বিদ্যার দেবী মা সরস্বতী।
সেই কোন্ কালে এক সাদামাটা ছেলে বিদ্যেবতী সরস্বতীর কাছে আর্জি জানিয়েছিল একটু বিদ্যের। নালিশ করে নয়, এমনিই বলেছিল। সরস্বতী নদী থেকে কালের প্রবাহে ভেসে ভেসে কখন স্যোশ্যাল মিডিয়ার স্কুটিতে চেপে বসেছেন তার রোডম্যাপিং কজন করেছে। সেরকম, বিদ্যার আশেপাশে আর কলাসমূহের অন্যতম কামকলার সেক্টরে তাঁর বহুদিনের চলাফেরাও তো স্বাভাবিক, দুগ্গাপুজোর মণ্ডপে তাঁর পাশেই যে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি নিজে দেবসেনাপতি নাকি তাঁর স্ত্রী দেবসেনা সেটাই তো আজ পর্যন্ত ঠিকঠাক সমাধানের পথ পেল না।
এদিকে ময়ূরবাহন হলেন চিরকুমার। আর তিনি যে চৌর্যশাস্ত্রের প্রাকটিশনরদের পূজনীয়, সেটা বেশি কেউ জানলো না। সরস্বতীর সঙ্গে ব্রহ্মার একটি বিষণ্ন অধ্যায় আর ভারতের পুষ্করক্ষেত্রে একমাত্র ব্রহ্মার মন্দিরের কিছু একটা যোগসূত্র আছে সেটাও ততটা চর্চিত কি? সরস্বতী ক্রমে সেই নানা চড়াই উতরাই এড়িয়ে বিদ্যেবতী হয়েছেন। যে দেশ-কাল খাতা কলম নিয়ে ট-ভ করাকেই বিদ্যার পরাকাষ্ঠা মানে তাদের কাছে সরস্বতী পেন-পেনসিলবাহিত হয়ে খাতায় নামেন। অথচ তথাকথিত বিদ্যার অর্থাৎ সারস্বতচর্চার নানা ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা যে থাকতেই পারে সেকথা শুনে বিদ্বানগণ কানে আঙুল দিতে পারেন।
এদিকে ময়ূরবাহন হলেন চিরকুমার। আর তিনি যে চৌর্যশাস্ত্রের প্রাকটিশনরদের পূজনীয়, সেটা বেশি কেউ জানলো না। সরস্বতীর সঙ্গে ব্রহ্মার একটি বিষণ্ন অধ্যায় আর ভারতের পুষ্করক্ষেত্রে একমাত্র ব্রহ্মার মন্দিরের কিছু একটা যোগসূত্র আছে সেটাও ততটা চর্চিত কি? সরস্বতী ক্রমে সেই নানা চড়াই উতরাই এড়িয়ে বিদ্যেবতী হয়েছেন। যে দেশ-কাল খাতা কলম নিয়ে ট-ভ করাকেই বিদ্যার পরাকাষ্ঠা মানে তাদের কাছে সরস্বতী পেন-পেনসিলবাহিত হয়ে খাতায় নামেন। অথচ তথাকথিত বিদ্যার অর্থাৎ সারস্বতচর্চার নানা ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা যে থাকতেই পারে সেকথা শুনে বিদ্বানগণ কানে আঙুল দিতে পারেন।
সে যাই হোক, যে বিদ্যা নিয়ে এতো দৌড়োদৌড়ি সরস্বতী সেই বিদ্যাই দেন নাকি অবিদ্যা, তিনি বাগাম্ভৃণী, বাঙ্ময়ী, চিন্ময়ী হয়ে কীভাবে ধরা দেন, তাঁর অবাঙ্মনসগোচর ব্রহ্মস্বরূপতা, তাঁর অচিন্তনীয় সত্তা, তাঁকে ঘিরে আখ্যান-উপাখ্যানে রহস্যমেদুর প্রতীক ও ব্যঞ্জনা, তাঁর কমলবনে হংসরূপে ব্রহ্মময়তা, হংস ও কমলের সান্নিধ্যে তাঁর প্রতীকায়িত রূপে যে বৃহতের অনুধ্যান, আজ ততোটা কি তা আকর্ষণ করে? গোপন বিজনপুর থেকে আলোকবর্তিকার রূপে উত্সারিত হয়ে অজ্ঞানকে কঠোর কুঠারাঘাতে দীর্ণ করে, মনোলোক থেকে ছায়াময় মায়াময় আবরণ সরিয়ে বুদ্ধি আর বোধকে নিষ্কলুষ করার আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা কি আজ তেমনভাবে জাগে?
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৪: শিকারী ও ‘শিকার’
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৭: প্রবল অজেয় বাণী তব
‘মেঘমল্লার’ গল্পে সর্বব্যাপিনী দেবী দুষ্টের কুক্ষিগত হয়ে আত্মবিস্মৃত হয়েছিলেন। জগত্ ঢেকেছিল অজ্ঞানে, তারপর একদিন ঘোর কেটেছিল, পৃথিবীতে চেতনা, বুদ্ধি আবার নিষ্কলুষ অম্লান অবাধ গতি পেয়েছিল। থমকে যাওয়া কলাবিদ্যার বিস্তৃত চর্চা আবার জেগেছিল মায়াপুরীর ঘুমঘোর কাটিয়ে?
