শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

সেবার বোধিসত্ত্ব স্বর্গের অন্যতম দেবপুত্রভাবে অবস্থান করছেন। ব্রহ্মদত্ত তখন বারাণসীর রাজা, সেসময় বারাণসীতে এক বিশাল উত্সব আয়োজিত হল। বারাণসী বলে কথা! সেই মহোত্সবে নাগ, পক্ষী, দেবগণ নানালোক থেকে বারাণসীতে আসতে থাকলেন। নানাবিধ স্বর্গলোক থেকে দেবতারা আসছেন, তাঁদের মধ্যে চারজন দেবপুত্র ছিলেন। বোধিসত্ত্ব এঁদের অন্যতম।
যাই হোক, সেই চারজন দেবপুত্র এক বিশেষ স্বর্গীয়পুষ্পের শিরোমাল্য ধারণ করে ধরাতলে অবতীর্ণ হলেন। বারাণসী সেই ফুলের অপূর্ব সুগন্ধে আমোদিত হয়ে গেল। জনগণ সেই দিব্যপুষ্পের মনোহর গন্ধে আকুল হয়ে তার উত্স সন্ধান করছে দেখে দেবপুত্রের দল রাজাঙ্গন থেকে ঊর্ধ্বলোকে উঠলেন। কৌতূহলী জনতার জিজ্ঞাসার উত্তরে তাঁরা জানালেন কোথা থেকে আসছেন, কেন আসছেন, এগুলো কোন্ ধরণের ফুল ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর নিবেদিত হল প্রার্থনা—“আমাদের এই পুষ্পমাল্য দান করুন। আপনারা অন্য পুষ্প ধারণ করবেন।”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৩: দেবেন্দ্রনাথ হয়েছিলেন ‘কল্পতরু’

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৯: সুন্দরবনের পাখি: টুনটুনি

উত্তর এল— “এই মালা মহানুভব শুদ্ধধী দেবতাদের উপযুক্ত, মনুষ্যলোকে যারা নীচাশয়, দুঃশীল, সদ্ধর্মে শ্রদ্ধাহীন তাদের জন্য এসব নয়। কিন্তু যেসব মানুষের বিশেষ বিশেষ কিছু গুণ থাকবে তারা পাবে বৈকী!”

তাঁরা জানালেন, কাজেকর্মে যে সত্, পরের সম্পদ হরণ যে কদাপি করে না, সত্যভিন্ন মিথ্যা উচ্চারণ যে করে না, সৌভাগ্যে যারা অপ্রমত্ত, অনাকুল, বিগতস্পৃহ; তারাই এই মাল্যের যোগ্য।

সকলের মতোই পুরোহিত শুনছিলেন এই দৈববাণী। দেবপুত্রেরা বিরত হলে পুরোহিত মনে মনে ভাবলেন, বটে, আমার তো এসব কোনওগুণ-ই নেই। তবে বলে দিই না কেন, আমার এসব গুণ ভালোই আছে। আমি তো মালা পেতেই পারি। তখন লোকে আমাকে বড়োই খাতির করবে। ভাববে আমি পরম গুণবান।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৪: পরবর্তী পদক্ষেপ

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১০: মোহমুদ্গর

এই সুযোগ বুঝি ছাড়া যায় না। মিথ্যে করে বলে দেওয়াই যাক না কেন!

