
ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলাভাষার হাত ধরে এই স্বীকৃতি এসেছিল। সুকুমারের একুশে আইন কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারির ভোর পেরিয়ে বাংলাভাষা অনেক পথ হেঁটেছে। জীবনের অনেক লেন, তস্যগলি, রাজপথ পেরিয়ে আজ কিছু আত্মসন্ধানের প্রয়োজন থাকে।
শিশু আজন্ম যে ভাষার পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠে সেটাই তার মাতৃভাষা। মাতৃভাষা কী এবং কেন, তার সংজ্ঞা রাষ্ট্র ও সমাজতত্ত্বের পথ ধরে জানা যায়। বাংলাভাষা একদা রক্তে মাটি ভিজিয়ে তার অধিকার বুঝে নিয়েছিল। তারপর গঙ্গায় পদ্মায় অনেক জল বয়ে গেছে, অনেক ঢেউ উঠেছে। দিনকাল বদলে গিয়েছে। ভাষাকেন্দ্রিক আবেগ, অনুভূতি, আকর্ষণ ও স্বার্থের সংজ্ঞা, মানদণ্ড বদলে গিয়েছে।
শিশু আজন্ম যে ভাষার পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠে সেটাই তার মাতৃভাষা। মাতৃভাষা কী এবং কেন, তার সংজ্ঞা রাষ্ট্র ও সমাজতত্ত্বের পথ ধরে জানা যায়। বাংলাভাষা একদা রক্তে মাটি ভিজিয়ে তার অধিকার বুঝে নিয়েছিল। তারপর গঙ্গায় পদ্মায় অনেক জল বয়ে গেছে, অনেক ঢেউ উঠেছে। দিনকাল বদলে গিয়েছে। ভাষাকেন্দ্রিক আবেগ, অনুভূতি, আকর্ষণ ও স্বার্থের সংজ্ঞা, মানদণ্ড বদলে গিয়েছে।
যে কোনও ভাষার একটা যাত্রাপথ ও পরিবর্তনের পরিসর থাকে। আজ যাঁরা স্বেচ্ছায় শাক্তপদাবলী, মঙ্গলকাব্য হাতে তুলে নিচ্ছেন, তাঁরা বাংলাকে শক্তি দিচ্ছেন, বাংলার মঙ্গল করছেন। বাংলাভাষার ক্ষেত্রে কৃত্তিবাস বা ভারতচন্দ্রের ভাষাশৈলী, বঙ্কিমকে অতিক্রম করে বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, নজরুল-রবীন্দ্রনাথের নানা পর্যায় পার হয়ে কল্লোলযুগের ভাঙাগড়া, রবীন্দ্রপূর্বের বিহারীলাল কিংবা রবীন্দ্র-সমকাল, বাংলাভাষার উত্তরকাল, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে, শক্তি-সুনীল-ভাস্কর কিংবা উত্তরাধুনিক এবং সমকালীন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার বিস্তৃত পরিসরে পৃথিবীজুড়ে যাঁরা বাংলায় বাধ্য হয়ে কথা বলেন, যাঁরা ভালোবেসে কথা বলেন, যাঁরা সাহিত্যিক, যাঁরা শব্দশিল্পী বা অক্ষরশ্রমিক, যাঁরা বাংলায় লেখালেখি করেন জীবিকার জন্য, দায় বা দায়িত্ববোধ থেকে, তাঁরা প্রতিদিন ভাষাটাকে প্রাণবায়ু দিচ্ছেন, বাঁচিয়ে রাখছেন, এগিয়ে দিচ্ছেন, সম্মানিত করছেন, সমৃদ্ধ করছেন।
আরও পড়ুন:

আমি বনফুল গো: তিনিই ছিলেন ভারতীয় ছবির প্রথম সিঙ্গিং সুপারস্টার/১

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৩: ভাগ্যের দোহাই দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায় না
বাংলাভাষা তার অন্দরে, অন্তরে নানা সংস্কৃত এবং নব্যভারতীয় ভাষার শব্দমালা বহন করছে। বহন করছে বহু দেশি ও বিদেশি শব্দ। সব মিলিয়ে বাংলার একটা স্বকীয় আঙ্গিক গড়ে উঠেছে। অন্য ভাষার শব্দ নিয়ে ভাষা সমৃদ্ধ হবে কিন্তু কখনোই স্বাতন্ত্র্য হারাবে না, এটাই তার বেঁচে থাকার মুখ্য শর্ত। বাঁচার প্রশ্ন আসে, কারণ এই মুহূর্তেই পৃথিবীজুড়ে অজস্র ভাষা বিলুপ্ত, বহু ভাষা বিপন্ন, অনেক ভাষাই বাড়ছে, অনেকে কমছে, অনেকেই অন্যভাষার চাপে নাভিশ্বাস তুলছে। পাশাপাশি এটাও সত্য যে, ভাষার মৃত্যু নেই, তার চর্চা জেগে উঠলেই ভাষার পুনরুজ্জীবন ঘটে। বাংলা বাঙালিদের মাতৃভাষা। যাদের মাতৃভাষা নয়, তাঁরাও বাংলায় কথা বলেন। অনেকে আজন্ম বলেন। অনেক বাঙালি বাংলায় কথা বলেন না। আজন্ম কথা বলেন না।
বাংলাভাষা তার অন্তরে ভারতীয় ব্যাকরণ, ঔপনিষদিক ভাব, উন্মুক্ত চেতনা, বিশ্বদর্শন ও বিপুল শক্তি-সম্ভাবনা বহন করছে। ভারতীয় সংবিধানে বাংলাভাষার বিশেষ স্থান আছে। সদ্য এই ভাষা ধ্রুপদীভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। সর্বোপরি, বাংলাভাষার একটা বিশ্বজনীন রূপ আছে, এগুলো আশার কথা।
বাংলাভাষা তার অন্তরে ভারতীয় ব্যাকরণ, ঔপনিষদিক ভাব, উন্মুক্ত চেতনা, বিশ্বদর্শন ও বিপুল শক্তি-সম্ভাবনা বহন করছে। ভারতীয় সংবিধানে বাংলাভাষার বিশেষ স্থান আছে। সদ্য এই ভাষা ধ্রুপদীভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। সর্বোপরি, বাংলাভাষার একটা বিশ্বজনীন রূপ আছে, এগুলো আশার কথা।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৩: গ্রহের ফের

