শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


বার্নার্ড শ এবং শার্লটি।

বিয়ে নরনারীর যৌন সম্পর্কের সিলমোহর। সেই সম্পর্ক ও তথাকথিত মাতৃত্বের প্রতি তীব্র অনীহা ছিল শার্লটির। শার্লটি এবং শ দু’জনেই বিয়ে ও তার পরিপূর্ণতার প্রতি এক বিদ্বেষ পোষন করতেন। শার্লটি তার এই অস্বাভাবিক মানসিকতার ব্যাখ্যা খুঁজে নিতেন তার শৈশবের পরিবেশ থেকে। শিশুদের নিয়ে তার মন্তব্য শুনে চমকে যেতে হয়। মনে হয় তিনি এক চরম সন্ত্রস্ত নিউরোটিক মহিলা। “Babies! Who could like them? Disgusting little things.”
শিশুর প্রতি তার এই বিরূপ মনোভাবের কারণ খুঁজে নিয়েছেন নিজের শৈশবে। লেখক প্রমথনাথ বিশীর মতে, মানুষ বোকাও নয়। বুদ্ধিমানও নয়। কিন্তু মানুষের ততটুকু বুদ্ধি আছে যা দিয়ে তার সবরকম আচরণেরই ব্যাখ্যা খুঁজে নিতে পারে।
শার্লটির পরিচালন ক্ষমতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন শ। সম্ভবত এই পরিচালন দক্ষতা এবং যৌন সম্পর্কের প্রতি অনমনীয়তা শ’কে ‘Saint Joan’ এর চরিত্র চিত্রনে সাহায্য করেছে। এই অনমনীয়তা মেনে শ এবং তার স্বামীর অধিকার দাবি করেননি। অবশ্য কারণটা অন্য। তার মনে হত শার্লটির যৌবন পুরুষকে কোনওভাবেই আকৃষ্ট করতে পারে না। শ এর কাছে শার্লটি দয়িতার প্রেম নয়, মাতৃ স্নেহের উৎস। তাই সহজেই স্বামীর দাবি ছেড়ে দেয়া যায়। একবার সুন্দরী ‘Ellen Terry’র কাছে শ শার্লটির বর্ণনা করতে গিয়ে লেখেন, “ও এক মহিলা যার দিকে কেউ দু’বার তাকাতে চাইবে না। বয়েস সাইত্রিশ কিন্তু দেখে মনে হয় চল্লিশ হয়ে গিয়েছে।”
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৫: বার্নার্ড শ ও শার্লটি—যদি প্রেম দিলে না প্রাণে/১

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৪: যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না?

এছাড়া শ নিজে এবং স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্কের প্রতি নিস্পৃহ ছিলেন। তার উদ্দেশ্য মহিলাদের আকৃষ্ট করা, প্রেমের ভান করা। আসলে এসব যেন তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেখানোর এক অদম্য ইচ্ছার ফল। ১৯৪৯ সালে তিনি তার বিয়ের সমর্থনে লিখলেন, “স্বামী ও স্ত্রী হিসেবে আমরা এক নতুন সম্পর্ক স্থাপন করেছি, যাতে যৌন সম্পর্কের কোনও স্থান নেই। এর সুফল হল, আমাদের এতদিনের বিভিন্ন রকমের প্রেমের খেলা, নতুন নতুন প্রেমিকাকে আকৃষ্ট করা, এসবের ইতি টানতে পেরেছি। আমরা স্থিত এক সম্পর্কে প্রবেশ করেছি।”

এসব বুক ফুলিয়ে দাবি করলেও বৃদ্ধ বয়সে কিন্তু শ ছেলেমেয়ে হয়নি বলে আক্ষেপ করেছেন। তবে ছেলেমেয়ে হলে শার্লটি যে ভয়ানক অশান্ত হয়ে উঠতেন, নিয়ত ঝগড়া করতেন, এটাও তার মনে হয়েছে। সর্বোপরি শ চাইলেও শার্লটি নিশ্চিত ছেলেমেয়ে চাইতেন না। শারীরিক সম্পর্ক ছাড়া বিয়ে স্থির করে শ এবং শার্লটি দু’জনে বেশ সুখী দম্পতি হয়ে কাটিয়েছেন প্রথম দিকে।

