
এ পর্যন্ত মনে হচ্ছে লরেন্স রা বেশ সুখী দম্পতি। কিন্তু তাদের মাঝে মাঝেই যে বিস্ফোরক ঝগড়া হতো সে সব বর্ণনা শুনে সবাই ধন্দে পরবে, এ কেমনতরো সুখ। তাদের ভয়াবহ ঝগড়া মারামারি দেখে কেউ তাজ্জব বনেছেন, কেউ ভয় পেয়েছেন, মনে করেছেন এই বুঝি ছাড়াছাড়ি হল, একটা হেস্তনেস্ত হল, আবার কেউ বিস্মিত হয়েছেন পরমুহূর্তে ই তাদের ভালোবাসা দেখে। অনেকে ই তার সাক্ষী এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ননা দিয়েছেন। তবে এ ঝগড়া তাদের দৃঢ় সম্পর্কের এক মূল বৈশিষ্ট।
ব্রিজিট প্যাটমোর (Brigit Patmore) এর মনে হয়েছে ফ্রিডা যেন লরেন্সের রাগ উস্কে দিয়ে মজা পেতেন, বাঘিনী যেমন তার বাচ্চাদের ঝগড়া, মারামারি দেখে মজা পায়। সিসিলি ল্যাম্বার্ট (Cecily Lambert) এর মতে লরেন্স সুযোগ খুঁজতেন ফ্রিডা কে অপদস্ত করার, তা ঈর্ষা থেকেই হোক বা প্রচণ্ড বিরক্তি থেকেই হোক না কেন। ফ্রেডরিক লেইটন (Frederick Leighton) বলেছেন, তিনি শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে কাউকে লরেন্সের মত স্ত্রীর প্রতি এত অশালীন কথার স্রোত বইয়ে দিতে দেখেননি। তাও আবার বহিরাগত দের সামনে। হিতাহিত, শোভন অশোভন সবরকম জ্ঞান শূন্য হয়ে লরেন্স অনবরত চিৎকার করে ঝগড়া করতেন। সাধারণত সামান্য কোনও মতানৈক্য থেকে ঝগড়া শুরু হতো।যেমন লরেন্স বললেন,এটা এমন কিছু ব্যাপার নয় যে জোরে বলতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে অবধারিত ভাবে ফ্রিডা বলবেন আমি জোরেই বলব। লরেন্স ফ্রিডার ধূমপান নিয়ে, চুল কাটা নিয়ে, খেতে ভালোবাসা নিয়ে সব নিয়েই আপত্তি জানতেন ও ঝগড়ায় ফেটে পরতেন। এমনকি ফ্রিডা তার বাচ্চাদের কথা বললে, বা তজ্জনিত তার চোখে জল দেখলেও লরেন্স ক্ষোভে ফেটে পরতেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৪: ‘…জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়’, লরেন্স ও ফ্রিডা/২

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭১: ধর্মকার্যের জন্য টাকা জোগাড় করা আর সাদা কাপড়ে ময়লা লাগিয়ে ধোয়া, দুই-ই সমান
প্রত্যক্ষদর্শী মারি’র (Murry) দেখা ঝগড়ার এক ঝলক, লরেন্স ফ্রিডাকে বললেন, এই শেষ। আর তোমার সঙ্গে থাকা যাবে না। অসম্ভব। তুমি জানো আমার কি টাকা-পয়সা আছে। তোমার ভাগেরটা দিয়ে দিচ্ছি। বেরিয়ে যাও। বলে ওপর তলার থেকে এসে টেবিলের ওপর গুনে গুনে ষোল sovereign (মুদ্রা) রাখলেন। ফ্রিডা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। হাতে টুপি ও কোট। কোথায় যাবেন জানেন না। হাপুস নয়নে কাঁদছেন। (তারপর যে ভয়ানক কিছু হয় নি তা বলাই বাহুল্য) আরেকদিনের এক ঝলক, মারি’র স্ত্রী ক্যাথরিন ম্যানসফিল্ডের দেখা, ফ্রিডা বললেন, শেলির লেখা ‘Ode to a Skylark’ কবিতাটার কোনও যথার্থতা নেই। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল। তুমি কিছুই জানো না, কবিতাটা পড়নি। অশিক্ষিত…এবার ফ্রিডার পালা। অনেক হয়েছে। আর নয়। আর তোমার সঙ্গে থাকা নয়। মুখ বন্ধ কর নইলে বেরিয়ে যাও।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০২: অন্ধকারে কে?

