শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


সঙ্গীতগুরু দীপালি নাগ। ছবি: সংগৃহীত।

সেদিন সোনি লিভ-এ ‘রকেট বয়েস’ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, কতটা সৌভাগ্য হলে এমন মানুষদের কাছে থেকে দেখা যায়। যাঁর কর্মকাণ্ড দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে মজবুত করেছে। যাঁর সহকর্মীরা দেশের বিশিষ্টজন।

একটা কথা না বলে পারছি না যে, ড. বিডি নাগ চৌধুরী বা মাসি দেশ পরিচালনা বা সঙ্গীত ক্ষেত্রের বিখ্যাত মানুষজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সত্ত্বেও মানুষ হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত অতিথিবৎসল। সহৃদয় প্রচারবিমুখ সদালাপী। সর্বদা মাটির কাছাকাছি।
একবার পশ্চিমবঙ্গের সেই সময়কার রাজ্যপাল ত্রিভুবন নারায়ণ সিং ওঁর বাড়িতে আসবেন। মাসিরা আগ্রার বিশিষ্ঠ প্রবাসী বাঙালি পরিবার। সেই সূত্রেই হয়তো যোগাযোগ। বাবার কাছে শুনেছিলাম ত্রিভুবন নারায়ণ সিং আমাদের রাজ্যের রাজ্যপাল হওয়ার আগে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। বাবার কাছে আরও শুনেছিলাম লালাবাহাদুর শাস্ত্রীর সময়ে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও ছিলেন।

খুব সম্ভবত দিনটা রবিবার ছিল। কিন্তু ওই সময়ে স্কুলের পরীক্ষা চলায় আর সামিল হতে পারলাম না। সেই বয়সে সেরকম কিছু মনে না হলেও এখন যেন মনকে একটু পীড়া দেয়। এও মনে হয় তখন যদি এখনকার মতো মোবাইল থাকতো ! সেইসব অবিস্মরণীয় মূহুর্তদের আজীবন ধরে রাখা যেত।
আরও পড়ুন:

ফেলে আসা স্মৃতি: সুরসম্রাজ্ঞী দীপালি নাগ, পর্ব-৫: আজও আমায় স্পর্শ করে আছে গানঘরে বসে শোনা তাঁর অনেক অনেক গান

দেশের প্রথম আধুনিক চিত্রকর নিরীহের হত্যা মানতে না পেরে গৃহত্যাগী হন

এলেন মালবিকা কানন। সেবার আমি আর মিস করিনি। আর রাজ্যপাল আসার দিনে না যেতে পারার মনকষ্ট যেন নিমেষে উধাও হয়ে যায় যখন সেই স্বনামধন্যা ধ্রুপদী শিল্পী মালবিকা কাননের কথা মনে আসে। তিনি ছিলেন মার্গ-সংগীতের প্রবাদপ্রতিম এ টি কাননের ছাত্রী এবং বাস্তবজীবনে সহধর্মিনী। ওঁদের নাম আমি মায়ের মুখে শুনেছিলাম কিন্তু চোখে দেখিনি কখনও। এটি কাননের পুরো নাম অর্কূট কান্নাভিরণ- তিনি ‘কিরানা ঘরানা’র রাগসঙ্গীতের এক কিংবদন্তি।

ভূতপূর্ব কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল ত্রিভূবন নারায়ণ সিং।

শারদীয়া দুর্গাপুজোর এক ষষ্ঠীর সন্ধ্যা। মালবিকা কানন আসছেন মাসির বাড়িতে। রাস্তাঘাট সর্বত্র সেজে উঠেছে শারদোৎসবে। প্যান্ডেল প্রতিমা লাউড স্পিকার-এর গান এসবের মধ্যে দিয়ে এলাম বাবার সঙ্গে। আমোদও হচ্ছে বেশ। সেদিন তো শুধুই গান শোনা।
সেদিন চেনা-অচেনা কত যে লোক এসেছেন। নিচে দরজার বাইরে চটির পাহাড়। বাবা পিছনদিকে বসলেন। কিন্তু আমি টপকে টপকে একেবারে সামনে। যেখানে বসে শিল্পী গান করবেন। আমার কাছেই দুই মহীরুহ। স্বনামধন্যা শ্রীমতি মালবিকা কানন আর বাঙলা রাগপ্রধানের সম্রাজ্ঞী দীপালি নাগ। মাসি আমায় দেখে মৃদু হাসলেন। বুঝলাম আমি এখানে বসার অনুমতি পেয়ে গিয়েছি।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর

