বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তখনও ‘মহর্ষি’ হয়ে ওঠেননি। তাঁর ব্রাহ্ম হয়ে ওঠা,ধর্মসংক্রান্ত ভাবনা, সেই ভাবনার বাস্তব রূপায়ণ, সবই তখন অনেক দূরবর্তী। তেমন এক জীবনকে আঁকড়ে ধরার কল্পনা দেবেন্দ্রনাথও স্বয়ং ভাবতে পারেননি। তিনি তখন বিলাসব্যসনে ব্যস্ত। তাঁর বৈভবের জীবন। প্রিন্স দ্বারকানাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র তিনি। অনেকাংশে পিতারই অনুসরণকারী। দেবেন্দ্রনাথের আত্মজীবনীতে আছে অকপট স্বীকারোক্তি। রেখেঢেকে নয়, স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন, ‘আমি বিলাসের আমোদে ডুবিয়া ছিলাম।’ কলকাতা-শহরের দেবেন্দ্রনাথ তখন মান্যগন্য ‘বাবু’। জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসানে এমন সাজগোজ করতেন, বেশভূষা পরতেন, যা দেখে বিস্ময়ের শেষ থাকত না। শহরের অনেক বড়োলোক তাঁকে অনুসরণ করত। মহর্ষিদেবের জীবনী রচনা করেছিলেন আশ্রম-শিক্ষক অজিতকুমার চক্রবর্তী। সে বইতে আছে, সেকালে ধনী পুরুষরাও ‘মোটা মোটা গহনা’ পরে বের হতেন। গয়না দু’চারটে নয়, পরতেন অনেক অনেক। সে প্রসঙ্গে মহর্ষির জীবনীকার লিখেছেন, ‘কটি হইতে কণ্ঠ পর্যন্ত গয়নার ভারে কণ্ঠরোধ হইবার উপক্রম হইত আরকি!’ দেবেন্দ্রনাথও সাজসজ্জা করতেন। সেই সাজসজ্জার মধ্যে ‘সৌন্দর্যবোধ’ যেমন ছিল, তেমনই ছিল ‘রুচির সূক্ষ্মতা’।
একবার এক ধনী পরিবারের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে এমন এক পোশাক তৈরি করিয়ে পরেছিলেন তিনি, যা ধনীসমাজের স্থূলরুচিকে কষে ঘা দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। অজিতকুমার চক্রবর্তীর লেখা মহর্ষি-জীবনীতে আছে,’…এক সাদাসিধা ধরনের সাটিনের লম্বা জোব্বা — তাহাতে কেবল সাচ্চা রুপালি জরির কাজ করা। আর ইচ্ছা করিয়া গায়ে না পরিয়া তাঁহার জুতায় বসাইলেন যত রাজ্যের মণিমুক্তাজহরৎ। ওই জিনিসগুলি পায়ে করিয়া সেই নিমন্ত্রণ-সভায় গিয়া তিনি হাজির হইলেন, যেন স্থূলরুচিবিশিষ্ট ধনী লোকগুলি তাঁহার পায়ের দিকে চাহিয়া দেখে!’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০২: দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৩: কালাদেওর কবলে

ভোগবিলাসের আবর্তে দেবেন্দ্রনাথ ঘুরলেও কখনও রুচি বিসর্জন দেননি। যতই অর্থবান হোক না কেন, রুচিহীন মানুষজনকে কৌশলে তিনি ধিক্কারও জানিয়েছেন। তিনি বাবুয়ানায় মজে ছিলেন সত্য, আবার সেই জায়গা থেকে সহসা সরেও দাঁড়িয়েছিলেন। তখন তাঁর আঠেরো বছর বয়স, এমন এক ঘটনা ঘটে, যে ঘটনার মধ্য দিয়ে জীবন বাঁক নেয়। শুরু হয় ভিন্নতর পথে পদচারণা। বিলাসমগ্ন দেবেন্দ্রনাথের জীবনধারায় এই পরিবর্তনের বড়ো প্রয়োজন ছিল। তা না হলে গড্ডলিকা প্রবাহে দেবেন্দ্রনাথ হারিয়ে যেতেন, তাঁর আর ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ’ হয়ে ওঠা হত না।

