শনিবার ১২ এপ্রিল, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

এই কাহিনি প্রতিষ্ঠা, স্খলন ও পুনরুত্থানের।

বারাণসীতে ব্রহ্মদত্তের শাসনকালে এক ধনাঢ্য ব্রাহ্মণকুলে বোধিসত্ত্ব জন্ম নিলেন। শোনা যায়, সেই ব্রাহ্মণকুলে আশিকোটি ধনসম্পদ বর্তমান ছিল। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে তিনি তক্ষশিলায় গিয়ে নানা শাস্ত্র অধ্যয়ন করে প্রগাঢ় জ্ঞান ও ব্যুৎপত্তি অর্জন করে স্বদেশে ফিরে এলেন, বিবাহ করে গার্হস্থ্যধর্ম অবলম্বন করলেন। কালক্রমে পূর্বজগণের প্রয়াণে সেই বিপুল স্বর্ণাদি সম্পদ লাভ করে তিনি মনে মনে ভাবলেন যে, যাঁরা এই রাশি রাশি ধন সংগ্রহ করেছিলেন তাঁরা তো বর্তমানে অপ্রত্যক্ষ। এই চিন্তা তাঁকে বিমর্ষ করলো, ব্যথিত-বিহ্বল করলো। তাঁর হৃদয়ে বুঝি বৈরাগ্যের উদ্গম হল।

দীর্ঘকাল সংসারধর্মের পর, অক্লেশে মুক্তহস্তে দানধর্মের পর, বীতরাগ হয়ে বোধিসত্ত্ব প্রব্রজ্যা নিলেন। আত্মীয়দের সাশ্রুনয়ন, নিষেধ কিংবা উপরোধ প্রত্যাখ্যান করে হিমালয়ের মনোরম স্থানে পর্ণশালা নির্মাণ করে তপশ্চরণে নিমগ্ন হলেন, বন্য ফলমূলে জীবনধারণ করতে করতে ক্রমে অভিজ্ঞা ও সমাপত্তি অর্জন করলেন।
এরপরে তিনি ভাবলেন যে, লোকালয়ে গিয়ে অম্ল ও লবণ ভিক্ষা করে সেবন করলে শরীরে বলবৃদ্ধি ঘটবে, যাঁরা তাঁর তুল্য শীলবানকে ভিক্ষা দেবে তাঁরা পুণ্যাত্মা হয়ে স্বর্গলাভ করবেন। হিমালয় থেকে অবতরণ করে পদব্রজে ভিক্ষা করতে করতে একদিন সূর্যাস্তকালে তিনি বারাণসী নগরে প্রবেশ করলেন।

পাঠক! এই প্রবেশকালে সূর্যাস্তের ব্যঞ্জনাটুকু মনে রাখবেন।

এরপর, রাত্রিযাপনের উপযুক্ত ক্ষেত্র রাজোদ্যান দেখতে পেলেন। স্থানটি নির্জন, একান্তবাসের উপযুক্ত। সেখানে বৃক্ষমূলে বসে ধ্যানস্থ হয়ে মহাসুখে তিনি রাত্রি অতিবাহিত করলেন। প্রভাতে জটা, অজিন, বল্কলাদি বিন্যস্ত করে তিনি ভিক্ষার জন্য নগরের রাজপথে হাঁটতে লাগলেন। তাঁর প্রশান্ত আকৃতি,গমনে মহানুভাব ও দেহোদ্গত তেজঃপুঞ্জ দেখে সকলে চমৎকৃত হল।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১৯: নাগজাতক— অকৃতজ্ঞ সেই লোকটা

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৮: এখানে দিন-রাত-শীত-গ্রীষ্ম-আলো-অন্ধকার, সব কিছুরই হিসেব আলাদা