পরিযায়ী মন, পর্ব-৯: সাসারামের ঝর্ণাধারা

এমন এক প্রতিভা যিনি সাংগীতিক চর্চার বাইরেও দেশের নানা প্রান্তে রাগসঙ্গীত নিয়ে সেমিনারে অংশ নেওয়া বা বক্তৃতার প্রস্তুতি, বিদেশে ভারতীয় রাগসঙ্গীতের প্রতিনিধিত্ব করা, হিন্দি বাংলা ইংরেজিতে যশস্বী শিল্পীদের সঙ্গে অনর্গল সাক্ষাতকারভিত্তিক অনুষ্ঠান… তবু তিনি আমাদের মতো অতি সাধারণের জন্যেও সর্বদা সমান মনোযোগী। কখনও মনে হয়েছে তাঁর কাছে সেকালের মতো নাড়া বেঁধে গান শিখি ! এমন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে শুধু গান নয় সম্ভবত জীবনবোধটাই বদলে ফেলা যায়।

মালবিকা কানন সেই সন্ধ্যায় গেয়েছিলেন পুরিয়া ধানেশ্রী রাগে বড় খেয়াল। শেষ করলেন ঠুংরিতে। অপরিণত মনে চিরস্থায়ী হয়ে রইল শিল্পীর অপূর্ব গায়কী। ছবিটা আজও যেন দেখতে পাই। পাশে টেলিফোন আর কফিকাপ, ফ্লাস্ক রাখা ছিল। মাঝে মাঝে গানের বিরতিতে কফিতে চুমুক দিচ্ছেন। আর সেদিন এটি কানন সম্ভবত অসুস্থ ছিলেন প্রায়ই ফোনে খবর নিচ্ছেন জ্বর কেমন আছে? আজও প্রতি শারদষষ্ঠীর সন্ধ্যায় সেই অনুপম স্মৃতি আমায় যেন সে গানঘর ফিরিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৯: সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সবই দেখি তা না না না?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৪: সারদা মায়ের বিশ্বাসে জাগ্রতা হল দেবী সিংহবাহিনী

আমার গানের ক্ষেত্রে বাবার সাহচর্য ছিল সর্বদা। কিন্তু বাবা আচমকা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বেশ কয়েকবছরের জন্যে বাবা চিকিৎসাধীন ছিলেন। লম্বা ছেদ পড়ল মাসির কাছে যাওয়াতে। সঙ্গে সঙ্গে উঁচুক্লাসের পড়াশোনার স্বাভাবিক চাপ। সে ছিল বড় কঠিন সময়। তবে বাড়িতে সুকান্ত মাস্টারমশায়ের কাছে গানের সাধারণ চর্চা বজায় ছিল। তাঁর কাছেই ক্লাস-টু থেকে আমার গানের হাতেখড়ি। মাস্টারমশায়ের কাছেও আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তবে মাসির কাছে ওই সাংগীতিক পরিমণ্ডলে আর পৌঁছতে না পারার অভাবটা যেন এখনও উপলব্ধি করি।

কিংবদন্তি সাঙ্গীতিক দম্পতি শ্রীমতি মালবিকা কানন এবং এটি কানন। ছবি: সংগৃহীত।

এর বহুদিন বাদে টেলিভিশনে ‘সপ্তসুর’-এর অনুষ্ঠানে সেই চেনা মানুষদের আবার দেখতে পেয়ে আর থাকতে পারলাম না। তৎক্ষণাৎ মাসিকে ফোন করলাম। উনি নিজেই ধরলেন। আমার পরিচয় দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম।

মাসি আমায় চিনতে পেরেছেন!

একটু থেমে উত্তর এল

তোমায় কি ভোলা যায় মা?

কানে যেন বাজতে লাগলো তাঁরই জনপ্রিয় গান “আমায় বোলো না ভুলিতে বোলো না”…। আমিও ভুলতে পারিনি। আজও।

অমন এক কৃতী মানুষের সস্নেহ প্রশ্রয়ের কথা ভাবলে আজ এত বছর বাদেও কৃতজ্ঞতায় চোখে জল চলে আসে।

ভ্রমণকথা লেখার চেষ্টা করি। ভালোও লাগে লিখতে। যদিও মাসিকে ঘিরে নানান স্মৃতি প্রায়শই মনের অন্তরালে এসে উঁকি দিয়ে যেত কিন্তু এমন বড়ো মাপের মানুষকে নিয়ে লেখার কথা ভাবিনি কখনও। এ সব কিছুই হয়ত মনের পাতাতেই থেকে যেত। সময় আপডেটস-এর সম্পাদক ভ্রাতৃপ্রতিম স্নেহাশিসের উৎসাহ আর স্বামী জিতের উদ্যোগেই ‘ফেলে আসা স্মৃতি’ শেষ করা সম্ভব হল।
—শেষ।
*লেখিকা চন্দ্রাণী সরকারের ভালোবাসা গান, সংসার, বেড়ানো, ভ্রমণকথা লেখা।

Skip to content