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১০: মানুষের পাশে, মানুষের কাছে
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০১: সরষের মধ্যে ভূত
আজকের সরস্বতীর বাস ঠিক কোথায় তা নিশ্চিত নয়। তিনি কণ্ঠে, কলমে, বুদ্ধিতে, বোধে, চেতনায় নাকি চোয়ালে তা নির্ধারণ করে কে? কলম থেকে কি-প্যাডে তিনি এসেছেন, বাক্ থেকে বাচালতায় তিনি উঠেছেন, বাণী থেকে খিল্লি হয়ে তিনি বহুব্যাপিনী হয়েছেন। বীণাপাণির বীণার স্পেলিং আজ অবাধে ‘বিনা’ হয়ে বীণাকে মুক্তি দিয়েছে।
আজ বিদ্যার মুক্তি ঘটেছে। যে বিদ্যা এককালে কুক্ষিগত ছিল আজ আন্তর্জালিক, আন্তর্জাতিক হয়ে তা আঙুলের স্পর্শে জেগে ওঠে। সে যুগে বিদ্যার পথ ক্ষুরধার দুর্গম, আজ তথ্য অনায়াস, তবে তথ্যজাত বোধের উদ্গমের পথ জটিল আবর্তে সঙ্কুল।
আজ বিদ্যার মুক্তি ঘটেছে। যে বিদ্যা এককালে কুক্ষিগত ছিল আজ আন্তর্জালিক, আন্তর্জাতিক হয়ে তা আঙুলের স্পর্শে জেগে ওঠে। সে যুগে বিদ্যার পথ ক্ষুরধার দুর্গম, আজ তথ্য অনায়াস, তবে তথ্যজাত বোধের উদ্গমের পথ জটিল আবর্তে সঙ্কুল।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৫: সুন্দরবনের পাখি — মাছরাঙা
যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১
সরস্বতী আজ বিদ্যায়তনে চর্চিত, পূজিত হচ্ছেন। নবীন শিশুর দল হলুদ শাড়িতে নবজাত প্রজাপতি হয়ে গলির মোড়ে মোড়ে অদৃশ্য হবে, সেপথেই দৃশ্যমান হবে পাঞ্জাবি পাজামায় নবীন কিশোর, ছুটবে ভুবনডাঙার মাঠের দিকে। কোকিল থাকবে, থাকবে চোরা কিল, বাঙালি ভোররাত থেকে শ্রীপঞ্চমীর উদ্যোগ নিতে নিতে ফুলচুরি করবে, মনচুরিও হয়তো বা, কেমন একটা প্রেমের আবেশ তৈরি হয়ে প্রজন্মবাহিত একটা কানাঘুষোর নক্সিকাঁথার মাঠ রচনা করবে। দেবী পদ্মাসনা, হংসবাহনা, শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা মহাশ্বেতা কুন্দেন্দুতুষারহারধবলা হয়ে শুভ্র অমলিন হাস্যে জগতকে আলোকিত করবেন।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০০: সন্দেহের তীরবিদ্ধ ভরতদের আজও খুঁজে পাওয়া যায়
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৩: রাগ অনুরাগের বন্ধন, ডিএইচ লরেন্স ও ফ্রিডা
বিদ্যায়তনিক সরস্বতী পুজো শৈশবকে যুগে যুগে এক আলোকিত ভোরে দেখিয়েছে। সেখানে কুয়াশার শৈত্যের পাশাপাশি আসন্ন প্রভাতের নবোদিত বালসূর্য নেমে আসেন। ছাত্র থেকে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার সেই শুরু। সারস্বত তাত্ত্বিক চর্চার পাশাপাশি প্রায়োগিক শিক্ষার একটা মুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে থাকে। আজকের শৈশব তাকে অমলিন আদর্শে পেলে লাভ বৈ ক্ষতি নেই বোধ হয়। স্কুলে স্কুলে নেমন্তন্ন করতে যাওয়ার ঠেলাঠেলি, কে আগে যাবে তাই নিয়ে রেষারেষি চলতে থাকে। এমনকী, উন্মুক্ত, অবাধ, অনাবিল “থিমে” ভর করে সরস্বতী নেমে আসেন, কুটিরবাসিনী হন, কোথাও দোলনায় চড়ে কিংবা হুগলী ব্রিজের ওপরেই বা বসে থাকেন। কোথাও তাঁকে ঘিরে ফুলের বন, কোথাও হানাবাড়ির ভাঙা দরজার পাশে বীণাপাণি বীণায় সুর ধরেন। কেন, কোন যুক্তিতে এসব হয় স্বপ্ন বোনা শৈশবের সে কৈফেয়ত দেওয়ার দায় নেই। শুধু যে দীপটুকু জ্বলে ওঠে, সেটা যেদিন দীপমালা হয়ে হৃদয়ের কমলবনে মধুর ধ্বনি জাগায়, সেদিন পৃথিবীতে সত্যিকারের মাঘী পঞ্চমী, দেবী সেদিন মুক্ত হন কারা থেকে, যুগে যুগে কালে কালে লালিত মুক্ত সুরের ছন্দ জাগে তাঁর পদপাতে, ঢেউ জাগে সরস্বতীর মানস সরসে, দেবীর নিভৃত পদসঞ্চারে বিষাদের অশ্রুজল এসে মেশে মিলনের উৎসবে। নয়নের আঁধার কাটিয়ে ধেয়ানে আলোকরেখা জ্বেলে পরাণের পদ্মবনে অমৃতমুরতিমতী বিরহের বীণাপাণি সরস্বতী জগতকে সরস করে জেগে ওঠেন, জাগিয়ে তোলেন।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।