শনিবার ১ মার্চ, ২০২৫


সেবার বারাণসীতে ব্রহ্মদত্তের রাজত্বকালে বোধিসত্ত্ব প্রাক্তনকর্মফলে কুকুর হয়ে জন্মেছেন। মহাশ্মশানে বহুশত কুকুরবেষ্টিত হয়ে তিনি বসবাস করতেন। রাজা একদিন সিন্ধুদেশের শ্বেতঘোটকে টানা চর্মসজ্জায় সুসজ্জিত মহার্ঘ্যরথে উদ্যানভ্রমণে গেলেন। সূর্যাস্তের পর ফিরে এলেন রাজপুরীতে। চর্মশোভিত রথের সেই সুন্দর সাজ আর খোলা হল না, রাত্রিতে সজ্জিত সেই রথ রাজার উদ্যানেই পড়ে থাকল, তারপর নামল বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজে গেল সেই চামড়ার সাজ।

রাজপুরীতে রাজার পোষা কুকুরের দল ছিল। তারা এই সুযোগে প্রাসাদের দ্বিতল থেকে নেমে এল, সমস্ত চামড়া খেয়ে নিঃশেষ করে দিল। সকালে ভৃত্যরা রাজাকে জানাল, যে নর্দমার পথে কুকুরের দল এসে রথের চর্মসাজ খেয়ে নষ্ট করেছে। একথা শুনে ক্রুদ্ধ রাজা কুকুর দেখলেই হত্যা করার আদেশ দিলেন।
তারপর নগর জুড়ে শুরু হল পশুমেধ। কুকুরহত্যার সেই ভয়ানক অত্যাচারে বহু কুকুর মারা পড়ল, যেখানেই যায় সেখানেই কুকুর হত্যার মহালীলা, ভীত অবশিষ্ট কুকুরের দল শ্মশানে বোধিসত্ত্বের কাছে ছুটে এল।

সকল বৃত্তান্ত শুনে বোধিসত্ত্ব অনুধাবন করলেন প্রকৃত সত্য। রাজপুরী এতোই সুরক্ষিত যে বাইরে থেকে সেখানে প্রবেশ অসম্ভব। অতয়েব এই কাজ নগরের রাজকীয় কৌলেয় কুকুরদের। তিনি সবিস্ময়ে ভাবলেন যে, অপরাধী নির্ভয়ে আছে, নিরপরাধের প্রাণ যাচ্ছে। সত্য উন্মোচন করে জ্ঞাতিবন্ধুদের কি তিনি রক্ষা করতে পারেন না? তিনি বন্ধুদের আশ্বস্ত করে জানালেন যে রাজসমীপে সত্যোদ্ঘাটন করে তিনি সকলের প্রাণরক্ষা করবেন, তারা যেন এখানেই অপেক্ষা করে।

বোধিসত্ত্ব মৈত্রী ভাবাপন্ন হয়ে ইষ্টস্মরণ করলেন, একাকী যাত্রাকালে পথে তিনি নিরাপদ থাকলেন। ক্রুদ্ধ হয়ে কেউ লাঠি উঁচিয়ে, ঢিল ছুড়ে তাঁকে উদ্বিগ্ন করতে এল না।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১৭: কুক্কুটজাতক-চিনে নাও বন্ধু কে?

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা/৫

তখন রাজা বিচারালয়ে বিচারে প্রবৃত্ত হয়েছেন। প্রজানুরঞ্জন রাজার অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। স্বাধ্যায়, চরনিয়োগ, দূতপ্রেষণ, করগ্রহণ, নিরাপত্তাবিধান থেকে বিচার, সকলই রাজার আশুকর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। কুকুররূপী বোধিসত্ত্ব রাজসিংহাসনের নিম্নদেশে সবেগে প্রবেশ করলে রাজার ভৃত্যের দল তাঁকে তাড়িয়ে বের করে দেওয়ার উদ্যোগ নিল, কিন্তু রাজা তাদের নিষেধ করলেন। আশ্বস্ত হয়ে কুকুরটি সিংহাসনের তলদেশ থেকে বহির্গত হয়ে রাজাকে প্রণিপাত করে কিছু প্রশ্ন জানতে চাইল, রাজা যথারীতি তাঁর উত্তর দিলেন। এই প্রশ্নোত্তর পর্বের ক্রম ও যৌক্তিক ক্ষেত্রটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো।

কুকুরটি জানতে চাইল যে রাজা কুকুরবধের আদেশ দিয়েছেন কীনা। রাজা জানালেন যে তিনি এই আদেশ দিয়েছেন বটে। অতয়েব অনুসন্ধিত্সু ও জিজ্ঞাসু প্রথমে জ্ঞাতব্য বিষয়টির যাথার্থ্য নির্ধারণ করতে চাইবেন।

এরপর বোধিসত্ত্ব প্রশ্ন করলেন যে, কুকুরদের অপরাধ কি? রাজা উত্তর দিলেন। এখানে অভিযুক্তের প্রতি যথার্থ অভিযোগটি নির্দিষ্ট হল।

তারপর বোধিসত্ত্ব জানতে চাইলেন যে, কোন্ কুকুর এই চর্মসজ্জা ভক্ষণ করেছে তা কি রাজা নিশ্চিতভাবে জানেন। অর্থাৎ, প্রমাণের প্রসঙ্গ এল। রাজা জানালেন যে, তিনি তা জানেন না বটে।
আরও পড়ুন:

ঈশ্বর কী সাড়া দেন তামিলে, সংস্কৃতে?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৩: গ্রহের ফের

