শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

গীতা শরণাগত, প্রপন্নকে স্থিতধী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। যিনি ব্যাকুল হয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইছেন বিপরীতের আশ্রয়ভূতকে, তাঁর মানসিক বিচলন অস্বাভাবিক নয় হয়তো, কিন্তু সেটাই সত্য নয়। যে অজ্ঞানের অন্ধকার তাঁকে ঢেকে রেখেছিল, সেই অন্ধকার যখন কেটে যাচ্ছে শাস্ত্রোপদেশে, বুঝতে পারছেন যা মনোজগতে প্রতিভাত হয়, তা সদাসর্বদা হয়তো ধ্রুব নয়, যে ভাবনা আপাতভাবে জাগতিক, মরজগতের দুঃখসুখশোক-সংশ্লিষ্ট, সেই ভাবনা তাৎক্ষণিক মানসিক অভিঘাতে সত্য বলেই বোধ হয় বুঝি, কিন্তু প্রাজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই সার ও অসারের, শ্রেয়ঃ ও প্রেয়ঃ-র, আপাত ও ধ্রুব, ক্ষুদ্র ও মহতের দূরত্ব ও ভেদ অবগত হন, অবগত হয়েই তাঁরা শোকোত্তীর্ণ হন, তত্ত্ববিদ্ হন লোকোত্তীর্ণ। যুগে যুগে বৈকল্য ও জাড্যকে নিস্তীর্ণ করে অনন্ত সম্ভাবনার দ্বার এভাবেই উন্মুক্ত হয়েছে।
প্রপন্ন, অবসন্ন, কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষ ধীরে ধীরে বীতশোক হন। স্থিরলক্ষ্য ও বীরধর্মে দীক্ষিত যিনি, কর্তব্যের পরিপালনে অবিচল যে বীর, তাঁর মোহাবিষ্ট হৃদয়ের অচিনপুরে উদার অভ্যুদয় ঘটল অন্তর্যামী, অন্তরতম, জীবনদেবতা, সখার।

তিনি জানাবেন, এই আত্মোদ্বোধনের জন্য প্রাথমিক কর্তব্য হল দিকে দিকে ধাবিত চঞ্চল, অস্থির চিত্তকে রূপাদির আসক্তি থেকে নিবৃত্ত করা। তারপর সেই নিবৃত্ত সংযত চিত্তকে আত্মবশীভূত করা।

সংযম এই নবতর যাত্রার মূল কথা। রাগদ্বেষাদির নিয়ন্ত্রণ করে বৃহত্ চেতনের সঙ্গে চিত্তকে একীভূত করে, সংযতাত্মা মানুষ তখন সর্বজীবে সেই মহাচেতনের অস্তিত্বকে অনুধাবন করেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৪: ‘…জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়’, লরেন্স ও ফ্রিডা/২

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৭: প্রবল অজেয় বাণী তব

অসংযম জাগতিক দ্বন্দ্বের মূলগত। পারস্পরিক বিদ্বেষ কিংবা জুগুপ্সা, ঈর্ষা কিংবা পরশ্রীকাতরতা, অহংবোধের দুর্দমনীয় আকর্ষণ কিংবা পরপীড়ায় সুখানুভূতি মানুষকে সদাসর্বদা ঘিরে রেখেছে। নাগরিক জীবনে, রাষ্ট্রজীবনে, ব্যক্তিজীবনে অথবা সংসারে পরপ্রবঞ্চনা ও আত্মপ্রবঞ্চনার দুর্বিপাক মানুষের অহংবোধকে নিয়ত তৃপ্ত ও আগ্রাসী করে তুলছে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১০: মানুষের পাশে, মানুষের কাছে

হ্যালো বাবু!, পর্ব-৬৭: গুগলি/২

নশ্বর মরজগতের চতুর্দিকেই সেই মহাসংগ্রাম চলছে, মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়ে চলেছে নিত্য নিয়মিত জীবের অন্তর্দেশে, জ্ঞাতসারে, অজ্ঞাতসারে। সত্য, আদর্শ থেকে বিচলন, মহাবিচ্যুত আন্তরসত্তার অন্তরালেই আছে অসহায়, অসুখী, ভীতচকিত, শোকজর্জর একটি মুখ। অথবা আছে নিশ্চেতন, অজ্ঞানাচ্ছন্ন, ক্ষুধা-নিদ্রা-কাম-দ্বেষে পরিকীর্ণ হতচেতন সত্তা। আজ সকলেই সমাগত জীবনের রণাঙ্গণে।

যিনি উপলব্ধি করেছেন আত্মস্বরূপ, নিজের বিচ্যুতি ও শক্তি তাঁর আত্মজাগরণ ঘটেছে। তাঁর ক্লেদজর্জর বিশীর্ণ হৃদয়ের গোপনলোকে যে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তা ক্রমশঃ নিয়ে যাবে চিত্তশুদ্ধির দিকে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৬: সুন্দরবনের পাখি — কুবো

যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১

যিনি বীর অথবা ভীরু, যিনি উদ্যমী অথবা কাপুরুষ, যিনি যথার্থবেত্তা ধীমান কিংবা অজ্ঞানাচ্ছিত মূঢ়, তাঁরা সকলেই জীবনের কোনও কালপর্বে স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত হতে পারেন। মুনিদের-ও মতিভ্রম হয় বৈকী! কিন্তু ভ্রমে জীবন চরিতার্থ হয় না। জগতের গোপনপুরে নিত্যই যে মাধুর্যের অন্তঃসলিলা প্রবাহিণী, তার সান্নিধ্য-ই মানুষকে অমৃত করে। যে সংযতচিত্ত মানুষ অজ্ঞান থেকে আলোকে উত্তীর্ণ হন আত্মজাগরণের নিত্য অভ্যাস, অনুশীলন, শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসনের মধ্য দিয়ে, তিনিই জগতে সার্থক হন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০১: অর্জুন প্রমাণ করলেন, রাজধর্ম পালনের ক্ষেত্রে মিথ্যাচারের কোনও স্থান নেই

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০১: সরষের মধ্যে ভূত

তিনি ঔদ্ধত্য কিংবা ঔদাসীন্য থেকে ঔদার্যের এক সত্যসুন্দরলোকে আরূঢ় হন যেখানে নিজের সুখ ও অপরের সুখের মধ্যে ভেদ থাকে না, নিজের দুঃখবোধ ও অপরের দুঃখবোধ অভিন্ন হয়। সেই মানুষ ক্রমশঃ দুঃখ ও সুখকে জয় করেন। শুভ কর্মের আচরণের মধ্য দিয়েই এই যাপনের সূত্রপাত। ভোগাদি সংকীর্ণতামুক্তচিত্ত মানুষ সেই যাপনের পথে বহুদূর অগ্রসর হয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত আত্মপরাদির ভেদমুক্ত, অনুদ্বিগ্ন, বিগতস্পৃহ, নিবিষ্টচিত্ত, নিবেদিতপ্রাণ, মুক্তচেতা ও জ্ঞানী ব্যক্তিই লোকোত্তর প্রজ্ঞায় উত্তীর্ণ হন। —চলবে।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content