বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


কেরলের প্রাচীন নৃত্যনাট্য কুডিয়াট্টম

কেরালার নৃত্য ও নাট্যচর্চার ইতিহাসটি প্রাচীন৷ প্রকৃত ভাষার ক্রমবিকাশের ফলে ভারতের প্রাদেশিক নাট্য-অভিনয়ে ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্রের অনুসরণ বিশেষ করা হয় না৷ কেরালায় সংস্কৃত ও মালয়ালাম ভাষা মিশ্রিত হয়ে দেশীয় সংস্কৃতির বিবর্তিত রূপ কুডিয়াট্টম নামক একটি নতুন নাট্যধারার সৃষ্টি হয়েছে৷ এই রূপান্তরিত শিল্পের অন্যতম প্রয়োগ হল সংস্কৃত নাটকে বিদূষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন৷ এই নাট্যশৈলীর সংস্কৃত নাটকে বিদূষককে মালয়ালাম ভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে৷

কেরালার কুডিয়াট্টম নাট্যশৈলীকে কেরালার শাসকরা উৎসাহিত করেছেন৷ কুলশেখর পেরুমলের সময় কেরালার নাট্যচর্চার চরম উন্নতির পরিচয় পাওয়া যায়৷ কুডিয়াট্টমে নৃত্যের অংশ থাকলেও নাট্যগুণ অনেক বেশি৷ একে নৃত্যনাট্য বলা হলেও প্রাচীন সংস্কৃত নাটকের ঐতিহ্য অনুসারী শিল্পীরা অভিনয়, নৃত্য, গীত- তিনটিই পরিবেশন করেন৷ তাই একে সম্পূর্ণরূপে নৃত্যনাট্য না বলে তার আদিরূপ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে৷ এতে অন্যতম চরিত্র বিদূষক প্রাকৃত সংস্কৃত আবৃত্তির পর মালয়ালাম ভাষায় কাহিনিটি বর্ণনা করেন৷

বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কেরালায় প্রাচীন নৃত্যগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ নৃত্য ছিল ধর্মীয় প্রভাবসম্পন্ন৷ এছাড়া ক্ষত্রিয় নায়কদের সামরিক নৃত্যও প্রচলিত ছিল৷ এই সকল ক্ষত্রিয় নায়করা ছিলেন সংস্কৃত মহাকাব্য ও পুরাণের নায়ক৷ এর থেকে সহজেই এ কথা বোঝা যায় যে, কেরালার প্রাচীন নৃত্যগুলোতে ও পরবর্তীকালে কুডিয়াট্টম নৃত্যনাট্যতে প্রাচীন সংস্কৃত নায়ক চরিত্রদের উল্লেখযোগ্য স্থান ছিল৷

ভারতীয় মহাকাব্য ও পুরাণ থেকে যে ধর্মীয় শিল্পকলার উদ্ভব হয়েছিল তার অন্যতম উদাহরণ ‘ভাগবত মেলা’৷ অন্ধ্রপ্রদেশের ভাগবত মেলা নাটকে নৃত্য ও নাটকের সুসমন্বয় লক্ষিত হয়৷ নৃত্য ও নাটক–এই দুই দিক দিয়ে বলা যায় যে, কুডিয়াট্টমে ভাগবত মেলার প্রভাব সর্বাধিক৷

একটি কুডিয়াট্টমে তিনটি পর্ব থাকে–পুরাপ্পাদু৷ এই অংশে ছন্দের সঙ্গে নৃত্য অভিনয় সহ অনুষ্ঠিত হয়৷ দ্বিতীয় পর্বটি হল নির্বাহনম৷ এই অংশটি নাটকের আরম্ভ পর্বে নিয়ে যায়৷ শেষ ভাগটি হল কুডিয়াট্টম৷ এই অংশে মূল নাটকটি অনুষ্ঠিত হয়৷ প্রথম দুটি পর্বে একক নৃত্য-অভিনয় পরিবেশিত হয়৷