যেমন ভাবা তেমন কাজ। তিনি বললেন, “আমার সকল গুণ আছে হে, অতয়েব…”

তো পেয়েও গেলেন, মাথায় চাপিয়ে নিলেন সেই দিব্যপুষ্পভার। তারপর ক্রমে ক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ দেবপুত্রের সন্নিধানে এসে মাল্য যাচ্ঞা করলেন। তাঁরা শোনালেন শর্ত। পুরোহিত জানালেন, “আছে আছে, সকল গুণ তাঁর আছে রে বাবা। তাঁর না থাকলে আর থাকবে কার। অতয়েব…”।
পেয়েও গেলেন, মাথায় চাপিয়ে নিলেন সেই দিব্যপুষ্পভার।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৯: আসছে আমার পাগলা ঘোড়া

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৭: লোকে যারে বড় বলে

কাঁটার মুকুট মাথায় পরে যুগাবতার সৃষ্টির পাষাণভার স্বস্কন্ধে নেন। কেউ কণ্ঠে ধারণ করেন বিষ, কেউ পর্বত ধারণ করেন, ভূভার হরণ করেন। সেকালের ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশনের পদ্ধতি নিশ্চয়ই ভিন্নতর ছিল। সেসব নিশ্চয়ই দেবপুত্রেরা বুঝেশুনে নিয়েছিলেন। কী কী আবশ্যক গুণ থাকতে হতো?

ধর্মপথে অর্থের উপার্জন ও কামের অপ্রমত্ত উপভোগ, সদা স্থিরচিত্তে কর্তব্যের পরিপালন, সদ্বচনে অচলা ভক্তি, যথাশক্তি শীলরক্ষা, স্বাদু খাদ্য সকলে মিলে গ্রহণ, প্রত্যক্ষে, পরোক্ষে, ভ্রান্তিতেও কখনও যথার্থ সাধুব্যক্তির নিন্দাবাদ না করা, প্রতিজ্ঞাপালনে অকাতর উদ্যোগস্পৃহা ইত্যাদি ইত্যাদি থাকতে হবে বাপু। তবে এ মালা মাথায় উঠবে।

উঠল মাথায়। পুরোহিত বললেন, “আছে, আছে। তাঁরই এই সব গুণ আছে।” ফলে সকল মালাই তাঁর শিরোভূষণ হল। দেবপুত্রেরা ফিরে গেলেন। এদিকে, পুরোহিতের শিরঃপীড়া বাড়তে বাড়তে চরমে পৌঁছল। যেন মাথা হয়ে যাবে চূর্ণবিচূর্ণ। পুরোহিত প্রবল আর্তনাদে পাড়া মাথায় তুলল। কেন হচ্ছে এসব? পুরোহিত জানালেন, “সব ঝুট হ্যায় রে। যা বলেছেন বেবাক মিথ্যা। এখন আমাকে নির্ভার করো গো।”
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪১: রবীন্দ্রনাথ ও ব্রজেন্দ্র কিশোর

কিন্তু মাথা থেকে মালা খোলা গেল না। সেগুলো যেন লোহার বেড়ি হয়ে চেপে বসেছে তখন।

দিন যায়। পুরোহিতের বেদনা কমে না। তাঁর যন্ত্রণায়, আর্তনাদে ব্যথিত হয়ে রাজা অমাত্যদের পরামর্শ চাইলেন, কী করা যায় এই দুঃশীলটিকে নিয়ে। অমাত্যরা বললেন, “রাজামশাই! আরেকবার উত্সব করুন। সেখানে সকলে আবার আসবেন।”

উত্সব আয়োজিত হল। দেবপুত্রেরা এলেন। আবার নগরী আমোদিত হল পুষ্পগন্ধে। আনা হল সেই ব্রাহ্মণকে। আমাকে রক্ষা করুন। দেবপুত্রেরা জানালেন, জেনেশুনে প্রবঞ্চনা করলে মিথ্যাবাক্যের পরিণতি তো এমনই হয়। এরপর ভর্তসনা, তিরস্কার করে সদুপদেশ দিয়ে পুষ্পমালা ফিরিয়ে নিয়ে তাঁরা ফিরে গেলেন।
“ফুলগুলো সরিয়ে নাও
আমার লাগছে।
মালা জমে জমে পাহাড় হয়
ফুল জমতে জমতে পাথর।
পাথরটা সরিয়ে নাও, আমার লাগছে।”
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content