হ্যালো বাবু!, পর্ব-৬৮: গুগলি/৩
লরেন্স বললেন, এক থাপ্পড়ে মুখ বন্ধ করে দেব। ক্যাথরিন এরপর চলে গেলেন। রাতে খাবার সময় এসে দেখেন ফ্রিডা বাগানে অন্ধকারে ঘুরছেন আর বলছেন, সব সম্পর্ক শেষ। লরেন্স কোথায় যেন ছিলেন। ছুট্টে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ফ্রিডার ওপর। মারতে মারতে মুখে মাথায় গায়ে …যেন শেষ করে ফেলবেন। চিৎকার, গালাগাল, কান্নাকাটি, সে এক ভয়ানক দৃশ্য। বাইরে থেকে মারামারি করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকলেন দু’জনে। লরেন্স রাগে এক অন্য মূর্তি ধারণ করেছেন। দু’জনেই মারি’কে ডাকাডাকি করছেন বাঁচানোর জন্য। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে ধপ করে এক চেয়ার এ বসে পরলেন লরেন্স। ফ্রিডা কাঁদতে কাঁদতে আরেক চেয়ারে। বিধ্বস্ত অবস্থা তার। জামা ছেঁড়া, চুল ছেঁড়া। লরেন্স চুপ করে মেঝের দিকে চেয়ে আছেন। দু’জনের বাক্য বিনিময় নেই। ক্যাথরিন স্বস্তি পেলেন। ঝড় থেমেছে। আর পরদিন সকালে ক্যাথরিন দেখলেন লরেন্স খুব দ্রুত, ঝগড়ায় যে তৎপরতা ছিল তার চেয়েও তৎপর হয়ে, ফ্রিডার ব্রেকফাস্ট তৈরি করে তার শোয়ার ঘরে দিয়ে এলেন। তারপর ফ্রিডার টুপি ঠিক করতে বসলেন।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৭: সুন্দরবনের পাখি — ফিঙে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৬: জীবন নিয়ে কৌতুক আর ‘যৌতুক’
অনেকবার এরকম ঝগড়ার পর মনে হয়েছে এই বুঝি তাদের ছাড়াছাড়ি হল। ১৯২৩ এ একবার ভয়ানক ঝগড়ার পর মনে হল সেটাই তাদের একসঙ্গে থাকার শেষ। ফ্রিডা একা হ্যাম্পস্টেডে একটা ছোট ফ্লাট এ চলে গেলেন। ফ্রিডা ভাবলেন তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকবেন। কিন্তু তারা ততদিনে বড় হয়ে গিয়েছে এবং মাকে আর চায় না। ফ্রিডাকে লরেন্স ও ছেলেমেয়ে সবাই ত্যাগ করেছে। খুব একা মনে করতে লাগলেন। মারিকে সঙ্গী হিসেবে ডেকে পাঠালেন। ফ্রিডা ও মারি একসঙ্গে জার্মানি চললেন। মারি ফ্রিডার সঙ্গে থাকলেও লরেন্স এর থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি। লরেন্সের এক বন্ধু ফ্রিডাকে লরেন্সের অযোগ্য স্ত্রী বলায় ফ্রিডা মন্তব্য করেন, “Try it yourself,living with a genius,see what it is like and how easy it is,take him if you can”.
লরেন্স ছিলেন চির রুগ্ন। ১৯৩০ সালে মৃত্যুর আগে ফ্রিডা কে বলেন যে, পনেরো দিন বয়েস থেকে তার ব্রঙ্কাইটিস। ডাক্তারের মতে দীর্ঘদিন তিনি যক্ষা রোগ নিয়ে চলেছেন। চিকিৎসা করতে চাইতেন না। ফ্রিডাও এতে সায় দিতেন। ফ্রিডার মতে, হাসপাতালের রুদ্ধ ঘরে লরেন্সের সৃজনিশক্তি রুদ্ধশ্বাস হবে। বরং ফ্রিডার শক্তি তাকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলবে। শুনে হাকসলি ফ্রিডা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “the most maddening woman I think I ever came across.”
লরেন্স ছিলেন চির রুগ্ন। ১৯৩০ সালে মৃত্যুর আগে ফ্রিডা কে বলেন যে, পনেরো দিন বয়েস থেকে তার ব্রঙ্কাইটিস। ডাক্তারের মতে দীর্ঘদিন তিনি যক্ষা রোগ নিয়ে চলেছেন। চিকিৎসা করতে চাইতেন না। ফ্রিডাও এতে সায় দিতেন। ফ্রিডার মতে, হাসপাতালের রুদ্ধ ঘরে লরেন্সের সৃজনিশক্তি রুদ্ধশ্বাস হবে। বরং ফ্রিডার শক্তি তাকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলবে। শুনে হাকসলি ফ্রিডা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “the most maddening woman I think I ever came across.”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০১: অর্জুন প্রমাণ করলেন, রাজধর্ম পালনের ক্ষেত্রে মিথ্যাচারের কোনও স্থান নেই

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১১: মৃণালিনীর মৃত্যুর পর বিবাহ-প্রস্তাবের মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ
ফ্রিডা লরেন্সকে জিজ্ঞাসা করেছেন, আমি তোমায় কি দিয়েছি যা অন্য মেয়েরা দিতে পারেনি? লরেন্স স্বীকার করেন, আমায় নিজের ওপর বিশ্বাসী করে তুলেছো। ফ্রিডাকে ভালোবেসে লরেন্সের সৃষ্টিসত্বার উন্মেষ ঘটেছে, কারণ ফ্রিডা তার প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাকে নানাভাবে সৃজনশীল হতে সাহায্যে করেছেন, নতুন নতুন ভাবনার দ্বার খুলে, তার বইয়ের বিশ্লেষণ করে, ফ্রয়েড এর তত্ত্বের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে। ফ্রিডা ও লরেন্সের প্রেম অতি গভীর ও আবেগঘন। ফ্রিডা বিভিন্ন জনের সাথে মাঝে মাঝে থাকার জন্য তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায়নি। অশান্তি হয়েছে ঠিকই, তবে সাময়িক ঝড়ের তান্ডবের মতো। লরেন্স এক অদ্ভুত ভাবে ফ্রিডার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। হাকসলির মতে, ‘as one is dependent on the liver in one’s belly. ‘মানুষের সম্পর্ক এক অতল, অদ্ভুত রহস্যময়। ব্যাখ্যার অতীত।—শেষ।
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।