রবীন্দ্রনাথ ও শ্রীরামকৃষ্ণ।
ওরে ভয় চঞ্চল প্রাণ,
জীবনে মরণে সবে
রয়েছি তাঁহারি দ্বারে।
অভয় শঙ্খ বাজে
নিখিল অম্বরে সুগম্ভীর,
দিশি দিশি দিবানিশি
সুখে শোকে লোক-লোকান্তরে।”
আর ভয় কারে
আনন্দে চলেছি
ভবপারাবার পারে।
মধুর শীতল ছায়
শোক তাপ দূরে যায়,
করুণাকিরণ তাঁর
অরুনবিকাশে।
জীবনে মরণে আর
কভু না ছারিব তাঁরে।”
(রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্ররচনাবলী, প্রকাশক: পশ্চিমবঙ্গ সরকার, প্রকাশ: ১৯৯২, চতুর্দশ খণ্ড, পৃ: ৭৪১)
এই নষ্ট, ভ্রষ্ট, গৌরবহীন, অকিঞ্চিতকর জীবন থেকে ত্রাণ পেতে হলে কি করতে হবে?
রবীন্দ্রনাথ: “একদিনও ভুলব না। প্রতিদিনই, তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতেই হবে, প্রতিদিন কেবল সংসারকেই প্রশ্রয় দিয়ে তাকেই কেবল বুকের সমস্ত রক্ত খাইয়ে প্রবল করে তুলে নিজেকে এমন অসহায়ভাবে একান্তই তার হাতে আপাদমস্তক সমর্পণ করে দেব না। দিনের মধ্যে অন্তত একবার এই কথাটা প্রত্যহই বলে যেতে হবে—’তুমি সংসারের চেয়ে বড়—তুমি সকলের চেয়ে বড়’।
(রবীন্দ্রনাথ, ঐ, পৃ: ৭৪১)
যত মত, তত পথ, পর্ব-৫: ঈশ্বরের আনন্দ ও সংসার—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১২: জয়রামবাটিতে প্রত্যাবর্তন
ঈশ্বরে মন রেখে সংসার ধর্ম
রবীন্দ্রনাথ: “এইটে ‘আমার ঘর’ বলে আমি-লোকটা দিনরাত্রি খেটে মরছে, যতক্ষন না বলতে পারছে, ‘এইটে তোমারও ঘর’ ততক্ষণ তার যে কত দাহ, কত বন্ধন, কত ক্ষতি, তার সীমা নেই—ততক্ষণ ঘরের কাজ করতে করতে তাঁর অন্তরাত্মা কেঁদে গাইতে থাকে, হরি, আমায় পার করো।’ যখনি সে আমার ঘরকে তোমার ঘর করে তুলতে পারে তখনই সে ঘরের মধ্যে থেকে পার হয়ে যায়। আমার কর্ম মনে করে আমি-লোকটা রাত্রিদিন যখন হাঁসফাঁস করে বেড়ায়, তখন সে কত আঘাত পায় আর কত আঘাত করে, তখনই তার গান ‘আমায় পার করো’—যখন সে বলতে পারে ‘তোমার কর্ম’, তখন সে পার হয়ে গেছে।” (রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্ররচনাবলী, চতুর্দশ খণ্ড, পৃ: ৬৮৫, প্রকাশক: পশ্চিমবঙ্গ সরকার, প্রকাশ: ১৯৯২)
কথামৃত: ১-১০-৮: শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি বলি যে, সংসার করতে দোষ কি : তবে সংসারে দাসীর মত থাক। ….তাই যারা আসে তাদের আমি বলি সংসার কর না কেন, তাতে দোষ নাই। তবে ঈশ্বরেতে মন রেখে কর, জেনো যে বাড়ি ঘর পরিবার আমার নয়; এ সব ঈশ্বরের। আমার ঘর ঈশ্বরের কাছে। আর বলি যে তাঁর পাদপদ্মে ভক্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে সর্বদা প্রার্থনা করবে।”
পরিযায়ী মন, পর্ব-৭: ভিস্তা ডোমে তিস্তার দেশে
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪১: কান্না হাসির দোল দোলানো ‘একটি রাত’
নূতন করে নূতন প্রাতে।
দিনে দিনেই ফুল যে ফোটে,
তেমনি করেই ফুটে ওঠে
জীবন তোমার আঙিনাতে
নূতন করে নূতন প্রাতে। ….
লহো গো লহো তুলে।
উঠিবে বাজি তন্ত্রীরাজি
মোহন অঙ্গুলে।…
লহো হে নাথ, লহো
এবার তুমি ফিরো না হে—
হৃদয় কেড়ে নিয়ে রহো।
যেদিন গেছে তোমা বিনা
তারে আর ফিরে চাহি না,
যাক সে ধুলাতে
এখন তোমার আলোয়
জীবন মেলে
যেন জাগি অহরহ। ….
