বুধবার ১৬ এপ্রিল, ২০২৫


রাজকুমারী ঊষা। তাঁর রূপে সবাই বিমোহিত। এহেন পরমা সুন্দরী কন্যার সুরক্ষায় সদাচিন্তিত বানরাজ অনেক ভেবে এক অভিনব উপায় বার করলেন। নির্মাণ করলেন এমন এক দুর্গ যা ইতিপূর্বে কেউ কখনও দেখেনি। জ্বলন্ত অগ্নি দ্বারা আবৃত দুর্ভেদ্য সে দুর্গের নাম অগ্নিগড়। কিন্তু বিধি বাম। অমন সুরক্ষিত রক্ষাকবচ ভেদ করেও সেখানে ঢুকে পড়েছিল স্বপ্ন, প্রেম। এক গভীর রাতে স্বপ্নে দেখা সুদর্শন এক পুরুষকে ভালোবেসে ফেললেন ঊষা।
রাজকুমারী প্রিয় সখী দক্ষ চিত্রশিল্পী চিত্রলেখাকে বর্ণনা করলেন তাঁর প্রিয়তমের কথা। চিত্রলেখা আঁকলেন তাঁর সখীর প্রাণপুরুষের ছবি। খোঁজ শুরু হল। জানা গেল সেই স্বপ্নপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের নাতি, নাম তাঁর অনিরুদ্ধ। কি সর্বনাশা কাণ্ড! এই শ্রীকৃষ্ণ যে পরম শৈব বানরাজার চরম শত্রু। ক্ষণিকের জন্য বুক কেঁপেছিল ঊষার। কিন্তু প্রেম তো আর শত্রু মিত্র দেখে না, সে তার নিরন্তর বহমানতায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় যুগলকে। অনিরুদ্ধ আর ঊষাও ভেসে গেলেন। পিতার অগোচরে গান্ধর্ব মতে বিবাহ করলেন তাঁরা। “গোপন কথাটি রবে না গোপনে”—সত্যি বেশিদিন গোপন রইল না। নিজের সন্তানের এই স্পর্ধা সহ্য করলেন না বানরাজা। বন্দি করলেন জামাতাকে। সংবাদ পৌঁছল শ্রীকৃষ্ণের কানে। নাতিকে উদ্ধার করতে দাদু যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন।
আরও পড়ুন:

পাহাড়ের উপর ছবির মতো সুন্দর শ্রবণবেলাগোলা— চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের এক অজানা অধ্যায়

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৩: মা সারদার সঙ্গে সরলাদেবীর কাশীভ্রমণ

আসন্ন যুদ্ধের প্রাক্কালে বানরাজা দেবাদিদেবের শরণাপন্ন হলেন। ভক্তের ভগবান ভক্তের সাহায্যার্থেই ভগবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। শুরু হল হরিহরের ভয়ংকর যুদ্ধ। সৃষ্টি রসাতলে যাবার উপক্রম দেখে সকল দেবতা-মুনি-ঋষি উপাসনার মাধ্যমে হরিহরকে তুষ্ট করার প্রচেষ্টা করতে লাগলেন। অবশেষে হরিহর শান্ত হলেন। বানরাজাও নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনিরুদ্ধকে মুক্ত করলেন।

হরিহরযুদ্ধের সময়কালটা ছিল চৈত্র মাস। আরাধ্যকে তুষ্ট করতে বানরাজ নিজের শরীর কেটে রক্তার্ঘ্য দিয়েছিলেন, সেই সঙ্গে ভক্তিমূলক নৃত্যগীতও পরিবেশন করেছিলেন দেবাদিদেবের সম্মুখে। কথিত আছে, এই সময় থেকেই চড়ক পুজোর সূচনা। তাই তো আজও দৈহিক যন্ত্রণা এই পুজোর প্রধান বিষয়। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতিবছর চৈত্র মাসের শেষ দিনটিতে উদযাপিত হয় চড়ক পুজো। রাঢ় বঙ্গের শৈবসংস্কৃতির বিশেষ অঙ্গ ‘গাজন’ উৎসবের অংশ এটি। ‘গাঁ’ অর্থ গ্রাম আর ‘জন’ অর্থ জনগণ। গ্রামের জনগণের একান্ত নিজস্ব উৎসব ‘গাজন’। যদিও গাজন শব্দটি ‘গর্জন’ থেকে নিষ্পন্ন। উৎসবে অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসীদের প্রচণ্ড গর্জনে মুখরিত হয়ে ওঠে গাজন।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৬: পরাগপাখি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১১: বিপদ যখন আসে