প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।

দেবেন্দ্রনাথের এই পরিবর্তনের আড়ালে রয়েছে একটি মৃত্যু। দিদিমার মৃত্যু। প্রিন্স দ্বারকানাথ তখন পর্যটনে, এলাহাবাদে। দিদিমার অসুস্থতা তীব্র আকার ধারণ করে। বৈদ্য আসেন। পরীক্ষা করে জানান, রোগীকে আর গৃহে রাখা যাবে না। তাঁকে গঙ্গাতীরে নিয়ে যাওয়া হয়। দিদিমা অলকাসুন্দরী চাননি তাঁকে গঙ্গাতীরে নিয়ে যাওয়া হোক। প্রায় জোর করেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এই জোরাজুরি পীড়াপীড়িতে তিনি বিরক্তই হয়েছিলেন। বলেছিলেন, অনেক কষ্ট দেবেন, তাড়াতাড়ি মরবেন না।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৮: সুন্দরবনের পাখি—শামুকখোল

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৫: ‘ছেলেদের জন্য আমার কোনও নিয়মকানুন থাকে না’

দেবেন্দ্রনাথ তাঁর দিদিমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিনিও রয়ে গিয়েছিলেন নিমতলার ঘাটে। সেদিন ছিল পূর্ণিমা রাত। চারপাশ জ্যোৎস্নায় প্লাবিত । তারই মাঝে এক মুমূর্ষু মহিলার কানের কাছে চলেছে কীর্তনগান। এসব কিছুর সাক্ষী দেবেন্দ্রনাথ। অদূরেই তিনি একটা চাঁচের উপর বসেছিলেন। কঠিন-কঠোর সে দৃশ্য। দেখতে দেখতে দেবেন্দ্রনাথের মনে ‘এক আশ্চর্য উদাসভাব উপস্থিত’ হয়েছিল। সেই সংকটকালের বর্ণনা দিয়ে অভূতপূর্ব পরিবর্তনের কথা আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন দেবেন্দ্রনাথ, ‘এই অবসরে হঠাৎ আমার মনে এক আশ্চর্য উদাসভাব উপস্থিত হইল। আমি যেন আর পূর্বের মানুষ নই। ঐশ্বর্যের উপর একেবারে বিরাগ জন্মিল।… সেই রাত্রিতে ঔদাস্যের সহিত আনন্দ পাইয়াছিলাম, এখন সেই আনন্দের অভাবে ঘন বিষাদ আসিয়া আমার মনকে আচ্ছন্ন করিল। কিরূপে আবার সেই আনন্দ পাইব, তাহার জন্য মনে বড়ই ব্যাকুলতা জন্মিল।’

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যুবক বয়সে।

দিদিমা অলকাসুন্দরীর মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ মন দিয়েছিলেন জ্ঞানচর্চায়। জ্ঞানের আলোকে নিজেকে চিনেছিলেন, প্রচলিত সংস্কারের অন্তঃসারশূন্যতাও তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়েছিল। অলকাসুন্দরীর মৃত্যুর পর যে বিষণ্ণতা দেবেন্দ্রনাথকে গ্রাস করেছিল, তা এই জ্ঞানের আলোকে সাফ হয়েছিল। এই বিষণ্ণতার কালেই দেবেন্দ্রনাথের ‘কল্পতরু’ হয়েছিল, কল্পতরুর হওয়ার কথা দেবেন্দ্রনাথ নিজেই জানিয়েছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। লিখেছেন, ‘দিদিমার মৃত্যুর পর একদিন আমার বৈঠকখানায় বসিয়া আমি সকলকে বলিলাম যে আজ আমি কল্পতরু হইলাম। আমার নিকটে আমার দিবার উপযুক্ত যে যাহা কিছু চাইবে তাহাকে আমি তাহাই দিব।’
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৯: আসছে আমার পাগলা ঘোড়া

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬৯: এক লড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লগা

একজন ছাড়া সেদিন কেউই কিছু চাননি। চেয়েছিলেন রাধানাথ ঠাকুরের পুত্র ব্রজেন্দ্রনাথ। আত্মকথায় ব্রজেন্দ্রনাথের পরিচয়-প্রসঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের লিখেছেন, ‘আমার জ্যেষ্ঠতাতপুত্র’ ব্রজেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমাকে ঐ দুইটা বড় আয়না দিন, ঐ ছবিগুলা দিন, ঐ জরির পোশাক দিন।’ দেবেন্দ্রনাথ কালবিলম্ব করেননি। তখনই সব দিয়েছিলেন। সেদিন এত জিনিস নিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। পরদিন মুটে এনে ব্রজেন্দ্রনাথ বৈঠকখানা থেকে সেসব তো নিয়েইছিলেন, সঙ্গে আরও বাড়তি কিছু নিয়েছিলেন। ভালো ভালো ছবি, গৃহসজ্জার জিনিস, যা যা ছিল, সবই তিনি মুটের মাথায় করে নিয়ে গিয়েছিলেন।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