আজি হতে আমারে
চিত্ত-মাঝে দিবারাত
আদেশ তব দেহ নাথ
তোমার কর্মে রাখো
বিশ্বদুয়ারে।….
এসেছি তব দ্বারে
তুমি অন্তর্যামী হৃদয় স্বামী,
সকলই জানিছ হে ….
আর আপনা ভাবনা
পারিনা ভাবিতে,
তুমি লহো মোর ভার—
পরিশ্রান্ত জনে, প্রভু,
লয়ে যাও সংসার সাগরপারে।
গৃহদীপখানি জ্বালো হে।
সব দুখশোক সার্থক হোক
লভিয়া তোমার আলো হে ….
আমি যত দীপ জ্বালিয়াছি তাহে
শুধু জ্বালা শুধু কালী—
আমার ঘরের দুয়ারে শিয়রে
তোমারি কিরণ ঢালো হে।
আমার লাজভয়,
আমার মান অপমান,
সুখ দুখ ভাবনা।
মাঝে রয়েছে আবরণ
কত শত, কতমতো—
তাই কেঁদে ফিরি,
তাই তোমারে না পাই,
মনে থেকে যায় তাই হে
মনের বেদনা।…
সে তো আমি জানি—
আমার যত বিত্ত প্রভু,
আমার যত বাণী।….
আমার বলে যা পেয়েছি
শুভক্ষণে যবে
তোমার করে দেব তখন
তারা আমার হবে—
সব দিতে হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (কথামৃত : ১-১-৫) সব কাজ করবে কিন্তু মন ঈশ্বরেতে রাখবে। স্ত্রী, পুত্র, বাপ, মা, সকলকে নিয়ে থাকবে ও সেবা করবে। যেন কত আপনার লোক। কিন্তু মনে জানবে যে তারা তোমার কেউ নয়।
রবীন্দ্রসংগীত :
তারা কাছে থাক,
তারা তো পাবে না জানিতে—
তাহাদের চেয়ে
তুমি কাছে আছ
আমার হৃদয়খানিতে।
যারা কথা বলে তাহারা বলুক,
আমি করিব না কারেও বিমুখ
তারা নাহি জানে
ভরা আছে প্রাণ
তব অকথিত বাণীতে।
নীরবে নিয়ত রয়েছ আমার
নীরব হৃদয়খানিতে। …
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৮: রবীন্দ্রনাথ সাঁতার কাটতেন, সাঁতার শেখাতেন
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৫: আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে / খুঁজে পেতে আনি খেতে-নয় বড় সিধে সে!…
“কচ্ছপ জলে চ’রে বেড়ায় কিন্তু তার মন কোথায় পড়ে আছে জান? আড়ায় পড়ে আছে। যেখানে তার ডিমগুলি আছে। সংসারের সব কর্ম ক’রবে কিন্তু ঈশ্বরে মন ফেলে রাখবে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (কথামৃত : ৩-৯-৬) ” …সংসারে নষ্ট স্ত্রীর মত থাকবে। নষ্ট-স্ত্রী বাড়ির সব কাজ যেন খুব মন দিয়ে করে, কিন্তু তার মন উপপতির উপর রাত-দিন পড়ে থাকে। সংসারের কাজ করো, কিন্তু মন সর্বদা ঈশ্বরের উপর রাখবে।”
ঈশ্বরে মনে সমর্পণের শত শত রবীন্দ্র সঙ্গীত থেকে, কয়েকটি উদাহরণ।
এবে তোমার ক্রোড় চাহি।
শান্ত হৃদয়ে হে,
তোমারি প্রসাদ চাহি।
আজি চিন্তাতপ্ত প্রাণে
তব শান্তিবারি চাহি।
আজি সার্ববিত্ত ছাড়ি
তোমায় নিত্যনিত্য চাহি।”
তুমি হে প্রভু—
তুমি চিরমঙ্গল সখা হে
তোমার জগতে,
চিরসঙ্গী চির জীবনে….”
নাহি মিটিল
গরলরসপানে জরজরপরানে
মিনতি করি হে করজোড়ে,
জুড়াও সংসারদাহ তব
প্রেমের অমৃতে।”
মোরে ছেড়ো না
সংসারগহনে নির্ভয় নির্ভর,
নির্জনসজনে সঙ্গে রহো।
অধনের হও ধন,
অনাথের নাথ হও হে,
অবলের বল।
জরাভারাতুরে নবীন করো
ওহে সুধাসাগর।”
মম পূর্ণ হল,
শুন সবে জগতজনে।
কী হেরিনু শোভা,
নিখিলভুবননাথ
চিত্ত-মাঝে বসি স্থির আসনে।”
চলিব নাথ সংসারকাজে।
তুমি আমার নয়নে
নয়ন রেখো
অন্তর মাঝে।…..
নিমেষে নিমেষে নয়নে বচনে,
সকাল কর্মে, সকল মননে
সকল হৃদয়তন্ত্রে যেন
মঙ্গল বাজে।”
—চলবে।