শার্লটি তার প্রচুর টাকাপয়সা দিয়ে শ এর জন্য পার্থিব সব আরামের আয়োজন করলেন। শ-ও তার কর্তৃত্ব মেনে লক্ষ্মী ছেলেটি হয়ে কিছুদিন কাটালেন। শার্লটি কিন্তু শ এর বুদ্ধিমত্তা ও প্রতিভাকে সম্ভ্রম করতেন। শ এর জন্য নিজে টাইপ রাইটিং শিখলেন, তার সেক্রেটারির কাজ করলেন। ঐতিহাসিক নাটকগুলোর জন্য গবেষণার কাজটি করে দিলেন। স্বামী ও তার লেখালেখির জগতের মধ্যে মধ্যস্থতা করলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫২: হিতকারী মূর্খ বন্ধুর থেকে একজন পণ্ডিত শত্রু থাকা ভালো

তাদের সুপ্ত শারীরিক চাহিদা অন্যভাবে প্রকাশিত হল, বিশেষত শার্লটির ক্ষেত্রে। শার্লটির রাক্ষুসে খিদে দেখা দিল। তার সঙ্গে সবসময় ঘুরে বেড়ানোর প্রবল ইচ্ছে। শ ঠিক এর বিপরীত। শ নিরামিষাশী, খাবারের বিষয়ে খুঁত খুঁতে, চুপচাপ খেতে ভালোবাসেন। অন্যদিকে শার্লটি পাহাড় প্রমাণ খাবার নিয়ে বসেন। Sean O’Casey লিখেছেন, শার্লটির প্লেট এ খাবারের এক বিরাট স্তুপ, তার ওপর পুরু সসের স্তর। ঝুঁকে চামচ ভর্তি খাবার মুখে তুলে গপ করে গিলে ফেলতেন।
তার ওপর সারাক্ষণ ঘুরতে চাইতেন। শ তার কাজ নিয়ে নিজের জায়গাটি ছেড়ে নড়তে চাইতেন না। শার্লটি খুব অশান্তি করতেন। বাধ্য হয়ে শ একবার বেরোলেন। হয়তো মনের অবদমিত ইচ্ছের ফলে এক প্রচণ্ড দুর্ঘটনা ঘটল। গাড়ি পড়লো খাদে। শ এর আঘাত গুরুতর নয়। শার্লটির মাথায়, হাতে, পিঠে সব জায়গায় প্রচণ্ড আঘাত লাগলো। কিন্তু এতে দমলেন না। ৭৫ বছরের এই বৃদ্ধ দম্পতি বছর শেষে পৃথিবী ভ্রমণে বেরোলেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৯: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—কালি লতা ও পান লতা

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪৭: ও বন্ধু তুমি শুনতে কি পাও?

দু’জনেই বেশ অনেক বয়েস পর্যন্ত বেঁচেছেন। শ বেশ সুস্থ ছিলেন ১৯৫০ সাল পর্যন্ত। ওই বছর বাগানে কাজ করতে গিয়ে তার পা ভেঙে যায়। ১৯৩৯ এ শার্লটির নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়। তারপর এক দুরারোগ্য হাড়ের অসুখে প্রায় অচল হয়ে পরেন। ১৯৪৩ সালে শার্লটির মৃত্যুর আগে পর্যন্ত শ তাকে পরম যত্নে দেখাশোনা করেন। শেষের দিকে রোজ রাতে শ তাকে গান শোনাতেন। তারপর রাত এগারোটায় ঘুমোতে যেতেন। শার্লটির মৃত্যুর পর তিনি পিয়ানোতে হাত দেননি।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৩: মিলাডা—বিদেশিনীর হরফ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

বিয়ে করলেন, কিন্তু বিয়েকে পরিপূর্ণতা দেবেন না, এমন চুক্তিবদ্ধ হয়ে বার্নার্ড শ এবং শার্লটি প্রায় মধ্যবয়েসে একসঙ্গে হলেন। দুজনেই আত্মম্ভরি, নিজের মত মতো থাকা বজায় রাখলেন। শার্লটি তার প্রাচুর্য, খাওয়াদাওয়া, বেড়ানো সব নিয়ে কাটালেন। কিন্তু অসন্তোষে অসুখী হয়েই রইলেন। শ অনেক খ্যাতি প্রতিপত্তি পেলেন। মেয়েদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়েও ছিলেন। কিন্তু সেই অবদমিত আবেগগুলো রইল, মানুষের স্বাভাবিক অনুভূতিগুলির উৎসারণ ঘটলো না। চিরকাল যেন আপন সত্ত্বাকে আড়াল করেই রইলেন। মানুষের সম্পর্কের ভালোবাসার মাধুর্য তার অজানাই রয়ে গেল।—চলবে।
*ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content