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা/৫
বুদ্ধিমান বলে নন্দিত বাঙালি বহুবিষয়ের পুরোধা হয়েছে অতীতে, বর্তমানেও। নিন্দিত হয় আত্মঘাতী, আত্মবিস্মৃত বলে। এরমধ্যে কোনটা যথার্থ, কোনটি নয় তার বিতর্ক তুলে রেখে কয়েকটা কথা বলে নেওয়া যায়। যে কোনও ভাষাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র ও সমাজ আবর্তিত হয়। ভাষার ওপর রাষ্ট্রের প্রভাব থাকে, রাজনৈতিক শক্তি, ক্ষমতা ও দ্বন্দ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র থাকে। থাকে সমাজদর্শন, আর্থিক পরিস্থিতি, যুগবাহিত বিশ্বাস, আজন্মলালিত স্বপ্ন, ব্যক্তিগত প্রবণতা, গোষ্ঠীর শিক্ষা, চেতনা, মানসলোক ও পরিবেশের ভালোমন্দ প্রভাব। ঔপনিবেশিক ভাবধারায় জারিত প্রজন্মের, উত্তরপ্রজন্মের বিশ্ববোধ ও বিশ্বাস বাংলাভাষার, বাঙালির জাতীয় জীবনে দীর্ঘ ছায়াপাত করেছে। তার ফলশ্রুতিতেই বাংলাভাষায় আরেক ক্রান্তিকাল এসেছে।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১৭: কুক্কুটজাতক-চিনে নাও বন্ধু কে?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৭: উত্তরণ-অবতরণ শেষে স্বপ্নের ‘সূর্যতোরণ’
পরিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মে কিংবা অনিয়মে ইং-বং, হিং-বং হয়ে ওঠা কথ্য বাংলা, গতি হারানো, বিকৃত নগরসজ্জার, বিজ্ঞাপণের কিংবা রেলস্টেশনের বাংলা, মেগাসোপের ফিউশন বাংলা যে ভবিষ্যত্কে দেখায় তার সত্তা ও বোধ অন্যরকম বৈকী। নানা উপভাষা, আঞ্চলিক প্রবণতা, নিত্যনতুন সার্থক প্রয়োগ, যেকোনো সদর্থক প্রয়াস সবটা নিয়েই বাংলাভাষা। যা কিছু মহান তাকে বিনম্র শ্রদ্ধায় গ্রহণ করায় কোনও গ্লানি থাকে না, তবে সত্তাকে ত্যাগ করে, অন্ধ অনুকরণে ঘর ও বাহির দুটোই আহত হয়, কোনওটাই সেভাবে থাকে না, বলাবাহুল্য।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০২: ভরতের মতো একমুখী লক্ষ্যে এগিয়ে চলা কী সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১২: দারুণ এক গগনবিহারী খেলনা বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ
বাংলাভাষা ডিজিটাল হয়েছে। সমাজমাধ্যম, আন্তর্জালের হাত ধরে আন্তর্জাতিক বাঙালি নতুন করে বিশ্বনাগরিক হয়েছে। শুধু বাংলাভাষা বলেই নয়, পৃথিবীটা সকলের কাছেই ছোট হতে হতে বিশ্বগ্রাম হয়েছে সেই কবেই! আজ একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বের সকল বিপন্ন ও সম্পন্ন ভাষার দিন। বাংলাভাষার দিন। বাংলা বিপন্ন নাকি সম্পন্ন তা ভবিষ্যত্ বলবে। বর্তমান নানা ইঙ্গিত দিচ্ছে। ঔদাসীন্যের পাশেই মোদের গরব মোদের আশা থাকবে। ঔদ্ধত্যের পাশেই ফুটবে রক্তগোলাপ। বঞ্চনার পাশেই আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা আসন পেতে নেবে। এভাবেই সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসবে বাংলাভাষা, সেই ভাষায় পাখির সুরে কথা বলা বাঙালি। প্রশ্নটা থেকে যায় বোধ, বিশ্বাস ও মানসিকতার। ভাষার জন্য কোনটা লাগে, হিসেব না আবেগ? নিজের ভাষায় একান্ত আপন হাসি-কান্না কি বিন্দাস রাখতে পারছে না আজকাল? যে ভাষা হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছে, যে ভাষাতেই বাংলার মুখে ফুটে ওঠে বিশ্বের সৌন্দর্য, যে ভাষাতে “আসছি” বলেই বিনা আড়ম্বরে চলে যাওয়া যায়, সেই ভাষার সীমাবদ্ধ রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি ও হেরে যাওয়া পুঁজিবাদী হতাশার ওপারেও যুগে যুগে জেগে থাকা অনুভূতিমালা, ঝরে পড়া মাধুর্যে সমকাল সেভাবে আন্দোলিত হতে পারছে না কেন? কেন?
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।