রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


টলস্টয় ও সোফিয়া।

“I hate and I love
Why I do this
Perhaps you ask
I know not, but I feel it happening
And I am tortured” —Catullus


লিও টলস্টয়ও সোফিয়া বেহরের এক দীর্ঘ অশান্তিময় বিবাহিত জীবন। বিয়ের শুরু থেকেই তার সূত্রপাত ও প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে নানা ঝড়ঝঞ্ঝার পর এর সমাপ্তি হয় একজনের আত্মহত্যার প্রচেষ্টায় ও ওপর জনের মৃত্যুতে। এমন দীর্ঘ যন্ত্রণাময়, নাটকীয়, ঘৃণা ও ভালোবাসার সম্পর্ক বিরল। প্রেমে পরেই বিয়ে। কিন্তু এমন কোনও বিষয় নেই, যা নিয়ে তাদের মতানৈক্য ও ঝগড়া হয়নি, প্রেম, যৌনতা, শিল্প, খ্যাতি, সম্পত্তি, ধর্ম, সংসার…সবই এ বেষ্টনীতে পরে, একজন স্ববিরোধী পুরুষের সঙ্গে এক দৃঢ়চেতা ও পরবর্তীতে নিউরোটিক মহিলার বিবাহিত জীবনে। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে কেউ কাউকে বোঝার চেষ্টা তো করেনইনি, সহ্যও করেননি। শেষ দিকের লড়াই বিভিন্ন ভাবে জনসমক্ষে এসেছে তাদের ডাইরি, ছেলেমেয়েদের লেখা এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ছবি থেকে।
কাউন্ট লিও টলস্টয় ছিলেন বেহর পরিবারের এক পুরোনো বন্ধু। তিনি যখন সোফিয়ার প্রেমে পরেন তখন তার বয়েস চৌত্রিশ আর সোফিয়ার আঠারো। সালটা আঠারোশ বাষট্টি। এক অভিজাত ডাক্তারের অপরূপ সুন্দরী কন্যা সোফিয়া।

টলস্টয় তখন পড়াশুনো শেষে আর্মি অফিসারের কাজ করে, ইউরোপের নানা দেশে ভ্রমণ শেষ করে কৃষক পরিবারের শিশুদের জন্য স্কুল করেছেন। নিজের এস্টেটে স্কুল। নিজেই পড়ান। ইতিমধ্যে লেখক হিসেবে খ্যাতি ও হয়েছে একটু আধটু। ছাত্র জীবনে ও আর্মিতে কাজ করার সময়ই তার মদ, জুয়া ইত্যাদি নানা উচ্ছৃঙ্খলতায় দিন কেটেছে। আবার অন্যদিকে তিনি অত্যন্ত প্রগতিশীল ও আদর্শবাদী। নিজের দশ বছর হওয়ার আগেই হারিয়েছেন বাবা মাকে। তাই বিয়েকে পারিবারিক সুখ ও তার সঙ্গে নিজেকেও উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে মুক্ত করার এক আদর্শ পথ মনে করলেন।
আরও পড়ুন:

শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-১: তিনকন্যা

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৬: প্রথমে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির বিজ্ঞাপনে উত্তম কুমারকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি

আঠারোশ বাষট্টির আগস্ট মাসের শেষ। বেহর পরিবারের সঙ্গে সন্ধেটা কাটিয়ে টলস্টয় নিজের ডাইরিতে লিখলেন তার সোফিয়ার প্রতি তীব্র প্রেম ও দিশেহারা অবস্থার কথা।

“সন্ধ্যেটা বেহর পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে এলাম! কী অপূর্ব সুন্দর। আমার মন উথালপাথাল। কিন্তু ও তো নিতান্তই বালিকা। একে কি বলে প্রেমে পরা না সত্যিই ভালোবাসা। বুঝতে পারছি না। আমার বয়েস চৌত্রিশ। মুখখানা দেখলে কারও আরেকবার তাকাতে ইচ্ছে হবে না। …না না, বিয়ের কথা ভাবা উচিত নয়। আমার জীবনের এক মহৎ উদ্যেশ্য আছে। আমার সব কিছু সেখানেই নিবেদিত। আমি কোন পথে যাব…নিজেকেই নিজে ভয় পাচ্ছি।”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫২: দেশহিতৈষী মা সারদা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৮: জ্ঞানদানন্দিনী দেবী—উনিশ শতকের বলিষ্ঠ লেখক এবং সমাজসংস্কারক

তার মনের মধ্যে প্রত্যাশিত বিবাহিত জীবন ও মজ্জায়ত শিল্পী জীবনের এক তীব্র লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি এ লেখা। সাধারণ মানুষ হিসেবে তীব্র প্যাশন আর শিল্পীসত্ত্বার আদর্শের লড়াই। অবস্থা আরও জটিলতর হয় কারণ টলস্টয় হিসেব মতো সোফিয়ার বড় দিদির পাণিপ্রার্থী। আবার সোফিয়ার ও ইতিমধ্যে এক পাণিপ্রার্থী আছে। তাহলে?
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭১: সাইকেল ও জীবন

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪২: আর যাহা খাও বাপু বিষমটি খেয়ো না

টলস্টয়ের প্যাশন জয়ী হয়। পরের মাসে সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব পেরিয়ে দুম করে চিঠি লিখে বসলেন সোফিয়াকে। নিজের অনুভূতি পরিষ্কার ভাবে বিশ্লেষণ করে। “সোফিয়া, সত্যি করে বলো তুমি আমার স্ত্রী হবে কি না। নিজের অন্তঃস্থলে ঢুকে জিজ্ঞাসা করো, আমায় স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে কিনা। তুমি রাজি না ও হতে পার। তোমার থেকে না কথাটি শুনলে আমার বড়জোর খারাপ লাগবে কিন্তু তার চেয়েও ভয়ানক হবে যদি তুমি আমায় বিয়ের পর পরিপূর্ণ ভাবে ভালোবাসতে না পারো…আমি যেমনটি তোমায় বাসি।”

সোফিয়া তো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সম্মতি জানায়। সম্মতি পেতে যেটুকু দেরি। এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ের আয়োজন সম্পূর্ণ করে ফেললেন টলস্টয়। তার আশা বিয়ে করলেই তার দুর্দম প্যাশনকে বাগে আনা যাবে। দূর হবে মনের সব দ্বন্দ্ব।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৯: মহাভারতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আখ্যান-উপাখ্যান, তেমনই একটি সম্বরণ ও তপতীর কাহিনি

টলস্টয় রচিত বিখ্যাত উপন্যাস ‘আনা কারেনিনা’ চরিত্র ‘লেভিন’ তার নিজের আদলে তৈরি। বিয়ের আগেই প্রাক বিবাহ নারীসঙ্গের গল্প করেছে ‘লেভিন’ তার দয়িতা কিটির সঙ্গে। টলস্টয় নিজে যখন তার ডাইরি খুলে যৌবনের প্রেমিকাদের কথা পড়লেন সোফিয়া মুখে তাকে ক্ষমা করলেন কিন্তু খুব আঘাত পেলেন। ঈর্ষা জমলো বিবাহপূর্বর প্রেমিকাদের প্রতি। অবিশ্বাসের বীজ বোনা হয়ে গেল অলক্ষ্যে। —চলবে।

ঋণ
Married to genius by Jeffrey Meyers
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content