শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


সোফিয়া ও লিও টলস্টয়।

১৮৮২ সালে টলস্টয় মস্কো শহরে একটি পরিসংখ্যান নেবার কাজ করতে গিয়ে দরিদ্রদের অবস্থা নিজে চোখে দেখেন। তাদের অপুষ্টি, খাদ্যাভাব, অসুখ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখে অত্যন্ত ভীত হন। মানুষের এ ভাবে বাস করা অসম্ভব মনে হয় তার। এক আমূল পরিবর্তনের পরিকল্পনা করেন তার বই ‘What Are We To Do’ তে। তার মনে হল, সম্পদের প্রাচুর্যই সব নষ্টের মূল। এ ভাবনা তার নিজের জীবনেরও এক মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

১৮৮৩ সাল এ তিনি তার সব বিষয়আশয়, সাহিত্যকর্মের স্বত্বাধিকার, সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তার স্ত্রীকে দেন। ঋষির মতো নিঃসম্বল জীবন বেছে নেন। ব্যক্তিগত পুরোনো সব সুখের অভ্যাস বর্জন করলেন। নিজের সমস্ত কাজ, ঘর পরিষ্কার, জল তোলা, খাবার করা, নিজেই করতে শুরু করলেন। পোশাকও পরলেন সাধারণ কৃষকের মতো। নিজে হাতে জুতো বানানো শুরু করলেন। মেয়েদের তার হাতে বানানো জুতো পরতে বলতেন। এক সরল সাধারণ জীবনযাপন বেছে নিলেন।
এ ভাবে এক এক করে সব প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে লাগলেন। শিকার করা ছাড়লেন, ছাড়লেন মদ, মাংস, তামাক। এর সঙ্গে দরিদ্র কৃষকদের দান খয়রাত শুরু করলেন। রোজ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চাষি ও দরিদ্র মানুষেরা এই ঋষির মতো সাদা দাড়িওয়ালা, সাধারণ চাষির পোশাকের মানুষটির পায়ের কাছে বসে কথা শুনত ও তার বদান্যতা উপভোগ করতো। চাষিরা তাদের জীর্ন তেল চিটে পোশাকে, কাদামাখা বুট পরে চলে আসত। সোজা ঢুকে যেত টলস্টয়ের পড়ার ঘরে। কার্পেট এ ছোপ ছোপ কাদার ছাপ। চিটে গন্ধ। সোফিয়া ও তার মেয়ে সহ্য করতে পারতেন না। তার ডাইরিতে, ১৮৯০ সালে এ সব মানুষদের ‘ডার্ক ওয়ানস’ বলে উল্লেখ করেছেন।

টলস্টয় এর উচ্চ আদর্শ ও এ সব অনুগামী, এগুলো মেলাতে পারছিলেন না সোফিয়া। টলস্টয়ের মেয়ে আলেক্সান্দ্রাও লিখেছেন এ সব সুযোগসন্ধানী পরজীবীর মতো মানুষদের কথা। ম্যাক্সিম গোর্কির মতো লেখকও এদের সম্বন্ধে বিশদভাবে লিখেছেন। এদের ধর্মের নামে ভণ্ডামি, স্বার্থপরতা, অর্থলোলুপতা, টলস্টয়ের বাড়িকে যেন এক দূষিত আবহাওয়ায় সংক্রমিত করে রাখতো।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৩: টলস্টয় ও সোফিয়া—সে কি কেবলই যাতনাময়…/৩

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৫: সঙ্গীত অনুরাগিণী মা সারদা

টলস্টয় তাঁর ‘The Kreutzer Sonata’ গল্পে বিয়ে নিয়ে তার নৈরাশ্য ও হতাশার কথা বলেছেন। এই গল্পের একটি সংযোজন পরে প্রকাশিত হয়। সেখানে টলস্টয় বিয়ের পবিত্রতা রক্ষা নিয়ে খুব জোরালো প্রতিবেদন রাখেন। সোফিয়া তখন তেরো নম্বর সন্তান ইভানের জন্ম দিতে চলেছেন। এরকম এক দ্বিচারী মনোভাবে সোফিয়া বেজায় চটে গেলেন। তার ডাইরিতে লিখলেন, “ও আমায় খুব সুসংবদ্ধ ভাবে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে। ওর এই গল্পের পর আমার সতীত্ব নিয়ে হাসাহাসি হবে। আমি আর ওর সন্তানের মা হতে রাজি হবো না।”

১৮৯১ তে যখন গল্পটি সংযোজন-সহ প্রকাশিত হয় সোফিয়া অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তার অপমানিত হওয়ার কথা লেখেন। তার মনে হয় সমস্ত বিশ্বের কাছে এই বইতে তাকে ছোট করা হয়েছে। লিখলেন, “ও আমাকে এ ভাবে ছোট করে যে আঘাত করেছে তাতে আমার ওর প্রতি শেষ বিন্দু ভালোবাসাটুকুও নষ্ট হয়ে গেল।” সোফিয়া টলস্টয়ের ‘পবিত্রতার থিওরি এবং প্র্যাকটিস’ এর মধ্যে এক বিরাট ফারাক এর কথা লিখেছেন। তাঁর মতে, যে সব পাঠক টলস্টয়ের বই পড়ে তাঁকে দেবতার আসনে বসিয়েছেন, তাঁরা যদি লেখকের ব্যবহারিক জীবনের ছবি দেখতে পেত তবে তাঁকে বেদী থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিত। টলস্টয়ের মধ্যে এ বৈপরীত্য চূড়ান্তভাবে ছিল।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩১: হেমন্তবালা দেবী— রবি ঠাকুরের পত্রমিতা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বন লেবু ও টাগরি বানি

