
বোধিসত্ত্ব এক জন্মে হিমালয়ের কোলে হস্তিরূপে আবির্ভূত হলেন। মায়ের গর্ভ থেকে জাত হলে তাঁর অনুপম সৌন্দর্যে সকলে মুগ্ধ হল। রজতপুঞ্জতুল্য শুভ্রদেহ ধারণ করে সেই হাতিটি কালে কালে প্রাপ্তবয়স্ক হল। তার চোখে অপূর্ব প্রসন্নতা, মুখমণ্ডল, শুণ্ড ও পদচতুষ্টয় উজ্জ্বল, কমনীয়, মধুর ও রক্তাভ। সেই পরম শোভন হস্তীটিকে হিমাচলের অন্যান্য হাতিরা অধিনেতা ঘোষণা করে তার অধীনেই বিচরণ করতো। কিন্তু কালে কালে দলে পাপ প্রবেশ করল, তা উপলব্ধি করে সেই শীলবান্ হস্তী মহারণ্যে সংসর্গহীন হয়ে একাকী বসবাস করতে লাগল।
দিন যায়। একদিন বারাণসীর এক বনচর জীবিকানির্বাহের জন্য উপকরণের সন্ধানে অরণ্যে প্রবেশ করে পথ হারিয়ে ভয়ে প্রবল বিলাপ করতে লাগল। শীলবান হস্তী সেই আর্তনাদ শুনে সেখানে এলে তাকে দেখে বনচর ভয় পেলে পলায়ন করল। কিন্তু হাতি তাকে অনুগমন করল না। কিন্তু বনচর থামলে হাতি অগ্রসর হয়। এভাবে অনেকক্ষণ অতিবাহিত হলে বনচর অনুধাবন করল যে, হাতিটি তার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। তখন হাতি তার নিকটে এল, জানতে চাইল। সকল কিছু জেনে হাতি তাকে অভয় দিল, নিজের বাসস্থানে নিয়ে গিয়ে ফলমূলাদির দ্বারা তাকে তৃপ্ত করল, কয়েকদিন তার পরিচর্যা করল। শেষে তাকে বারাণসীর লোকালয়ের কাছে পৌঁছে দিল পিঠে চাপিয়ে। বনচর ফেরার পথটি চিনে রাখল, কোন পাহাড় অতিক্রম করে কোন বনের পাশ দিয়ে হাতি তাকে নিয়ে এল ইত্যাদি বিবিধ চিহ্ন সে স্মরণে রাখল। হাতি লোকালয়ের নিকটে এসে বনচরকে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিল, অনুরোধ রাখল যে, তার বাসস্থানের কথা যেন অজ্ঞাত থাকে।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১৮: কুক্কুরজাতক — কে দোষী?

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯o: ছাতারে
বারাণসীর নগরে ঘুরতে ঘুরতে বনচর দন্তকারবীথীতে প্রবেশ করল। সেখানে গজদন্তের বিবিধ দ্রব্য নির্মিত হয়। সে কথা বলে জানলো যে মৃতহস্তীর তুলনায় জীবিত হস্তীর দন্তের মূল্য অধিক, চাহিদাও বেশি। তখন সে একটি সুতীক্ষ্ণ করাত ও কিছু পাথেয় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
বনচরকে ফিরে আসতে দেখে শীলবান্ হস্তী বিস্মিত হল। বনচর জানালো যে, তার জীবন আর চলছে না। জীবিকানির্বাহের জন্য প্রভু যদি তাঁর দন্তের কিয়দংশ দান করেন তবে সে উপকৃত হয়।
বনচরকে ফিরে আসতে দেখে শীলবান্ হস্তী বিস্মিত হল। বনচর জানালো যে, তার জীবন আর চলছে না। জীবিকানির্বাহের জন্য প্রভু যদি তাঁর দন্তের কিয়দংশ দান করেন তবে সে উপকৃত হয়।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৭: উত্তরণ-অবতরণ শেষে স্বপ্নের ‘সূর্যতোরণ’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১২: দারুণ এক গগনবিহারী খেলনা বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ
বনচরটি অন্তরে মিত্রদ্রোহী ছিল।
হাতিটি কিন্তু সম্মত হল। বলল যে একটি করাত এনে কেটে নাও। বনচর জানালো যে সে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। বোধিসত্ত্ব বিস্মিত হলেন না মোটেই। বললেন, বেশ তো, তবে দুটি দন্তের-ই অগ্রভাগ ছেদন করে নাও না। তবে তাই হোক। হলোও তাই। বোধিসত্ত্ব জানালেন যে দন্তের ওপর তাঁর মমতা নেই এমন নয়। তবে ছেদনের কাজে যে দন্ত লাগে, তাকে দান করে যদি তিনি মহাজ্ঞানকে স্পর্শ করতে পারেন তবে তা প্রিয়তর। এই দন্তদানে সেই সর্বজ্ঞতারূপ দন্ত উদ্গত হোক।
দিন যায়। বনচর আবার একদিন ফিরে এল। দন্তের অগ্রভাগদুটি বিক্রয় করে প্রাপ্ত অর্থ তখন নিঃশেষিত। সে জানালো যে সেই অর্থে তার ঋণটুকুই শোধ হয়েছে কেবল। জীবিকানির্বাহের জন্য প্রভু যদি তাঁর দন্তদুইটির অবশিষ্টাংশ দান করেন তবে সে উপকৃত হয়।
হাতিটি কিন্তু সম্মত হল। বলল যে একটি করাত এনে কেটে নাও। বনচর জানালো যে সে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। বোধিসত্ত্ব বিস্মিত হলেন না মোটেই। বললেন, বেশ তো, তবে দুটি দন্তের-ই অগ্রভাগ ছেদন করে নাও না। তবে তাই হোক। হলোও তাই। বোধিসত্ত্ব জানালেন যে দন্তের ওপর তাঁর মমতা নেই এমন নয়। তবে ছেদনের কাজে যে দন্ত লাগে, তাকে দান করে যদি তিনি মহাজ্ঞানকে স্পর্শ করতে পারেন তবে তা প্রিয়তর। এই দন্তদানে সেই সর্বজ্ঞতারূপ দন্ত উদ্গত হোক।
দিন যায়। বনচর আবার একদিন ফিরে এল। দন্তের অগ্রভাগদুটি বিক্রয় করে প্রাপ্ত অর্থ তখন নিঃশেষিত। সে জানালো যে সেই অর্থে তার ঋণটুকুই শোধ হয়েছে কেবল। জীবিকানির্বাহের জন্য প্রভু যদি তাঁর দন্তদুইটির অবশিষ্টাংশ দান করেন তবে সে উপকৃত হয়।
আরও পড়ুন:

