বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


ডিএইচ লরেন্স ও ফ্রিডা।

বৈবাহিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে বেশ তাত্ত্বিক কথা লিখেছেন ডিএইচ লরেন্স। তার উপন্যাসের চরিত্ররাও তেমনই বলেছেন। কিন্তু তত্ত্বকে বাস্তবায়িত করা তার নিজের জীবনেই সম্ভব হয়নি। তাঁর মতে, বিবাহিত সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী দু’জনই স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখবে। যার যার পথে চলবে আবার দু’জনের সুন্দর ভালোবাসার সম্পর্ক থাকবে। যেন দুটি পাশাপাশি চলা জাহাজ। একই বন্দরে পৌঁছবে। তাদের যদি একসঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয় তবে প্রথম ঝড় এলেই তারা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পরবে।
বিবাহিত জীবনের প্রথম ঝড় যেকোনও সম্পর্ক ভেঙে দিতে পারে। কিন্তু একই লক্ষ্যে আলাদা ভাবে চললে যে যার দক্ষতা এবং সামর্থ অনুযায়ী এগোতে পারে। আবার সম্পর্কও ভালো থাকে। একে অপরের পরিপূরক হবে। নির্ভরশীল হবে না বা নিজের সবকিছু চাপিয়ে দেবে না। পড়লে অত্যন্ত আধুনিক মানসিকতার পরিচায়ক মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে এর প্রযোজ্যতা সম্পর্কে নিশ্চয়ই তার কোনও ধারণা ছিল না। তার নিজের বিবাহিত জীবনই এক উদাহরণ। তার স্ত্রী ফ্রিডার মতে, লরেন্স চাইতেন স্ত্রী একটি উপগ্রহের মতো স্বামীকে ঘিরেই আবর্তিত হবেন। স্বামীর প্রতি অনুগত হবেন, তার ইচ্ছেতেই নিয়ন্ত্রিত হবেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১২: ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড ও মিডলটন মারে, এক ভালোবাসাহীন বিবাহ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৯: কী ছিল চিঠিতে, উত্তর লিখতে গিয়ে উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের হাত কেঁপেছিল

লরেন্স নিজে ক্যাথেরিন ম্যান্সফিল্ডকে ১৯১৮ সালে লিখেছেন, স্বামী অবশ্যই স্ত্রীর আগে চলবে। পিছন ফিরে তাকিয়ে কোনও জিজ্ঞাসার বা অনুমতির প্রয়োজন নেই। স্ত্রী-স্বামীকে বিনা বিতর্কে অনুসরণ করবেন। আমার এটাই দৃঢ় বিশ্বাস। ফ্রিডা অবশ্য তা করে না। তাই আমাদের লড়াই।

এক অশান্ত বিয়ের সম্পর্কের মধ্যে বড় হয়েছেন লরেন্স। অত্যন্ত গুণী এবং দৃঢ়চেতা মা ও দুর্বল পিতার নিত্য ঝগড়া দেখেছেন। মা-ই নিয়ন্ত্রণের ছড়ি রেখেছেন তার হাতে। পরবর্তীকালেও বিভিন্ন মহিলার তীব্র অধিকার বোধ দেখেছেন। তাই তার ধারণা গড়ে উঠেছিল যে বিয়ে মানেই এক অনন্ত ইচ্ছের সংঘর্ষ যেখানে পুরুষ অথবা মহিলা, কোনও একজন সবসময় জিতবেন। অপরজনকে সবসময় হার মানতে হবে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৫: সুন্দরবনের পাখি — মাছরাঙা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৮: প্রতিভা দেবী—ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী

