টলস্টয় ও সোফিয়া।
বিয়ের পর থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে যে সমস্যা তাদের মধ্যে চলেছে তার মূল কারণ ঈর্ষা। একে অপরের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি শীল বা সহনশীল ছিলেন না। কেউ কারও ভালো লাগা, বন্ধু-বান্ধবকে সহ্য করতে পারতেন না। টলস্টয় যে খুব সাধারণ জীবনযাপন করতে চাইতেন, দরিদ্র কৃষকদের সঙ্গে সময় কাটাতেন সেটি সোফিয়ার মোটেই পছন্দ হতো না।
কিন্তু আশ্চর্যের কথা, সোফিয়া কিন্তু টলস্টয়ের লেখালেখির থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেননি। সংসার থেকেও। তিনি অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন। সোফিয়ার ভাই স্টিফেন বলেছেন ‘War and Peace’ এর মতো মস্ত উপন্যাস সোফিয়া সাত বার ম্যানুস্ক্রিপ্ট থেকে কপি করেছেন। টলস্টয়ের হাতের লেখা দুর্বোধ্য ছিল, তাই। ভাবাই যায় না। অতবড় উপন্যাস অধিকাংশ মানুষ পুরো পড়ে উঠতে পারেন না, সেখানে সাতবার কপি?
কিন্তু আশ্চর্যের কথা, সোফিয়া কিন্তু টলস্টয়ের লেখালেখির থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেননি। সংসার থেকেও। তিনি অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন। সোফিয়ার ভাই স্টিফেন বলেছেন ‘War and Peace’ এর মতো মস্ত উপন্যাস সোফিয়া সাত বার ম্যানুস্ক্রিপ্ট থেকে কপি করেছেন। টলস্টয়ের হাতের লেখা দুর্বোধ্য ছিল, তাই। ভাবাই যায় না। অতবড় উপন্যাস অধিকাংশ মানুষ পুরো পড়ে উঠতে পারেন না, সেখানে সাতবার কপি?
সোফিয়ার মতে কর্তব্যপালন করতে পারলে এক আনন্দ হয়। তাই সাংসারিক দায়িত্বগুলোও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন তিনি। আবার ডায়েরিতে লিখেছেন, “এ ভাবে স্বামীর জন্য খেটে মরা আমার ভাগ্য। আমার বোধহয় এ নিয়ে অভিযোগ থাকা উচিত নয়। এমন একজন বিখ্যাত মানুষের সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু কী করব! মাঝে মাঝে আমার মন জেহাদ ঘোষণা করে।”
আসলে সোফিয়া স্বামীর লেখালেখিতে সাহায্য করে আনন্দ পেতেন। আবার চাইতেন যে, স্বামী তার এই কাজের কদর করুন, মর্যাদা দিন। আরেক জায়গায় লিখেছেন, “লেভ যদি তার উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মতো আমার মনটা একটু বুঝতে পারত, আমার দুঃখ, আমার অভিমান!”
এছাড়া বিয়ের পর পঁচিশ বছরে সোফিয়ার তেরোটি সন্তান। তার মধ্যে তিনজন জন্মের পরও দু’জন শৈশবে মারা যায়। বাকিরা সব বাবা-মায়ের ঝগড়াঝাটি দেখে দেখেই বড় হয়েছে। ঝগড়ায় অংশও নিয়েছে কারও না কারও পক্ষে। সে-সব নিয়ে নিজেরা লিখেছে, আবার বাবা-মায়ের ডায়েরি এডিট-ও করেছে।
আসলে সোফিয়া স্বামীর লেখালেখিতে সাহায্য করে আনন্দ পেতেন। আবার চাইতেন যে, স্বামী তার এই কাজের কদর করুন, মর্যাদা দিন। আরেক জায়গায় লিখেছেন, “লেভ যদি তার উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মতো আমার মনটা একটু বুঝতে পারত, আমার দুঃখ, আমার অভিমান!”