ক্রমে তিনি রাজদ্বারে এলেন। রাজা প্রাসাদের মহাতলের বাতায়ন থেকে তাঁকে দেখে ভাবলেন যে জগতে যদি পূর্ণশান্তি নামে কোনও পদার্থ থাকে তবে তা এই মহাত্মার মনে বিরাজমান। তিনি সেই সন্ন্যাসীকে ডেকে পাঠালেন। অমাত্য এসে প্রাণপাত করে ভিক্ষাপাত্র গ্রহণ করে রাজার বার্তা জানালেন। কিন্তু বোধিসত্ত্ব বললেন যে তিনি তো রাজার পরিচিত নন। রাজা সেই সংবাদ শুনে তাঁকে কুলতাপস করার অভিপ্রায়ে আবার অমাত্যের দ্বারা আহ্বান জানালেন। নিজেও তাঁকে হস্তসঙ্কেতে অভ্যন্তরে আসার আকুতি জানালেন। এরপর বোধিসত্ত্ব রাজসকাশে এলেন, পালঙ্কে বসলেন, রাজার অনুরোধে রাজভোগ গ্রহণ করলেন। তাঁর সঙ্গে বার্তালাপে, প্রশ্নে-প্রতিপ্রশ্নে রাজা তুষ্ট হলেন। রাজা জানলেন যে বর্ষাবাসের জন্য হিমালয় থেকে সেই পুণ্যাত্মার আগমন, রাজার অনুরোধে পূর্ণমর্যাদায় রাজোদ্যানে তিনি অবস্থান করতে লাগলেন, থেকে গেলেন একটানা বারো বছর।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯o: ছাতারে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৪: প্রকৃতির সান্নিধ্যে কি গ্লানিমুক্তি সম্ভব? লক্ষ্মণের আবেগ কি সাধারণের মধ্যে সহজলভ্য?

ক্রমে দেশে প্রজাবিক্ষোভ হল। প্রত্যন্তবাসিগণের বিক্ষোভ দমনের জন্য রাজা যুদ্ধে চললেন। রাজার পরামর্শে রাজমহিষী নগরেই থাকলেন, সেই শীলবান্ তাপসের সেবায় যাতে কোনও ত্রুটি না হয় তার দায়িত্ব ন্যস্ত হল রাজমহিষীর উপর। তিনিও একান্ত যত্নে তাঁর পরিচর্যা করতে থাকলেন।

বোধিসত্ত্ব আহারের জন্য রাজপুরীতে ভিক্ষাপাত্র হাতে আকাশপথে মহাবাতায়নের সমীপে আসেন। একদিন আহার প্রস্তুত, কিন্তু বোধিসত্ত্বের আগমনে বিলম্ব হল। রাজমহিষী সেই অবসরে স্নান করে অলঙ্কার পরিধান করে একটি অনুচ্চ শয্যায় দেহ বস্ত্রে আচ্ছাদিত করে নিদ্রিত হলেন। অধিকবেলায় বোধিসত্ত্ব এলে তাঁর বল্কলের শব্দে রাজমহিষীর নিদ্রা অপগত হল, তিনি সহসা উত্থান করলেন। তাঁর দেহের পীতোজ্জ্বল শাটক মুহূর্তে খসে পড়ল। তাঁর কমনীয় অনুপম রূপে অজিনবাস বোধিসত্ত্ব বিমুগ্ধ ও অনুরক্ত হলেন। তাঁর চিত্তবিকার হল। ইন্দ্রিয়ের যে প্রবৃত্তি এতদিন ধ্যাননিবৃত্ত ছিল, তা যেন দুর্দমনীয় হল। কুঠারঘাতে ছিন্নতরুর মতোই তাঁর পতন ঘটল। ছিন্নপক্ষ্ম কাকের মতো তিনি অসহায় হলেন, তাঁর ইন্দ্রিয়সমূহ কলুষিত হল, ধ্যানবল বিনষ্ট হল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৭: মা সারদার লিঙ্গপুজো

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৮: দুর্গম গিরি কান্তার ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’

তিনি বসলেন না। ভিক্ষাগ্রহণের জন্য এগিয়ে দিলেন না পাত্র। রাজমহিষী সকল আহার্য তাঁর ভিক্ষাপাত্রে ঢেলে দিলেন। যে মহাপুরুষ আকাশপথে গমনাগমন করতেন, তিনি আজ স্খলিত পদক্ষেপে মহাসোপানের পথে ধীরে ধীরে বহির্গত হলেন।

