বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

বোধিসত্ত্ব নানাজন্মে নানারূপ ধারণ করেছিলেন। আজকের কাহিনিটি একটু বিচিত্র, সেবার ব্রহ্মদত্তের শাসনকালে বারাণসী নগরে বোধিসত্ত্ব এক শূকরীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন। একদিন শূকরী তার দুটি পুত্রকে নিয়ে গর্তে শুয়ে ছিল। তখন এক বৃদ্ধা কার্পাসক্ষেত্র থেকে কার্পাসপূর্ণ ঝুড়ি নিয়ে হাতের লাঠিটিতে ঠকঠক আওয়াজ করতে করতে পথ দিয়ে যাচ্ছিল। শূকরী সেই শব্দ শুনে প্রাণভয়ে ভীত হয়ে পুত্রদুটিকে ফেলে পালিয়ে গেল।

বৃদ্ধা শূকরের শাবকদুটিকে নিয়ে এল তার গৃহে, পুত্রবত্ পালন করতে লাগল। বড়টির নাম দিল মহাতুণ্ডিল, ছোটটির নাম হল খুল্লতুণ্ডিল। ক্রমে ক্রমে তারা পরিণত হল। তাদের পুষ্ট শরীর দেখে লোকে মূল্যের বিনিময়ে তাদের কিনে নিতে চাইল। কিন্তু বৃদ্ধা তাদের প্রতি অপত্যস্নেহে সেসব কথায় কান দিতো না।
একদিন কিছু ধূর্ত মাতালের মদ্যপানের প্রয়োজনীয় মাংস ফুরিয়ে গেল। তখন তারা সন্ধান করতে করতে সেই বৃদ্ধার কাছে এসে মূল্যের বিনিময়ে শূকরগুলি কিনতে চাইল। বৃদ্ধা তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে জানায়, এগুলি তার পুত্র। মাতালরা প্রতিযুক্তি দিয়ে বলে, শূকর কখনও মানুষের পুত্র হয় নাকি আবার! যত্তসব… দাও দাও। পয়সা নাও। বেচে দাও। ব্যাস। তবু তারা অনেক চেষ্টাতেও বৃদ্ধাকে টলাতে পারল না।

সেই মাতালগুলি ধূর্ত ছিল। তারা চাতুর্য অবলম্বন করল তখন। তারা বৃদ্ধাকে মদ্যপান করালো। ক্রমে বৃদ্ধা মত্ত হলে তারা আবার শূকর চাইল। হাতে গুঁজে দিল কার্ষাপণ। পয়সা পেয়ে বৃদ্ধা রাজি হল এবার। বলল “খুল্লতুণ্ডিলকে নিয়ে যাও, মহাতুণ্ডিলকে ছাড়তে পারবো না।”
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১২: দর্দরজাতক

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৭: ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগে মহর্ষি পেলেন চরম দুঃসংবাদ

ধূর্ত মাতালগুলি জানলো, অদূরেই একটি গুল্মে শূকরদুটি আছে। বৃদ্ধার পরামর্শে তারা একথালা ভাত কিনে আনলো। বৃদ্ধা দ্রোণীতে ভাত ঢেলে খুল্লতুণ্ডিলকে খেতে ডাকল।

বোধিসত্ত্ব সেই জন্মে ছিলেন মহাতুণ্ডিল। বিচক্ষণ মহাতুণ্ডিল ভাবলো “ব্যাপার কী! প্রতিদিন আমাকে আগে ডাকা হয়, আজ কনিষ্ঠের ডাক পড়েছে! এ তো ভালো নয়!” তার পরামর্শে খুল্লতুণ্ডিল গুল্ম থেকে বেরিয়ে দেখল পাশ হাতে নিয়ে ত্রিশজন মাতাল তাকে ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তাই দেখে ভয়ে তার প্রাণ উড়ে গেল। সে গুল্মে ফিরে এসে মৃত্যুভয়ে কাঁপতে লাগল। মহাতুণ্ডিল তাকে জিজ্ঞাসা করে সব জানলো এবং ভাইকে আশ্বস্ত করে বলল “তুমি চিন্তা কোরো না, মা যে কারণে শূকর পুষেছেন সেই প্রয়োজন আজ পূর্ণ হয়েছে।”
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৬: ‘রাজর্ষি’ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘বিসর্জন’ নাটক

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮২: সুন্দরবনের পাখি—টিয়া

এরপর মহাতুণ্ডিল ধর্মোপদেশ দিলেন। তাঁর মহাগর্জনে বারাণসীর রাজা, উপরাজ, জনগণ দৌড়ে এল, রাজপুরুষরা সেই গুল্ম ভেঙে সমতল করে দিল, তারপর জমিতে ছড়িয়ে দিল বালুকা।
এতো কাণ্ডে মাতালদের মত্ততা ছুটে গেল, বৃদ্ধার-ও নেশা ভাঙল।

