দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শীতের সঙ্গে পিকনিক ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। শান্তিনিকেতনেও পিকনিক হত। নির্মল আনন্দময় পিকনিক। আশ্রম-বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে বানানো দূরত্ব ছিল না। বড় আন্তরিক, মাধুর্যময় সম্পর্ক। অবসরে ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকরাও মেতে উঠতেন নাটকে, সংগীতে। পড়ানোর সময় পড়া না পারলে, অমনোযোগী হলেও মাস্টারমশায়রা মারধর করতেন না। ‘বাবা-বাছা’ বলে অমনোযোগী ছাত্রকেও বশে আনতেন, মনোযোগী করে তুলতেন। অমনোযোগী ছাত্রকে হয়তো ভর্ৎসনা করলেন, তা ক্ষণিকের, খানিক পরেই তাকে কাছে টেনে নিতেন। স্নেহের স্পর্শে তারও বোধোদয় হত। এমন বকাঝকা আর মারধর অবশ্য কদাচিৎ ঘটত। আশ্রমে সারাক্ষণই আনন্দ। শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন পাঠও আনন্দময় হয়ে উঠত। শান্তিনিকেতন-ব্রহ্মচর্যাশ্রমে শিক্ষকতা করতেন জগদানন্দ রায়। তাঁকে বিদেশ থেকে রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে লিখেছিলেন, আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্ররা একটা বড় জিনিস লাভ করেছে, সেটা ক্লাসের জিনিস নয়— সেটা হচ্ছে বিশ্বের মধ্যে আনন্দ—প্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তার যোগ।’ চারদিকে ছড়ানো রয়েছে আনন্দ। ওই চিঠিতে সে কথাই বিশদে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চিঠিতে আছে,’আমাদের ছেলেরা বৃষ্টিতে ছুটে বেড়ায়, জ্যোৎস্নারাত্রিতে আনন্দ ভোগ করে, তারা রৌদ্রকে ডরায় না। তারা গাছের চড়ে বসে পড়া
আশ্রমে আনন্দ-আহরণের অফুরান আয়োজন ছিল। নৃত্যগীতি পরিবেশন থেকে নাট্যাভিনয়, এমনকি ফুটবলও। ছাত্র ও শিক্ষকের সম্মিলিত উপস্থাপন, ফলে আনন্দও হত দেদার। আনন্দ হত পিকনিকেও। আনন্দের জন্যেই তো সেই আয়োজন। শীতকালেই পিকনিক হত বেশি। তবে মনে যদি আনন্দ থাকে, গরমেও হতে অসুবিধা কোথায়! আশ্রমে গ্রীষ্মদিনেও পিকনিক হত। পিকনিক করার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ ছিল দিনেন্দ্রনাথের। ছাত্রদের সংগীত শিক্ষার ভার ছিল তাঁর ওপর। ফলে তাঁর সঙ্গে ছাত্রদের বড়ো সহজ সম্পর্ক ছিল। পিকনিক মানেই দিনেন্দ্রনাথ হাজির, শুধু উপস্থিত থাকতেন না, প্রায়শই পিকনিক হত তাঁরই পরিকল্পনায়, ব্যবস্থাপনায়।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৩: দেবেন্দ্রনাথ হয়েছিলেন ‘কল্পতরু’
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৯: সুন্দরবনের পাখি: টুনটুনি
শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের শিক্ষক ছিলেন তেজেশচন্দ্র সেন। মূলত ছোটোদের পড়াতেন। প্রায় সব বিষয়েরই ক্লাস নিতেন। প্রকৃতি-পর্যবেক্ষণে আগ্রহ ছিল সব থেকে বেশি। দিনেন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর সহমর্মী সহকর্মীকে নিয়ে একটি স্মৃতিকথা লিখেছিলেন তেজেশচন্দ্র। সে লেখায় আছে, ‘দিনুবাবুকে না হলে আমাদের পিকনিকও জমত না। পিকনিকের নামে তাঁর উৎসাহও ছিল অসম্ভব রকমের। ছেলেদের পিকনিক, মেয়েদের পিকনিক, শিক্ষকমহাশয়দের পিকনিক, ছোটবড়ো সকল পিকনিকেই তাঁর ডাক পড়ত।’