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা, পর্ব-৬: আকাশ এখনও মেঘলা

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৫: সরজমিনে
বনচরটি কিন্তু মিত্রদ্রোহী ছিল।
হাতিটি কিন্তু সম্মত হল। তবে তাই হোক। হলোও তাই। করাত যে প্রস্তুত ছিল।
তারপর আবার একদিন বনচর ফিরে এল। সংসার যে চলে না। জীবিকানির্বাহের জন্য প্রভু যদি তাঁর দন্তদুইটির মূলভাগটুকু দান করেন তবে সে উপকৃত হয়।
প্রভু কেবল বললেন “তথাস্তু”। তবে তাই হোক। হলোও তাই। করাত যে প্রস্তুত ছিল। সেই মিত্রদ্রোহী পাপিষ্ঠ তখন হস্তীর কৈলাশকূটতুল্য পৃষ্ঠে আরোহণ করে শুণ্ড মর্দন করে মাংস বিশ্লিষ্ট করে দন্তযুগলের মূল উত্পাটন করে নিল। বোধিসত্ত্ব এই ভীষণ উৎপীড়ন অক্লেশে সহ্য করলেন, কিন্তু পৃথিবী বুঝি তা সইতে পারল না।
হাতিটি কিন্তু সম্মত হল। তবে তাই হোক। হলোও তাই। করাত যে প্রস্তুত ছিল।
তারপর আবার একদিন বনচর ফিরে এল। সংসার যে চলে না। জীবিকানির্বাহের জন্য প্রভু যদি তাঁর দন্তদুইটির মূলভাগটুকু দান করেন তবে সে উপকৃত হয়।
প্রভু কেবল বললেন “তথাস্তু”। তবে তাই হোক। হলোও তাই। করাত যে প্রস্তুত ছিল। সেই মিত্রদ্রোহী পাপিষ্ঠ তখন হস্তীর কৈলাশকূটতুল্য পৃষ্ঠে আরোহণ করে শুণ্ড মর্দন করে মাংস বিশ্লিষ্ট করে দন্তযুগলের মূল উত্পাটন করে নিল। বোধিসত্ত্ব এই ভীষণ উৎপীড়ন অক্লেশে সহ্য করলেন, কিন্তু পৃথিবী বুঝি তা সইতে পারল না।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৩: নির্বাসিত অর্জুনের দাম্পত্যজীবনে নতুন সম্পর্কের বিচিত্র সংযোজন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৭: মা সারদার লিঙ্গপুজো
সেই বনচর শীলবান্ হস্তীর দৃষ্টিপথের বাইরে আসতেই ধরিত্রী দ্বিধা হলেন। যে ধরা অনাদি কাল থেকে সুমেরুতুল্য পর্বতাদির ভার বহন করছেন, দুর্গন্ধ মলাদির মহাভার গ্রহণসমর্থা বিপুলা পৃথিবী সেদিন এই পাপভার বহনে নিতান্ত অক্ষম হয়ে বিদীর্ণ হলেন। সেই মিত্রদ্রোহী বনচর প্রবেশ করলো জ্বালাময় রসাতলে। বৃক্ষবাসিনী বনদেবতা এই দৃশ্য দেখে বনভূমি নিনাদিত করে জানালেন যে, রাজচক্রবর্তীর পদ দান করেও অকৃতজ্ঞ ও মিত্রদ্রোহী মানুষের তৃপ্তি সম্পাদন করা যায় না।
জাতকমালার এই কাহিনী প্রতীকী, বলাবাহুল্য। অকৃতজ্ঞের জন্য “শেষের ভয়ংকর সেই দিন” অপেক্ষা করে। দেখা যায়, লালসা ও প্রতিবেশ এই বনচরকে ক্রমশঃ লোভী, মিত্রদ্রোহী করে তুলেছে। শুধু এই আপ্তবাক্যগুলিই শেষে জেগে থাকুক – “তুমি যে জীবন দিয়েছ আমায় কলঙ্ক যদি দিয়ে থাকি তায়/ আপনি বিনাশ করি আপনায় মোহের ভরে/ আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে”।
জাতকমালার এই কাহিনী প্রতীকী, বলাবাহুল্য। অকৃতজ্ঞের জন্য “শেষের ভয়ংকর সেই দিন” অপেক্ষা করে। দেখা যায়, লালসা ও প্রতিবেশ এই বনচরকে ক্রমশঃ লোভী, মিত্রদ্রোহী করে তুলেছে। শুধু এই আপ্তবাক্যগুলিই শেষে জেগে থাকুক – “তুমি যে জীবন দিয়েছ আমায় কলঙ্ক যদি দিয়ে থাকি তায়/ আপনি বিনাশ করি আপনায় মোহের ভরে/ আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে”।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।