চৈত্র সংক্রান্তির কিছুদিন আগে থেকেই সন্ন্যাসব্রত গ্রহণের মধ্য দিয়ে যে গাজন উৎসবের সূচনা হয়, চড়ক পূজায় তার সমাপ্তি। একটা জল ভর্তি পাত্রে শিবলিঙ্গকে স্থাপন করা হয়। ভক্ত সন্ন্যাসীদের কাছে তিনি বুড়োশিব। কুমিরের পুজো, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর দিয়ে হাঁটা, তীক্ষ্ণ কাঁটা, ধারালো বঁটি ও ছুরির ফলার উপর লাফিয়ে পড়া, জিভের মধ্যে তীক্ষ্ণ শলাকা বিঁধিয়ে সারাদিন পর্যন্ত রাখা, পিঠের দুদিকে চামড়া ভেদ করে তার মধ্যে সরু বেত প্রবেশ করিয়ে দেওয়া—এ সবই চড়ক পুজোর প্রধান বিষয়। অনেক উঁচু চড়ক গাছের দুদিকে দুজন মানুষ পিঠে বড়শি বিঁধিয়ে শুন্যে বনবন করে ঘুরতে থাকে। চড়কের মেলায় আমার ছোটবেলাতেও দেখেছি। আজও মনে পড়ে, এইসকল শিবভক্তরা চড়ক পুজোর অবসানে যখন সাধারণ মানুষদের মধ্যে মিশে যেতেন, তখন তাঁদের পিঠের সুগভীর গর্তগুলো সুস্পষ্ট রূপে প্রকাশ করতো ভগবানের প্রতি পূর্ণ সমর্পণকে। শিশু বয়সে চড়কের মেলায় দেখা এসব দৃশ্যগুলো মনে প্রশ্ন জাগিয়েছিল—এই সন্ন্যাসীদের যন্ত্রণা হয় না! কষ্ট হয় না? শুনেছিলাম, ভগবানের ভক্তিতে বিভোর ভক্তদের নাকি কোনও যন্ত্রণা থাকে না।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫৬: সিলেটে দেখা মণিপুরী নাচ কবির নৃত্য ভাবনাকে উস্কে দিয়েছিল

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৪: গ্রীষ্মকালে আলাস্কা সত্যিই অচেনা এক দেশ

‘চড়ক’ শব্দটির উৎস ‘চক্র’। তন্ত্রমতে জলভরা পাত্রে অধিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ এবং জল সাংখ্যের পুরুষ-প্রকৃতি। চড়কগাছে শুন্যে ভক্তের চক্রাকারে আবর্তন জীবের জন্ম-মৃত্যু ও সংসার চক্রে আবর্তনের প্রতীক। যদিও তন্ত্রশাস্ত্রে আদিকাল থেকেই চক্র মাতৃকার প্রতীক। আবার ধ্রুপদী সাংখ্যের দুঃখবাদও সম্পৃক্ত এই উৎসবে। যে প্রকৃতি কেবল দুঃখই দেন জন্ম-মৃত্যু সংসারের চক্রে আবর্তিত করে, সেই দুঃখকে হাসিমুখে বরণ করে নেওয়ার উৎসব চড়ক, তার মাধ্যমে দুঃখোত্তীর্ণ হওয়ার প্রচেষ্টা। চড়কগাছটি জগতকারণ প্রকৃতি। প্রকৃতির চক্রে আবদ্ধ হয়েও শূন্যে নিরালম্ব ঘূর্ণায়মান ভক্তের যে প্রতিকী ব্যঞ্জনা তা তো আপামর জনমানসের একান্ত কাম্য।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৯: আধুনিক যুগে দাবানলের ফলে বনদহনের সঙ্গে খাণ্ডব বনদহনের সাদৃশ্য আছে কী?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’

পবিত্র বন্ধনে বিশ্বজগৎ নবরূপে বারংবার সৃষ্ট হতে থাকে। নারী ও পুরুষ যে প্রকৃতিরই অংশ এবং একে অপরের পরিপূরক তারই সুপ্ত দ্যোতনা চড়ক উৎসবে। কণ্টকাকীর্ণ জাগতিক বিষয়গুলিকে নিয়ে আমাদের প্রত্যহ যাপন ‘হরিষে বিষাদ, বিষাদে হরিষ’।

তবুও বাঙালির আবহমান কালের তন্ত্রনির্ভর মাতৃধর্মে সম্পৃক্ত চড়ক কৃচ্ছসাধনের মধ্যে দিয়ে, আত্মনির্যাতনের মধ্যে দিয়ে সেই পরমানন্দে লীন হয়ে যাওয়ার উদযাপন। “বল বল ঠাকুর আমার কত দিনে হবে সে প্রেম সঞ্চার—“এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই সচ্চিদানন্দের প্রেমে পাগল ভক্ত অনায়াসে জ্বলন্ত আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে যান, দুর্গন্ধযুক্ত গলিত শব কাঁধে নিয়ে পাগলের মতো নাচতে থাকেন, জ্বলন্ত আগুনের শলাকা দিয়ে বিদ্ধ করেন নিজের শরীর। ব্রিটিশ সরকার আইন করে বন্ধ করেছিল চড়কের দৈহিক নির্যাতনের অনেক প্রথা। কিন্তু প্রেমের প্রাবল্যকে আজ পর্যন্ত কেইবা রোধ করতে পেরেছে! তাই তো আজও গ্রামবাংলার বুকে মহাসমারোহে চড়কের উদযাপন, ভক্ত -সন্ন্যাসীর কৃচ্ছসাধন স্বমহিমায় বিরাজিত।
* সোমা চক্রবর্তী (Soma Chakrabarti), শিক্ষিকা, নিমতা জীবনতোষ ঘোষ মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল (উচ্চ মাধ্যমিক)।।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content