েছি। কলকাতা থেকে বলুর ফরমাশ আসত, গল্প চাই। গ্রাম্যজীবনের পথ-চলতি কুড়িয়ে পাওয়া অভিজ্ঞতার সঞ্চয় সাজিয়ে লিখেছি গল্প।’ প্রসঙ্গত বলে নেওয়া ভালো, ‘সাধনা’ পত্রিকা ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত হত। ‘বলু’ রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ। বলেন্দ্রনাথের দাবি মেটাতে শিলাইদহ-পর্বে রবীন্দ্রনাথ অনেক গল্পই লিখেছেন, যা অভিজ্ঞতা-নির্ভর। মহর্ষি জমিদারি দেখভালের দায়িত্বভার না দিলে, রবীন্দ্রসাহিত্যে ওই সব ‘বাস্তব জিনিস’ আসত, নাকি ঘাটতি রয়ে যেত, সে প্রশ্ন রয়েই যায়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৫: বিরোধিতায় নয়, মৈত্রীবন্ধনেই রয়েছে পারিবারিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানসূত্র

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়ায় বাড়ির লোকজন অবাক হয়েছিল। কথা বলাবলি, কথা চালাচালি শুরু হয়েছিল। কেউ কেউ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল, কনিষ্ঠপুত্রের প্রতি মহর্ষির এটা পক্ষপাতিত্ব। কবিস্বভাব নিয়ে আর যাই হোক, জমিদারি সামলানো সম্ভব নয়। তাদের ধারণা কতখানি ভুল, তা অচিরেই প্রমাণিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কালে জমিদারির সর্বতোভাবে উন্নতি হয়, বোঝা যায় মহর্ষি কতখানি দূরদর্শী ছিলেন। বিচক্ষণ মানুষ তিনি, সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি। মহর্ষি হয়তো জানতেন, শিলাইদহ-অভিজ্ঞতা রবীন্দ্রনাথের লেখকজীবনকে সমৃদ্ধ করবে। জোড়াসাঁকোর বিলাসবৈভাবের বাইরের সে জীবন রবীন্দ্রনাথকে নতুনতর পথের সন্ধান দেবে, বাঁকের মুখে দাঁড় করাবে।

পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পিতা রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথ অতীব দক্ষতায় জমিদারি চালাতেন। প্রজাদের দিকে সব সময় ছিল সযত্ন দৃষ্টি। প্রথমদিকে জমিদারি চালানোর জন্য মহর্ষির কাছ থেকে দুশো টাকা করে মাসোহারা পেতেন। এই টাকাতে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের ঘর-সংসার চলত। তিনি নিজে অবশ্য খরচা করতেন না। মাসোহারার টাকা তুলে দিতেন স্ত্রী মৃণালিনীর হাতে। তিনি কখনোই বেহিসেবি ছিলেন না। ভালোভাবে সংসার চালিয়েও কিছু টাকা বাঁচাতেন। সেই টাকা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনীয় বইপত্তর কিনতেন। পরে এই মাসোহারার পরিমাণ বেড়েছিল। মহর্ষি একশো টাকা বাড়িয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ মাসোহারা পেতেন তিনশো টাকা। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের যতই ধর্মবোধ জাগ্রত থাকুক না কেন, যথেষ্ট বৈষয়িকও ছিলেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৮: প্রতিভা দেবী—ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট

অবনীন্দ্রনাথের ‘ঘরোয়া’ বইতে আছে,’ কর্তা দাদামহাশয় খুব হিসেবী লোক ছিলেন। মহর্ষিদেব হয়েছেন বলে বিষয়-সম্পত্তি দেখবেন না, তা নয়। তিনি শেষ পর্যন্ত নিজে সব হিসেব-নিকেশ নিতেন। রোজ তাঁকে সব রকমের হিসেব দেওয়া হত।’ রবীন্দ্রনাথকেও জমিদারির আয়-ব্যয়ের হিসেব বুঝিয়ে দিতে হত। রথীন্দ্রনাথ তখন ছোটো, তবু সেসব মনে আছে তাঁর। জানিয়েছেন পিতামহ হিসাবের ব্যাপারে কতখানি ‘কঠোর নিয়মনিষ্ঠ’ ছিলেন। কবিপুত্রের লেখা থেকে জানা যায়, মাসের দ্বিতীয় দিন রবীন্দ্রনাথ হিসেবেব খাতাপত্তর নিয়ে মহর্ষিদেবের সামনে উপস্থিত হতেন। শোনাতেন গত মাসের হিসেবের ফিরিস্তি, আনুপার্বিক বিবরণ। সেসব মহর্ষি মন দিয়ে শুনতেন। হিসেবে কোনও ভুলত্রুটি থাকলে তাঁর নজর এড়িয়ে যেত না। সঙ্গে সঙ্গে ধরতেন, কৈফিয়ৎ চাইতেন। মহর্ষির জেরার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ‘দস্তুরমতো গলদঘর্ম’ হতেন। মাসের দ্বিতীয় দিন তিনি নিয়ম করে জমাখরচের হিসাব দিতেন, আয়-ব্যয়ের হিসেব দিতেন।

রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুকুলচন্দ্র দের তুলিতে।

রথীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, এই দিনটাকে রবীন্দ্রনাথ খুব ভয় পেতেন। পিতৃদেবের সজাগ দৃষ্টি, এড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায়ই ছিল না। রথীন্দ্রনাথ ভারি মজা করে সেই পরিস্থিতির কথা বলেছেন, ‘স্কুলের ছেলেরা যেমন পরীক্ষা দিতে যায়, বাবা যেন তেমনি করে যেতেন মহর্ষির কাছে হিসাব দাখিল করতে। আমরা সব ছেলেমানুষেরা অবাক হয়ে ভাবতাম, আমাদের বাবা তাঁর বাবাকে এত ভয় পান কেন।’
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।/strong>

Skip to content