তিনি উদ্যানে ফিরলেন বটে, তবে ভোজ্যে তাঁর আসক্তি রইল না। ক্রমাগত এক অপূর্ব মনোহর রূপের মোহ তাঁকে গ্রাস করল। অনন্যমনে তিনি পূর্বদৃষ্ট সেই রূপমাধুর্যের ভাবনায় নিরত থাকলেন। তাঁর ধ্যান গেল ঘুচে, সকল খাদ্য পচে গেল। অজস্র নীলমক্ষিকা ঘিরে ধরল সেই খাদ্য। এভাবেই সপ্তাহকাল তিনি শয্যালীন হয়ে থাকলেন।

প্রত্যন্তদেশে শান্তিস্থাপন করে রাজা ফিরলেন রাজধানীতে। বোধিসত্ত্বের সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে এসে দেখলেন উদ্যান অপরিচ্ছন্ন। প্রথমে ভাবলেন যে সন্ন্যাসী বুঝি অন্যত্র চলে গেছেন। পরে তাঁর উপস্থিতি অনুধাবন করে ধারণা করলেন যে এই মহাপুরুষ বুঝি অসুস্থ। তিনি গলিত খাদ্য সরিয়ে পর্ণশালা পরিষ্কার করে কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। সন্তপ্ত সন্ন্যাসী কেবল বললেন “আমি বিদ্ধ হয়েছি।” রাজা ভাবলেন যে, এ বুঝি তাঁর শত্রুদের কাজ। তাঁর অনুপস্থিতিতে অনিষ্টকর্মে অপারগ হয়ে তাঁর শ্রদ্ধাস্পদকেই শরবিদ্ধ করেছে। কিন্তু শরীর পরীক্ষা করেও আঘাতের কোনও চিহ্ন মিলল না। জানতে চাইলেন, শরীরের কোন্ অংশে আঘাত লেগেছে? সন্ন্যাসী কেবল বললেন, “আমি নিজেই নিজেকে বিদ্ধ করেছি।”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৬: নীল রাত্রি, নীল অন্ধকার

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১৩: শরৎকুমারী স্নানাগারের সামনে বসে সারাক্ষণই সাজতেন

এরপর রাজাকে সংবৃত্ত সকলকিছু জানালেন তিনি। পর্ণশালা থেকে বহির্গত হয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পুনরায় ধ্যানবল অর্জন করলেন। রাজার উপর্যুপরি অনুরোধেও তিনি অটল থাকলেন, তাঁর অধঃপতনের স্থান পরিত্যাগ করে আকাশপথে ফিরে চললেন হিমালয়ের পথে।

প্রিয় পাঠক! সেই সূর্যাস্তের কাল সন্ন্যাসীর জীবনে রাজভোগ্যের সান্নিধ্যে স্খলনের ইঙ্গিত দিয়েছিল বুঝি। মহারণ্যের ঔদার্য রাজোদ্যানের উপবনে লভ্য নয়। মক্ষিকা যেমন মধুভাণ্ড পরিব্যাপ্ত করে থাকে স্খলিত মানুষের হৃদয় আপাত রমণীয়ের প্রত্যাশা কিংবা আকর্ষণে সঙ্কল্পচ্যুত হয়। জীবনে এর থেকে বড় বিনষ্টি আর কিছু নেই। তবে মতিভ্রম তো মুনিদের-ও ঘটে বৈকী! পঞ্চশরের কামবাণ মহেশ্বরের চিত্তে বিকার এনেছিল, তারপর কাম দগ্ধ হয়েছিল নিঃশেষে। কর্তব্যে বিচলন স্বর্গ থেকে বিচ্যুত করে। কখনও নির্বাসন, কখনও বিরহ হয়ে সেই বিচলন নিঃশেষে মহাকাব্যের কুশীলবদের দগ্ধ করে করে পূর্ণ করেছে। অনুশোচনার পথেই জেগে ওঠে উপলব্ধি। জীবনের আকাঙ্ক্ষা কি, কীসেই বা কার পরিতুষ্টি তা অন্তর্লোক থেকেই প্রতিভাত হয়। সেই পথেই সঙ্কল্পের পরিপালন মুক্তি আনে; জাতকমালার সঙ্কল্পজাতকের কাহিনী সেই কথাই বলে যায়।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content