ছবি: প্রতীকী।
সেবার বোধিসত্ত্ব এক গোধারূপে জন্ম নিয়েছেন। সেই গোসাপটি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে অরণ্যে বসবাস শুরু করল। কাছেই এক জটাজুটধারী অজিনবাস এক ব্রহ্মচারী তাপসের পর্ণকুটীর। সেই তাপস অত্যন্ত দুঃশীল। গোসাপটি নিত্যই তাপসের আশ্রমে চরতে যায়, তাঁকে প্রণাম করে আসে। এভাবেই দিন কাটছিল।
একদিন তপস্বীর শিষ্যগৃহ থেকে অতি উৎকৃষ্ট রসনাতৃপ্তিকর পক্ব স্বাদু মাংস এল। সেই মাংস খেয়ে অভিভূত তাপস শিষ্যদের প্রশ্ন করে জানতে পারলেন যে, তা গোধামাংস। তখন লোভে তাঁর চোখ চকচক করে উঠল। তিনি ভাবলেন, আশ্রমপ্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়ানো গোসাপটি বধ করেই তাহলে এমন তৃপ্তিকর মাংস রান্না করা যেতে পারে। তখন সেই ব্রহ্মচারী রসনাতৃষ্ণায় বিমোহিত হয়ে সত্বর ঘি, দই, মরিচ সংগ্রহ করে গৈরিক উত্তরীয়ের নিচে একটি মুদ্গর লুকিয়ে তাঁর পাতার কুটীরে অতিশয় শান্তশিষ্ট হয়ে বসে রইলেন।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৪: শ্রীমার গৃহী ভক্তদের সন্ন্যাসদীক্ষা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০২: দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি
গোসাপটি যথাসময়ে এল এবং তাপসের গায়ের গন্ধে চমৎকৃত হয়ে উপলব্ধি করল যে এই ব্যক্তি তার স্বজাতির মাংস আহার করেছে। সে সাবধান হয়ে গেল। চিনতে পারল ভণ্ড তাপসকে। সে আর তাপসের নিকটে গেল না, ফিরে যাওয়ার উপক্রম করল। তখন সেই তাপস আড়াল থেকে মুদগর বের করে ছুড়ে দিল গোসাপের দিকে। তার লেজ স্পর্শ করে পতিত হল মুদ্গর। ব্রহ্মচারী তাপসের ভালমানুষের মুখোশ খসে পড়ল নিমেষে। তিনি গোধাকে তর্জন করে বললেন “যথাস্থানে লাগল না বলে আজ বেঁচে গেলি!”
গোধা বলল “আমি তোমার কবল থেকে বাঁচলাম, কিন্তু তুমি বাঁচবে তো তোমার দুর্ভাগ্য থেকে?”
গোধা বলল “আমি তোমার কবল থেকে বাঁচলাম, কিন্তু তুমি বাঁচবে তো তোমার দুর্ভাগ্য থেকে?”
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৭: রাতচরা
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৫: ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এবং চলচ্চিত্র
এরপর আশ্রমের কাছেই এক বল্মীকের বিবরে প্রবেশ করে গোধা আত্মরক্ষা করল। সেখান থেকেই চীৎকার করে তপস্বীকে বলল, “ভণ্ড! তোমার প্রকৃত স্বরূপ আজ চিনেছি ঐ মুদ্গরপ্রহারে। এই কাষায়বস্ত্র, অজিনবসন, ঐ জটাজুটে কি লাভ যদি না মন ক্লেদমুক্ত হয়?”
তপস্বী তাকে তোষামোদ করে বললেন “হে গোধারাজ! অভিমান ভুলে নির্ভয়ে এসো। শালিধানের ভাত দেব, লবণ, পিপ্পলী, জীরক, আর্দ্রক সব দেব। তেল দেব। এখানে সব মুখরোচক খাদ্য প্রভূত পরিমাণে আছে। এসো, প্রাণ-মন-উদর-শরীর তৃপ্ত করো।”
তপস্বী তাকে তোষামোদ করে বললেন “হে গোধারাজ! অভিমান ভুলে নির্ভয়ে এসো। শালিধানের ভাত দেব, লবণ, পিপ্পলী, জীরক, আর্দ্রক সব দেব। তেল দেব। এখানে সব মুখরোচক খাদ্য প্রভূত পরিমাণে আছে। এসো, প্রাণ-মন-উদর-শরীর তৃপ্ত করো।”
আরও পড়ুন:
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৪: আমি তাইতে কি ভয় মানি!
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’
গোধা হেসে বলল “তোমার লবণ, পিপ্পলী খেলে আমার নিশ্চিত অহিত হবে। রে ভণ্ড জটাধারী কুটিল ধূর্ত! যদি আর এখানে থাকিস, তাহলে বনের ধারে যে গ্রাম আছে, যেখানে আমি চরতে যাই, সেখানে জানিয়ে দেব তোর প্রকৃত স্বরূপ। বলে দেব তুই বেটা চোর। ধরা পড়লে সর্বনাশ ঘটবে। যদি নিজের ভালো চাও, পালাও।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে
সন্তান কম মনোযোগী কিন্তু অতি সক্রিয়? সহজ উপায়ে বাড়িতেই এর চিকিৎসা সম্ভব
br>আমাদের গল্পটা এই পর্যন্তই। চেনা চেনা লাগে তো এই ঘটনাপরম্পরা? ইন্দ্রিয়জ দুর্বার আকাঙ্ক্ষা ও অনৈতিক লোভ সুখকর নয়। যে অজ্ঞানতার মোহবন্ধন ঢেকে রেখেছে বোধ, চেতনাকে মুদ্গরের আঘাতে সেই মোহ ছিন্ন হয়ে সত্য আবির্ভূত হয়। তার বাহ্যিক আড়ম্বরে সত্যনিষ্ঠার প্রকাশ ঘটে না। ব্যক্তিগত আচরণ, বিশ্বাস ও মানসিক বৃত্তিতেই তার যথার্থ পরিচয়। এই কাহিনি ক্লিষ্ট লালসা, জিঘাংসার ঊর্ধ্বেও সেই আলোকপ্রাপ্তির কথা বলে।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।