মহাতুণ্ডিল ভ্রাতাকে উপদেশ দিয়ে বললেন, এই যে ভয়ে তুমি কম্পমান, আশ্রয় খুঁজছো আত্মরক্ষার, কিন্তু কোথায় পাবে সেই আশ্রয়? মনের আনন্দে অন্নভোজন করো, জানতে পারবে মাংসের জন্যই মানুষ শূকর পোষে কেবল। নির্মল হ্রদের জলে স্নান করে পবিত্র হও। ধুয়ে ফেল দেহের যতো স্বেদমল, নব বিলেপনে শরীর চর্চিত করো যা অক্ষয়, যার সৌরভ কখনও মুছে যায় না।

ঠিক কী বলতে চেয়েছিলেন মহাতুণ্ডিল? আমরা গল্পের পথে আরেকটু এগিয়ে দেখি।

ভাইটি ভাবলো, দাদা যা বলছে তার মর্মার্থ বা কীরকম? আমাদের বংশে কেউই কখনো পুষ্করিণীতে নেমে স্নান করে দেহস্থ স্বেদমল দূর করে অঙ্গরাগ করেনি।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৫: শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষতায় বীরবিক্রম

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৮: কপোত-কপোতী

মহাতুণ্ডিল জানিয়েছেন, ধর্ম হল অপঙ্কিল হ্রদ, তাতে অবগাহন করে পাপরূপ স্বেদমল দূর করা যায়। শীলসমূহ হল তার নববিলেপন, যার সুখসৌরভ চরাচরব্যাপী অক্ষুণ্ণ থাকে। এই মাংসলোভীরা লালসায় লুব্ধ, কামনায় মোহগ্রস্ত। জগতে ঐ মাংসের স্থূল মূর্তরূপ যে শরীর, তার ধারণ কি বড় সুখকর বুঝি? তবে জীব মৃত্যুভয়ে কম্পমান কেন! শীলবান এসবের ঊর্ধ্বে। পূর্ণিমার চন্দ্রদর্শনে যেমন প্রাণ হাস্যমধুর হয়, তেমনই শীলবান ব্যক্তি হাসতে হাসতে প্রাণ ত্যাগ করে।

তারপর?

মানুষ এই ধর্মের বাণীতে পরিতুষ্টি লাভ করল। রাজা বিমুগ্ধ হয়ে মহাতুণ্ডিলকে পুত্ররূপে গন্ধোদক, অর্ঘ্য, রত্ন, বস্ত্র, ধন, মান, অনুচর, রাজ্যাদি দিয়ে অভ্যর্থনা করলেন। তাঁকে পুত্রস্থানে প্রতিষ্ঠিত করলেন। সেই বৃদ্ধাকেও ধন, মান, বস্ত্র, অনুচরাদির দ্বারা সম্মানিত করলেন। বোধিসত্ত্ব রাজাকে পঞ্চশীল দান করলেন, রাজ্যের অধিবাসীরাও শীল অবলম্বন করল, বোধিসত্ত্ব তাঁদের প্রতি পক্ষকালের শেষে ধর্মশিক্ষা দিতেন, বিচারালয়ে বিবাদমীমাংসা করতেন। তাঁর সময়কালে তিনি অভ্রান্ত ছিলেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৭: পাঞ্চালীকে আশীর্বাদ করে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন গান্ধারী

ক্রমে রাজা প্রয়াত হলেন। তখন মহাতুণ্ডিল বিচারবিষয়ক সিদ্ধান্তবহুল এক গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়ে অপ্রমত্ত হয়ে তার উপদেশ দিয়ে জনগনকে তা পালনের নির্দেশ দিলেন। তারপর দেশবাসীকে নিতান্ত দুঃখিত করে খুল্লতুণ্ডিলের সঙ্গে বনগমন করলেন।

ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ কি তা যুগযুগান্তের চর্চার বিষয়। তবে এ বিষয়ে নিঃসংশয় হওয়া যায় যে, চতুর্বর্গে প্রধান হল ধর্ম। ধর্মের প্রকৃত উদযাপন, পরিপালনের মধ্য দিয়েই জাগতিক ও পারত্রিক আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি ও সাফল্য। যথাকালের যথাকর্তব্যের ধারণ, সাধনেই ধর্মের তাৎপর্য। মহাতুণ্ডিলের চোখে আমরা যা দেখি, বুঝি তা-ই ধর্মের বাণী। গল্পটিতে যে মত্ততার তমিস্রা আর তার অপসারণে স্থূল শরীরের আকাঙ্ক্ষার ঊর্ধ্বে জীবনের যে সত্যরূপ জেগে ওঠে তা-ই যেন ধর্মের মূল। উপনিষদ ত্যাগের দ্বারা ভোগের পরিপালনের কথা বলেন। আবার জীবশরীরের ধারণে ভোগ, পার্থিব রূপরসের সান্নিধ্য-ও নিন্দনীয় নয়। তবে জীবনকে যথার্থরূপে জেনে ও উপলব্ধি করে, জীব ও জীবনের ধর্মের প্রকৃত অনুসরণেই মত্তহস্তীর তাড়নায় ধ্বস্ত হৃদয়ের কমলবন আবারও পূর্ণচাঁদের আলোকে প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content