শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

আজ মকর সংক্রান্তি। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানে সংক্রান্তি সূর্যের রাশি পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। মকর সংক্রান্তিতে সূর্য প্রবেশ করে মকররাশিতে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, এই সময় থেকে সূর্যের উত্তরায়ণের সূচনা। কিন্তু বৈজ্ঞানিক-ভৌগোলিক গণনায় উত্তরায়ণের সূচনা ঘটে গিয়েছে দিনপনেরো আগে থেকেই। সে যাই হোক, ভারতবর্ষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়জীবনে, পরম্পরাগত বিশ্বাসে ও যুগবাহিত সমাজদর্শনে মকরসংক্রান্তি এক বিশেষ দিন।
মকর সংক্রান্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা কাহিনি, কিংবদন্তি, পঞ্জিকায় মাসের শেষ দিনটিই সংক্রান্তি হয়, তবে চৈত্রসংক্রান্তিতে যেমন বর্ষশেষ, তেমন পৌষসংক্রান্তিতে বছরের একটা অধ্যায়ের শেষ হয়। তাই এই সংক্রান্তি বিশিষ্ট। ভারতবর্ষ জুড়ে বিহু, পোঙ্গল, সক্রাত, ঘুঘুটি, দহিচুরা ইত্যাদি নানা নামে এই পৌষের শেষলগ্ন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে নানাবিধ আয়োজনে, উৎসবে, আহার্যে, গানে, নাচে, উদযাপনে।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১২: দর্দরজাতক

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৭: ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগে মহর্ষি পেলেন চরম দুঃসংবাদ

লোকবিশ্বাস বলে, এই শুভকালে দেবগণ ক্রিয়াশীল হন। কার্ত্তিকমাসে, নভেম্বরের শেষদিকে একাদশীর দিনটি দেব উত্থান একাদশী বা প্রবোধিনী একাদশী নামে প্রসিদ্ধ। পুরাণমতে, যোগনিদ্রা ত্যাগ করে বিষ্ণুর নিদ্রাভঙ্গ ঘটে, বিষ্ণু স্থিতিকালের অধীশ্বর। তাই এর পরে পৃথিবীতে জীবের, জীবনের স্থিতি কল্যাণকর হবে। নিষ্কলুষ হবে। তাই এই সময় দেবতাদের ‘কাল’, শারদীয় দুর্গোত্সবের অকালবোধন, অশুভের বিনাশের শেষে শুভের উন্মোচন, নিরঞ্জনের শেষে, দীপালিকায় অমানিশাকে দূর করার যে আয়োজন তার পরেই পৃথিবীতে এই পরিবর্তনের হাওয়া জাগে।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৬: ‘রাজর্ষি’ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘বিসর্জন’ নাটক

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮২: সুন্দরবনের পাখি—টিয়া

দেবতাদের জেগে ওঠার এই প্রতীকের অন্তরালে সত্যের নির্যাসটুকু কি তা প্রকৃতির দিকে তাকালেই বোধগম্য হয়। নবান্নের উৎসব পার হয়ে প্রকৃতি এখন বর্ণময়, সম্পন্ন। সেই সম্পন্নতার ছোঁয়াটুকু ধরা থাকে গৃহস্থের আচারে। কার্ত্তিকমাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে যে ছটপুজোর সমারোহ, সেই ষষ্ঠীর আরাধনা তো সূর্যব্রত। অগ্রহায়ণ মাসজুড়ে যে ইতুপুজোর ব্রতপালন, তাও মিত্রসূর্যের আরাধনা। তারপর দেবোত্থানের কাল পার হয়ে মকর সংক্রান্তির যাবতীয় প্রতীকায়িত আচারের অন্তরালে বহমান যে সারসত্য তার মূলেও সেই সূর্যের অনুধ্যান।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৫: শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষতায় বীরবিক্রম

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৮: কপোত-কপোতী

উত্তরায়ণের সঙ্গে যুক্ত আছে মহাভারতীয় আখ্যান-উপাখ্যান। গঙ্গাপুত্র ভীষ্মের শরশয্যার শেষে উত্তরায়ণে প্রাণত্যাগ থেকে সগররাজার পুত্রদের কথা, ভগীরথের কাহিনি কিংবা গঙ্গাবতরণ, কপিলমুনি… একসূত্রে সহস্র জীবনের গল্প।

উত্তরায়ণে ভারতের মতো উত্তরগোলার্ধের দেশে এবার আলো বাড়বে, দিন বড় হবে, বাড়বে রোদ্রতাপ। এই উত্তরায়ণ চলবে আগামী বর্ষাকাল পর্যন্ত। এই সময়টুকু সৃজনের কাল। শস্যের, জীবনের, জগতের পরিপুষ্টির কাল। কৃষিনির্ভর দেশে এই সময়ের অপরিসীম গুরুত্ব। পৌষমাস পাকা ফসলে সেই ডাক দিয়ে যায়, শূন্য করে ভরে দেওয়ার খেলা পূর্ণতা পায় সব হারিয়ে নিজেকে ফিরে পাওয়ার আত্মজাগরণের সোনারোদের এই শীতল সকালগুলোতে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৭: পাঞ্চালীকে আশীর্বাদ করে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন গান্ধারী

এই সকল আয়োজনের কেন্দ্রে যে তাপ ও ঔজ্জ্বল্যের প্রেরণা, যে উষ্ণতা জীবনকে প্রকাশিত করে ঘিরে রাখে, তার অদ্বিতীয় শক্তি হলেন সবিতা, যিনি দিবাকালের প্রসবিতা। প্রতিদিনকে নব নবরূপে প্রাণে ধারণ করান। তিনিই উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে সূর্য, তিনিই ধাতা, মিত্র, পুষা, বিষ্ণু। ভারতবর্ষের সৌরদেবতা বিষ্ণু। তিনিই পুরাণপ্রসিদ্ধ হয়ে খ্যাতকীর্তি ও মহান হয়ে উঠেছেন কালে কালে। ‘সূর্য’ নামের দেবতা ক্রমশ সমাজ-সংস্কৃতিতে পশ্চাদপসরণ করেছেন, দীর্ঘ ও জটিল সমাজেতিহাসের রহস্যে। সেই স্থানে উত্থান ঘটেছে বিষ্ণুর। তাঁর মোহনিদ্রার শেষে এখন পৃথিবী সৃজনোন্মুখ।

পৌষের শেষের পুণ্যক্ষণে, সংক্রান্তিতে ফেলে আসা সময়, পেরিয়ে আসা দিনের সকল স্মৃতি, বিশ্বাস, বোধ আগামীর স্বপ্নে মহামানবের সাগরতীরে ভিড় জমাবে যুগে যুগে সেই আরাধ্য জ্যোতিঃর সন্ধানে। দিনকাল যেকথাই বলুক, বদলে যাওয়া জীবন যে ইঙ্গিত-ই দিক না কেন, পৌষের এই শেষবেলা মনে করিয়ে দেয় “ভারতবর্ষ : সূর্যের এক নাম আমরা রয়েছি সেই সূর্যের দেশে/ লীলা চঞ্চল সমুদ্রে অবিরাম/ গঙ্গা যমুনা ভাগিরথী যেথা মেশে।”
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content