এ বার অবশ্যম্ভাবী বক্তব্যটি পরিবেশিত হল। যদি প্রকৃত অপরাধী অজ্ঞাত হয়, তবে এই আদেশ একেবারেই অবৈধ, অনুচিত, অনৈতিক।

বোধিসত্ত্বের এই মন্তব্যের প্রত্যুত্তরে রাজা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলবেন, কুকুরের দল চর্মসাজ খেয়ে নিয়েছে, তাই তিনি সব কুকুর হত্যার আদেশ দিয়েছেন। এখানে নতুন প্রতর্কের জন্ম হল। রাজা যেমন যেমন জানবেন সেই জানার সূত্র ধরেই সিদ্ধান্ত নেবেন। রাজার দায়িত্ব যদি সিদ্ধান্তগ্রহণ হয় তবে তাঁর ভুলটা কোথায়? রাজা চারচক্ষু হবেন, চরের মুখে খবর পেয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন এই যদি কাজ হয় তবে তাঁর ত্রুটি কোথায় হল? তবে সিদ্ধান্ত নাকি বিবেচনা নাকি দুটিই, এই প্রশ্নটিই মুখ্য হয়ে ওঠে না কি?

শাস্ত্র রাজাকে যথার্থদণ্ড হতে বলবে, লঘুপাপে গুরুদণ্ড বা গুরুপাপে লঘুদণ্ড দিলে রাজ্যে প্রজাবিক্ষোভ অবশ্যম্ভাবী, যা রাজার বিনাশকেই ত্বরান্বিত করবে, বলাবাহুল্য।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৬: এক সন্ধ্যায় মা সারদার বলা ভূতের গল্প

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৭: উত্তরণ-অবতরণ শেষে স্বপ্নের ‘সূর্যতোরণ’

কুকুররূপী বোধিসত্ত্ব তখন আরব্ধ প্রতর্কের সূত্র ধরেই জানতে চাইবেন, রাজপুরুষরা সকল কুকুরকেই হত্যা করছে নাকি কোনও কোনও কুকুরকে বেছে বেছে বধ করছে? অর্থাত্, যেখানে অপরাধ চিহ্নিত কিন্তু অপরাধীর স্বরূপ নিশ্চিত নয় সেখানে যে শাস্তির বিধান হল তা যদি আংশিকভাবে প্রযুক্ত হয় তবে তার থেকে বড় অনাচার আর কী হতে পারে!

রাজা জানালেন যে রাজপুরীর কৌলেয় কুকুররা এই মারণযজ্ঞের বাইরেই আছে, তাদের হত্যা করা হচ্ছে না।

এবার বোধিসত্ত্ব বলবেন যে, রথের চামড়া খাওয়ার জন্য সব কুকুরদের হত্যার আদেশ দেওয়া হলে রাজার কৌলেয় কুকুরদের বাদ দিয়ে রাজপুরুষরা যদি হত্যালীলা চালায় এবং তা রাজার জ্ঞাতসারেই যে হচ্ছে তা যখন জানা গেল তবে এই কাজ রাজার অগতিপ্রাপ্তির কারণ হবে। অপরাধী নিরুদ্বিগ্ন, দুর্বল বিপন্ন যে বিচারে তা নিরপেক্ষ নয় বলাই বাহুল্য। নিরপেক্ষ দণ্ড যেখানে বিহিত নয়, সেখানে যা হচ্ছে তা নিতান্তই ন্যায়বিরুদ্ধ। যুগে যুগে এই অন্যায়ের পৃষ্ঠপোষক অগতিপ্রাপ্ত হয়েছে, বিনষ্ট হয়েছে। বোধিসত্ত্ব রাজাকে ধর্মোপদেশ দিলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০২: ভরতের মতো একমুখী লক্ষ্যে এগিয়ে চলা কী সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১২: দারুণ এক গগনবিহারী খেলনা বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ

এরপরে রাজার প্রশ্নের উত্তরে বোধিসত্ত্ব জানাবেন যে, তিনি প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করতে সক্ষম। তিনি জানালেন যে কৌলেয় কুকুররাই এই অপরাধ করেছে এবং তিনি ঘোল ও কুশ পরস্পর মিশ্রিত করে সেই কুকুরগুলোকে খাওয়াতে বললেন। তেমনটা করা হলে কুকুররা ঘোল পান করে চর্মখণ্ডসমূহ বমন করে দিল। এই দৃশ্য দেখে রাজা সন্তুষ্ট হলেন, তাঁর জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হল। রাজা বোধিসত্ত্বকে সম্মান জানিয়ে আপ্যায়িত করলেন, সকল প্রাণীকে অভয় দিলেন, বোধিসত্ত্বাদি সকল কুকুরকে প্রতিদিন রাজভোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন, দানাদি কর্মে আজীবন নিরত থাকলেন।

এই কাহিনির প্রতিপাদ্য অবশ্যই যথার্থ বিচার ও দণ্ডের বিধান। বিচার যথার্থ না হলে দণ্ড দুষ্প্রযুক্ত হয়, একারণে দণ্ডদান যেমন কর্তব্য, তেমনই সুবিচারের মাধ্যমে সন্দেহের যথার্থ নিরসন তার চেয়েও গুরুতর এবং আশু কর্তব্য। এই কাহিনী সমাজ-ইতিহাসের সেই দীর্ঘ বিসম্বাদ ও সত্যস্বরূপকে তুলে ধরতে চেয়েছে।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content