গান গাইছেন দিনেন্দ্রনাথ। শুনছেন রবীন্দ্রনাথ ও অতুলপ্রসাদ।
দিনেন্দ্রনাথের ছিল ভারী চেহারা। তাঁর সেই বিশাল বপু নিয়ে আশ্রমে মজা-তামাশাও হত। তেজেশচন্দ্রের লেখা থেকে জানা যায়, পিকনিক মানেই সেখানে দিনেন্দ্রনাথ উপস্থিত থাকবেন। শেষের দিকে ওই বিশাল চেহারার জন্য তিনি খুব হাঁটাহাঁটি করতে পারতেন না। পিকনিকে যেতেন মোটরগাড়িতে। পিকনিকের আয়োজন হয়তো-বা এমন জায়গায়, যে পথে গাড়িতে যাওয়া দুষ্কর, তেমন হলে তাঁর জন্য গোরুর গাড়ির ব্যবস্থা রাখা হত। তেজেশচন্দ্র যে পিকনিকের গল্প শুনিয়েছেন, তা ঠিক শীত-পিকনিক নয়। শীত তখন বিদায় নিলেও আবহাওয়া ছিল বড়ো মনোরম। ফাল্গুন মাস, বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। দিনে নয়, পিকনিকের আয়োজন হয়েছিল রাতে। রাতটি ছিল ভারি সুন্দর, জোৎস্নালোকিত।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৪: পরবর্তী পদক্ষেপ
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৬: ঠাকুরবাড়ির লক্ষ্মী মেয়ে
আশ্রমে পিকনিক সাধারণত দিনেই হত। রাতে হবে শুনে মেয়েরা খুব খুশি হয়েছিল। সানন্দে রান্নার দায়িত্ব তারাই নিয়েছিল। রকমারি ব্যঞ্জন। জমিয়ে খাওয়াদাওয়া, খাওয়া-দাওয়ার পর আবার জ্যোৎস্না-আলোয় দল বেঁধে সবাই ফিরে আসবে, এমনই কথা ছিল। কোথায় পিকনিক হবে, নানা মুনির নানা মত, শেষে সিদ্ধান্ত পৌঁছনো গেল, পিকনিক হবে আশ্রমের পশ্চিম দিকের সাঁওতালপাড়ায়।
নির্দিষ্ট দিনে সন্ধের পর দলবেঁধে সবাই চলল পিকনিকে। গরুর গাড়িতে পিকনিকের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। খানিক দূর এগোনোর পরই বিস্তৃত রেললাইন। নজরে পড়ল, পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। দিগন্তপ্রসারিত মাঠ। সে মাঠ চাঁদের আলোয় ভরে গেছে। ফাঁকা মাঠ। একটাও গাছ নেই। বাড়িঘর নেই। দূরে তালগাছের সারি, আরও দূরে সাঁওতালদের বসবাস। জ্যোৎস্না-আলোয় অনেক দূরের দৃশ্যও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
নির্দিষ্ট দিনে সন্ধের পর দলবেঁধে সবাই চলল পিকনিকে। গরুর গাড়িতে পিকনিকের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। খানিক দূর এগোনোর পরই বিস্তৃত রেললাইন। নজরে পড়ল, পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। দিগন্তপ্রসারিত মাঠ। সে মাঠ চাঁদের আলোয় ভরে গেছে। ফাঁকা মাঠ। একটাও গাছ নেই। বাড়িঘর নেই। দূরে তালগাছের সারি, আরও দূরে সাঁওতালদের বসবাস। জ্যোৎস্না-আলোয় অনেক দূরের দৃশ্যও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
দিনেন্দ্রনাথ পড়াচ্ছেন, আশ্রম-বিদ্যালয়ে।
খোলা মাঠে মুক্ত আকাশের নিচে একটা জায়গা বেছে নিয়ে সকলে বসে পড়ে। চারদিকে আলোর প্লাবন, চাঁদের আলোর মাখামাখি। দক্ষিণে শালবন। শালগাছ ফুলে ফুলে ভরে গেছে। বাতাসে সে ফুলের গন্ধ। ভারি সুন্দর, মনোরম এক নৈসর্গিক পরিবেশ। পিকনিকে এসে এমন নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে সকলের মনেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। সকলের মনেই পুলক জাগে। রাঁধা হল, খাওয়া হল, দু-চার কলি গান গাওয়া হল। তারপরও ইচ্ছে করে না আশ্রমে ফিরে যেতে। পিকনিকে আসা সকলেরই মনে হয়, এই জ্যোৎস্নালোকে রাত্রিযাপন করলে কেমন হয়! জোৎস্না মেখে গানে গানে মেতে থাকা, সেসব ভেবে মনে মনে তারা শিহরিত হয়। ভাবনা বাস্তবায়িত করার ভিতর থেকে তাগিদ আসে।