সর্বপ্রথম নাট্যশাস্ত্র পণ্ডিত মণিমাধব চক্যার কেরালায় মন্দিরে কুডিয়াট্টম পরিবেশনের ঐতিহ্য স্থাপন করেন৷ তাঁর পরিচালনায় অনেকবার ‘স্বপ্নবাসবদত্তম’, ‘পঞ্চরাত্র’ ইত্যাদি ভাসের নাটক অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ মণিমাধব চক্যার ১৯৬২ সালে কেরালার বাইরে চেন্নাইতে ভাসের ‘অভিষেক’ নাটক পরিবেশন করেন৷ এই নৃত্যশিল্প মণিমাধব চক্যারের মাধ্যমে গুরু শিষ্য পরম্পরায় বিদ্যমান৷ ১৯৮০ সালে আম্মানুর মাধব চক্যার আন্তর্জাতিক মহলে সর্বপ্রথম কুডিয়াট্টম পরিবেশন করেন৷ ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ, মহাভারতকে কেন্দ্র করে ইন্দোনেশিয়ার নাট্য ঐতিহ্যর ধারা লক্ষিত হয়৷ সারা বছর ধরে রামায়ণ মহাভারতের ওপর পুতুলনাচ ও নৃত্যনাট্য অনুষ্ঠিত হয়৷ এই দুটিকে যথাক্রমে ওয়াঙ কুলিত ও ওয়ায়াঙ ওয়ঙ বলা হয়৷

ইন্দোনেশিয়ার রামায়ণ আশ্রিত নৃত্যনাট্য

প্রাচীনকালে সুবর্ণদ্বীপ, যবদ্বীপ এবং বালিদ্বীপ–এই তিনটি একত্রিত দ্বীপ ইন্দোনেশিয়া নামে পরিচিত ছিল৷ প্রাচীন যবদ্বীপে রামায়ণ ‘কাকাবিন রামায়ণ’ নামে খ্যাত ছিল৷ এই রামায়ণটি দশম শতাব্দীতে রচিত হয়৷ সংস্কৃত ভট্টিকাব্যের সঙ্গে এই রামায়ণের সাদৃশ্য আছে৷ ইন্দোনেশিয়ায় একাদশ শতকে জাভার রাজা ধর্মবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ভারতযুদ্ধ’ নামে মহাভারতের একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়৷ এই সংস্করণ পরে বালিদ্বীপে প্রসিদ্ধি লাভ করে৷ ইন্দোনেশিয়ার যোগ্যকর্তা শহরে হিন্দু মন্দির প্রামবননের প্রাঙ্গণের বিপরীত দিকে একটি সভাগৃহে প্রতিদিন সন্ধ্যায় রামায়ণ নৃত্যনাট্য অনুষ্ঠিত হয়৷ ‘ওয়ায়াঙ ওয়ঙ’–এই নৃত্যকলা জাভা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিশেষ পুষ্ট করেছে৷ বিশ্বের অন্যতম থিয়েটারের নিদর্শন এই নৃত্যনাট্যতে লক্ষিত হয়৷ এই নাট্যশৈলী পুরোপুরি ভারতীয় প্রভাবিত এবং কুশীলবরা মুখোশ ধারণ করবেন বা করবেন না তা চরিত্রচিত্রণের ওপর নির্ভর করে৷ ইতিহাস দেখলে জানা যায় যে, ইন্দোনেশিয়ায় হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছিল বাণিজ্যের সূত্র ধরে৷ ভারতীয় মহাকাব্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল জাভা ও বালীর মানুষজন৷ কাকাবিন ভাষায় সমৃদ্ধ জাভা সাহিত্যের ধারক এই নৃত্যনাট্য৷

‘ওয়ায়াঙ ওয়ঙ’ সভানৃত্য রূপে অনুষ্ঠিত হত বহু বছর আগে৷ সেই সভা সুলতানের অভিষেক, বিবাহ বা জন্মদিনের অনুষ্ঠান উপলক্ষ্ হত৷ ১৯৩৯ সালে একটি বড় অনুষ্ঠানে এই নৃত্য পরিবেশিত হয়৷

রামায়ণ ও মহাভারত–এই দুটি প্রাচীন মহাকাব্যের নৃত্যনাট্যরূপে উপস্থাপন ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার শিল্পকলাকে এক সূত্রে গ্রথিত করেছে–এ কথা বলাই বাহুল্য!

ছবি: লেখিকা

Skip to content