১৮৯১ সালে টলস্টয় তাঁর ১৮৮১ পরে প্রকাশিত সব লেখার স্বত্বাধিকার ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ নিয়ে আবার এক চরম অশান্তি ও ঝগড়া বাড়িতে। প্রায় প্রতিটি ঝগড়াই শেষ হত টলস্টয়ের বাড়ি ছেড়ে যাবার উদ্যোগ এবং সোফিয়ার আত্মহত্যার হুমকিতে। সোফিয়া এ বার রেল লাইনে ঝাঁপ দিতে গেলেন। তার ভাই ঠিকসময় গিয়ে না আটকালে হয়তো দুর্ঘটনা ঘটে যেত। ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত এ বারের ঝগড়া চলতে লাগলো। ইতিমধ্যে তার সাত বছর বয়সের ছোট ছেলে ইভান মারা গিয়েছে। এ সব মিলে সোফিয়া আরও বেশি হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

বিবাহিত জীবনের শেষ দশ বছর ক্রমাগত ঝগড়া, বাড়ি ছেড়ে যাওয়া এবং আত্মহত্যার হুমকি নিয়েই কাটে। সোফিয়ার সন্দেহ বদ্ধমূল হয়ে উঠল যে, তাঁর স্বামী সমস্ত লেখায় তাঁর চরিত্রহানি করেছেন। ক্রমাগত টলস্টয়ের ডাইরি ও তাঁদের ছবিগুলো নষ্ট করার প্রচেষ্টায় থাকতেন। একদিন রাতে টলস্টয়ের ঘরে সব কাগজপত্র খুঁজতে গিয়েছেন। টলস্টয় ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে বলেন। রাগ করে সোফিয়া সারারাত একটা পাতলা জামা পরে বাগানে ঠান্ডায় খোলা আকাশের নিচে কাটালেন। পরে ডাইরিতে লেখেন যে, তিনি ওভাবে মরতে চাইছিলেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বন লেবু ও টাগরি বানি

এ বার টলস্টয় রাগ করে তাঁর মতাদর্শে বিশ্বাসী Chartkov-কে তাঁর অবর্তমানে সমস্ত লেখালেখির দায়িত্ব দিলেন। সোফিয়া ‘Chartkov’ এর থেকে সব লেখাগুলো নেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ১৯১০ সালের ২২ জুন সোফিয়ার বয়স ৬৫ আর টলস্টয়ের ৮২। সোফিয়ার এক নার্ভাস ব্রেক ডাউন হল। উত্তেজনায় সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেলেন, আফিমের বোতল শেষ করলেন। নিজের প্রাণ নাশের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। বড় ছেলে সার্গেই সে দৃশ্যের বর্ণনা করেছেন। কীভাবে তাঁর মা ক্রমাগত বাবাকে একই ভাবে অভিযোগ করে যাচ্ছেন, ‘Chartkov’-কে হুমকি দিচ্ছেন ইত্যাদি।

ওই বছরের ২৮ অক্টোবর টলস্টয় সত্যি সত্যি গৃহত্যাগ করলেন। এ বারে আর হুমকি নয়। যাবার আগে সোফিয়াকে লিখলেন—

“আমি দুঃখিত যে আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু এটাই একমাত্র সমাধান। এ বাড়িতে আমি আর থাকতে পারছি না। আর প্লিজ বিশ্বাস করো এবং বোঝার চেষ্টা করো যে, আমি আর কিছুই করতে পারবো না। এরকম বৃদ্ধ বয়সে মানুষ যা করে আমি তাই করছি। বাকি দিনগুলো আমি একা শান্তিতে কাটাতে চাই।”
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২: অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন?

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১৩: অদ্বিতীয় সম্রাট

সোফিয়া অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়ে স্বামীকে ফিরে আসার অনুনয় বিনয় করে ভয় দেখিয়ে লিখলেন। এক সপ্তাহ বাদে স্বামীকে খুঁজে পেলেন। এক রেল লাইনের ধার দিয়ে হাঁটছেন। দূর থেকে সোফিয়া ডাকছেন। তিনি সাড়া দিলেন না। পরে ছেলেকে টেলিগ্রাম করে জানিয়েছেন যে তাঁদের মায়ের ডাকে সাড়া দেওয়া তাঁর সম্ভব ছিল না। তিনি এত দুর্বল যে, শরীরের পক্ষে সে মুহূর্তে চরম ক্ষতি হত। সে বছরই নভেম্বরের ৭ তারিখে, স্টেশনমাস্টারের ঘরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শেষ শয্যার পাশে ছিলেন তার বন্ধু ‘Chartkov’ এবং তিন ছেলেমেয়ে।

মৃত্যুর পর সোফিয়া লিখলেন, “আমি আটচল্লিশ বছর লেভ-এর সঙ্গে ঘর করেছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে বুঝতে পারলাম না, ও কেমন মানুষ”। টলস্টয়ের দাম্পত্য জীবন এমন কেন হল, সত্যিই বোঝা মুশকিল। এ তো ভালোবাসার অভাব নয়। ভালোবাসার বজ্র আঁটুনি এবং অহং। —চলবে।

ঋণ
Married to genius by Jeffrey Meyers
*ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content