আরও পড়ুন:
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৯: আসছে আমার পাগলা ঘোড়া
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৭: লোকে যারে বড় বলে
ভাবনা আর ভাবনার পর্যায়ে থাকে না, তৎক্ষণাৎ সে ব্যবস্থা হয়। কয়েকজন চলে যায় আশ্রমে, কম্বল-শতরঞ্চি আনতে। খানিক পরে তারা সেসব নিয়ে ফিরেও আসে। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা-রাতে খোলা মাঠে দিনেন্দ্রনাথ এসরাজ বাজিয়ে গান ধরেন। গাইতে থাকেন, ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল।’ পরপর গাইলেন আরও কয়েকটি। এরপর একটানা ‘মায়ার খেলা’র গান। পরপর অনেকগুলো গান, সব গানই মায়ার খেলা থেকে। ‘এ গানটা ধরুন দিনুদাদা’, ‘ও গানটা ধরুন দিনুদাদা’ অনুরোধ-ফরমাশ আসা সব গানই গাইলেন দিনেন্দ্রনাথ। কাউকেই নিরাশ করলেন না। ক্লান্তিহীন তিনি। তাঁর গান যখন থামে, তখন পূর্ণিমার চাঁদ মাথার উপর থেকে পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সমস্ত রাত গান গেয়ে ভোরের দিকে তিনি ওইখানে পাতা শতরঞ্জিতেই শুয়ে পড়েছিলেন।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪১: রবীন্দ্রনাথ ও ব্রজেন্দ্র কিশোর
পিকনিক মানে তো বনভোজন, সেই বনভোজন যে সব সময় বনে হবে, তা নয়, বাড়িতেও হতে পারে। দিনেন্দ্রনাথের বাড়িতে পিকনিক লেগেই থাকত। তেজেশচন্দ্র সেনের লেখা থেকে জানা যায়, তাঁর স্ত্রী কমলার শিশুপ্রীতির কথা। নিঃসন্তান এই দম্পতি আশ্রম-বালকদের আগলে রাখতেন। স্নেহ-ভালোবাসায় বাড়ি থেকে দূরে থাকা ওই বালকদের মন ভরিয়ে তুলেছিলেন তাঁরা। ছোটোদের হই হই করে খাওয়াতেন, কমলা দেবী ও দিনেন্দ্রনাথ নিজের হাতে পরিবেশন করতেন। তেজেশচন্দ্রের লেখায় আছে, অন্তত ছোটোদের খাওয়াবার ব্যাপারে গৃহ-সহায়কদের তাঁরা দু’জনেই বিশ্বাস করতেন না। ভাবতেন, কী জানি যদি যত্নের অভাব হয়, ঠিক মতো সব জিনিস সকলে যদি না পায়! তৃপ্তি করে,আনন্দ করে ছোটোরা খাক, আর কিছু নয়, স্বামী-স্ত্রী দু’জনে এইটুকুই চাইতেন।
দিনেন্দ্রনাথ ও কমলা।
দিনেন্দ্রনাথ আশ্রমের ছোটোদের কাছে ডেকে প্রায়ই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কী খেতে তোদের ইচ্ছে করে, বল।’ তখনই সব ছেলেরা একসঙ্গে বলে উঠত, ‘দিনুদা, লুচি-পাঁঠা।’
ছেলেদের সঙ্গে হইহল্লা- মজলিশি গল্প, সেই সঙ্গে পাঁঠার ঝোল দিয়ে ফুলকো লুচি। আশ্রম-বালকরা হইহই করে প্রায়ই ভিড় করত দিনেন্দ্রনাথের বাড়িতে। ভোজনরসিক দিনেন্দ্রনাথ খেতে ভালোবাসতেন। খাওয়াতে ভালোবাসতেন। সবচেয়ে বেশি খাওয়াতে ভালোবাসতেন ছোটদের। দিনেন্দ্রনাথের বাড়িতে লুচি-পাঁঠা সহযোগে এইভাবে মাঝেমধ্যেই পিকনিক জমে উঠত।
ছেলেদের সঙ্গে হইহল্লা- মজলিশি গল্প, সেই সঙ্গে পাঁঠার ঝোল দিয়ে ফুলকো লুচি। আশ্রম-বালকরা হইহই করে প্রায়ই ভিড় করত দিনেন্দ্রনাথের বাড়িতে। ভোজনরসিক দিনেন্দ্রনাথ খেতে ভালোবাসতেন। খাওয়াতে ভালোবাসতেন। সবচেয়ে বেশি খাওয়াতে ভালোবাসতেন ছোটদের। দিনেন্দ্রনাথের বাড়িতে লুচি-পাঁঠা সহযোগে এইভাবে মাঝেমধ্যেই পিকনিক জমে উঠত।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।