দেবেন্দ্রনাথের থেকে এক বছরের ছোটো ছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ। দু-জনের মধ্যে সৌহার্দ্যময় নৈকট্য ছিল। পরে এই নৈকট্য আরও গাঢ় হয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথের পরম অনুগামী হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’র সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। প্রথম দিকে ব্রজেন্দ্রনাথ এই সভার সম্পাদক ছিলেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৫: ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এবং চলচ্চিত্র

দেবেন্দ্রনাথের কল্পতরু হওয়া, ব্রজেন্দ্রনাথের বৈঠকখানা-সামগ্রী চাওয়া, মুটে এনে পরের দিন নিয়ে যাওয়া — এসব বিবরণ স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথের রচনা থেকে গৃহীত। অবনীন্দ্রনাথও এই ঘটনাটির কথা জানিয়েছেন তাঁর স্মৃতিকথায়। খুব সঙ্গত কারণেই তিনি ঘটনাটির প্রত্যক্ষ সাক্ষী নন, পরের মুখ থেকে শুনেছিলেন মাত্র। এই শোনাটাও পরবর্তীকালের। সময়ের ব্যবধানে ঘটনাটি কিঞ্চিত পরিবর্তিত হয়ে বর্ণিত হয়েছে অবনীন্দ্রনাথের কাছে। দেবেন্দ্রনাথের কল্পতরু হওয়ার পর যা যা ঘটেছিল, তা বলতে গিয়ে বেশ ‘অতিরঞ্জন’ও ঘটেছে। তা হোক, মহর্ষির ‘কল্পতরু’ হওয়ার সত্যতা নিয়ে আমাদের মনে আর প্রশ্ন থাকে না।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, জীবনের শেষ-প্রান্তে।

অবনীন্দ্রনাথকে এসব বলেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন দ্বারকানাথের ভাগিনেয়। খুব মজলিশি মানুষ । অবনীন্দ্রনাথের ‘ঘরোয়া’-য় তাঁর কথা আছে। অনেক মজার মজার কথা বলতেন। সরসতায় উজ্জ্বল। ‘কী কবিতা লেখে রবিবাবু’, ‘রবিবাবু আবার কী গান গায়’ — এসবও তিনি বলতে পারতেন! হয়তো মজা করেই বলতেন, এমনতরো মজা করাও সহজ কাজ ছিল না। ‘ঘরোয়া’য় কী আছে, অবনীন্দ্রনাথকে তিনি কী বলেছিলেন, তা একটু উদ্ধৃত করা যেতে পারে, ‘একবার কর্তামশায়ের শখ হল কল্পতরু হব, রব পড়ে গেল বাড়িতে, কর্তাদাদামশায় কল্পতরু হবেন। কল্পতরু আবার কী। কী ব্যাপার। সারা বাড়ির লোক এসে তাঁর সামনে জড়ো হল। উনি বললেন, ঘর থেকে যার যা ইচ্ছে নিয়ে যাও। কেউ নিলে ঘড়ি, কেউ নিলে আয়না, কেউ নিলে টেবিল — যে যা পারলে নিয়ে যেতে লাগল। দেখতে দেখতে ঘর খালি হয়ে গেল।’

কে কী নিয়ে গিয়েছিলেন, তা বিবেচ্য নয়, আসলে বিষণ্ণতা দেবেন্দ্রনাথকে গ্রাস করেছিল। বিষণ্ণতার বিস্তৃতি সম্পর্কে আমরা একটা আঁচ করতে পারি। দেবেন্দ্রনাথের মধ্যে বিষয়বৈরাগ্য জেগেছিল। এই জাগতিক উদাসীনতা বুঝিয়ে দেয়, দিদিমা অলকাসুন্দরীর মৃত্যুর পর ভেতরে ভেতরে দেবেন্দ্রনাথ কতখানি বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content