এছাড়া বিয়ের পর পঁচিশ বছরে সোফিয়ার তেরোটি সন্তান। তার মধ্যে তিনজন জন্মের পরও দু’জন শৈশবে মারা যায়। বাকিরা সব বাবা-মায়ের ঝগড়াঝাটি দেখে দেখেই বড় হয়েছে। ঝগড়ায় অংশও নিয়েছে কারও না কারও পক্ষে। সে-সব নিয়ে নিজেরা লিখেছে, আবার বাবা-মায়ের ডায়েরি এডিট-ও করেছে।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৪: লোকশিক্ষক মা সারদা
সোফিয়া প্রথমদিকে একবার সন্তান জন্মের পর এত অসুস্থ হন যে বাচ্চাকে স্তন্যপান করানোর জন্য একজন মহিলাকে নিয়োগ করেন। এতে টলস্টয় ভয়ানক চটে যান। শুধু এটুকুই নয়। পঞ্চম সন্তান জন্ম দেওয়ার পর সোফিয়া মারাত্মক এক প্রায় মারণ জ্বরে আক্রান্ত হন। এ অবস্থায় সোফিয়া আবার মা হতে অস্বীকার করার টলস্টয় প্রচণ্ড রেগে গেলেন। তার পরও প্রতি বছর একটি করে সন্তানের জন্ম দিতে হয়েছে সোফিয়াকে। বারো নম্বর সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা যখন হল সোফিয়া তখন শারীরিক, মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত। একের পর এক সন্তান জন্ম, তাদের দেখভাল, তাদের অসুস্থতা এসব থেকে সেইবার মুক্তি পাওয়ার জন্য গর্ভপাতের চেষ্টা করলেন। চেষ্টা সফল হল না। মাঝের থেকে মানসিক ভাবে আরও অসুস্থ হয়ে পরলেন। টলস্টয়ের সঙ্গে তুচ্ছ কারণে প্রবল ঝগড়া বাঁধালেন। টলস্টয় পাগলের বাড়িতে বাস করছেন বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে উদ্যত হলেন। উত্তেজনা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে সোফিয়ার প্রসব যন্ত্রণা শুরু হল। টলস্টয় অনুতপ্ত হলেন এবং বাড়ি ফিরে এলেন। পর দিন সকালে সোফিয়া আরেকটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেন।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩০: নলিনী দাশ— গণ্ডালুর সৃজনশিল্পী
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা
সোফিয়ার ডায়েরিতে তাদের অনেক ঝগড়ার মধ্যে একটির বিস্তারিত ছবি আছে। বাড়ির আবহাওয়া বেশ শান্ত। কোনও তর্কাতর্কি, ঝগড়াঝাটি, মতানৈক্য নেই। হঠাৎ টলস্টয় এসে বললেন, “তোমায় একটা কথা বলতে এলাম। আমি ডিভোর্স চাই। এ ভাবে থাকতে পারছি না।” সোফিয়া তো হতভম্ব। কি হল এমন? জিজ্ঞাসা করতে বললেন, “একটা ঘোড়ার ওপর একের পর এক বোঝা চাপালে সে কি চলতে পারে? আমি এত বোঝা নিতে পারছি না।”
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৫: প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন পরীক্ষায় পাশই করবেন না
সোফিয়া চেষ্টা করলেন শান্ত থাকার। কিন্তু টলস্টয়ের গলা চড়তে লাগলো। সঙ্গে অনেক খারাপ কথার স্রোত। শেষে যখন বললেন, “এ বাড়ির পরিবেশ তুমি নোংরা করে ফেলছ। এখানে থাকা যায় না” তখন আর সোফিয়া স্থির থাকতে পারলেন না। নিজের বাক্সপত্র এনে বাড়ি ছেড়ে যাবেন বলে গোছাতে লাগলেন। টলস্টয় তাই দেখে আবার এগিয়ে এসে তাকে বাড়ি না ছাড়ার অনুরোধ জানালেন। কিন্তু সর্বক্ষণ তার শরীর রাগে কাঁপছে। দ্রুত নিঃশ্বাস পরছে। শেষ পর্যন্ত হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কেঁদে ফেললেন। এর মাঝে চার ছেলেমেয়ে এসে জড়ো হয়েছে। বাবা মা এর ঝগড়া দেখে ভয় পেয়ে তারও চিৎকার শুরু করে দিল। সে এক বিশ্রী হট্টগোলের মেলা।
ঋণ
● Married to genius by Jeffrey Meyers
*ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।