এ জন্যই বোধ হয় এক আদর্শ বিয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে পুরুষ ও নারীর স্বতন্ত্র স্বাধীনতা থাকবে। আবার একসঙ্গেও চলবে। লরেন্স ও ফ্রিডার বিয়ে এক বৈপরীত্যের সমন্বয়… ব্রিটিশ ও জার্মান এর, বিত্তহীন ও অভিজাতর, বাউন্ডুলে ও ঘরোয়ার, সন্তানের বন্ধন ও মুক্তির, সবের এক বিচিত্র সমারোহ। বৈপরীত্যের মধ্যে দু’জনে চাওয়ার লক্ষ্যে এক। প্রচুর বাধা বিপত্তির মধ্যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগোনো। লরেন্স এর জীবনে আগে আরও প্রেমিকা এসেছেন, অত্যন্ত অনুগত, অনুরক্ত। কিন্তু তার মতে এক নিষ্কণ্টক, সরল পথ এ চললে তার প্রতিভার স্ফুরণ হতো না। এক জোলো নিবন্ত জীবন তার কাম্য নয়। তাই ফ্রিডার মত, চনমনে, দুরন্ত এক সুন্দরী, যার সঙ্গে মাঝে মাঝেই মতের অমিল হবে, ঝগড়া হবে, তাকেই তিনি জীবন সঙ্গিনী করলেন।ফ্রিডা ও তার এক বন্ধুকে লিখেছেন যে লরেন্স এর সাথে জীবন কাটানো এক কষ্টের অভিজ্ঞতা, কিন্তু খুব উপভোগ্য।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৪: শিকারী ও ‘শিকার’

মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

কোনও বিষয়ে একমত হতে এক দীর্ঘ ঝগড়ার পথ পেরোতে হতো। তবু, ফ্রিডার মতে, “I think the greatest pleasure for a woman is to live with a creative man ,when he goes ahead and fights.”

ফ্রিডা ফন রিশতফেন, জার্মানির এক অভিজাত পরিবারের অপূর্ব সুন্দরী কন্যা। গোলাপের পাপড়ির মতো গায়ের রং, ধূসর টানা চোখ, স্বর্ণালী চুল, প্রাণোচ্ছল দীর্ঘ দেহ, যেন এক জার্মান দেবী, এক গ্রীক ভাস্কর্য। ১৮৯৬ সাল, ফ্রিডার বয়েস সতেরো। বেড়াতে গিয়ে প্রেমে পরলেন এক বত্রিশ বছর বয়স্ক অধ্যাপক, আর্নেস্ট উইকলির। দু’ বছর বাদে বিয়ে করলেন তাকে। বিয়ের পাঁচ ছ’ বছরের মধ্যে তিনটি সন্তানের জননী হলেন। দুটি কন্যা এবং একটি পুত্র। এছাড়াও ফ্রিডার ছিল অজস্র প্রেমিক। বিয়ের বারো বছর পর একদিন তার স্বামীর প্রাক্তন ছাত্র লরেন্স এলেন তার বাড়ি। লরেন্স ফ্রিডার চেয়ে ছ’ বছরের ছোট। প্ৰথম দর্শনেই আকৃষ্ট হলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৯: আলোকলতা তিলোত্তমারা যুগে যুগে পুরুষের উজ্জীবনী শক্তির আধার

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০০: চোর মাচায়ে শোর

এরপর কয়েকবার দেখা হল। ইতিমধ্যে তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। জীবনের এক টালমাটাল অবস্থা তখন তার, কারণ সদ্য প্রয়াত হয়েছেন মা, যার প্রবল আধিপত্যের শৃঙ্খল থেকে তখন মুক্ত তিনি। ফ্রিডা তার লেখা বিশদ জীবনীতে বলেছেন, এপ্রিলের এক রবিবারে লরেন্স এলেন। ফ্রিডার স্বামী বাড়ি নেই। ফ্রিডা অনুরোধ করলেন তাকে রাতে থেকে যেতে। লরেন্স বললেন, তিনি ফ্রিডার স্বামীর বাড়িতে তার অবর্তমানে থাকবেন না। ফ্রিডা যেন স্বামীকে তাদের ভালোবাসার কথা পরিষ্কার করে বলেন। তারপর দু’জনে একসঙ্গে চলে যাবেন, কারণ তারা একে অপরকে ভালোবাসেন।
* * ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content