শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


জাতকমালার গত পর্বের গল্পে দেখা গিয়েছিল এক চতুর শেয়াল-দম্পতি এবং এক নিরীহ কিন্তু বুদ্ধিমতী ছাগীকে। আজকের গল্পটির প্রতিপাদ্য প্রায় একরকম, এবং আগের কাহিনিতে মুখ্যচরিত্র না হলেও এই কাহিনিতে বোধিসত্ত্ব যথারীতি মুখ্য চরিত্র। তবে প্রতিপাদ্য কাহিনি নয়, এই গল্পের মূল অংশ হল এর ভাববস্তু, উপদেশ।
গল্পে দেখা যাচ্ছে কৌশাম্বীনগরে রাজা কৌশাম্বকের রাজত্বকালে বোধিসত্ত্ব এক অরণ্যে কুক্কুট বা মোরগ হয়ে জন্ম নিয়েছেন, শতশত কুক্কুটের মাঝে একজন হয়ে তাঁর বাস। অদূরেই একটি শ্যেন বা বাজপাখি বাস করে, নানা কৌশলে কুক্কুট ধরে ধরে উদরসাৎ করে। ক্রমে বোধিসত্ত্ব ছাড়া আর সকল কুক্কুট নিহত হল। বোধিসত্ত্ব অরণ্যের গভীর, নিবিড়তম প্রদেশে প্রবেশ করে সাবধানে বাস করেন। শ্যেন তাঁকে করায়ত্ত করতে পারে না। মনে মনে ভাবে একে প্রবঞ্চিত করতে হবে যেনতেনপ্রকারেণ, তাই সে মোরগটির অদূরেই একটি বৃক্ষশাখায় বসে তাকে লোভ দেখানোর জন্য বলতে লাগল, “ভাই, ভয় নেই, এস, বন্ধু হও। চল, একজায়গায় প্রচুর খাদ্য আছে, সেখানে মনের সুখে দুজনে বন্ধু হয়ে থাকব।” বোধিসত্ত্ব তাকে প্রত্যাখ্যান করলে সে বারবার অনুরোধ করে বলল “আমি যে পাপ করেছি তার জন্যই আমাকে তুমি বিশ্বাস করছো না ভাইটি, এখন আমি ভালো হয়ে গিয়েছি, আগের মতো খারাপ কাজ আর করবো না।” বোধিসত্ত্ব তবুও তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন, বার বার তিনবার প্রত্যাখ্যান করে তিনি বনভূমি নিনাদিত করে আবারও জানালেন “তোমার বন্ধুত্বে আমার প্রয়োজন নেই, তুমি চলে যাও।”
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৮: সুন্দরবনের পাখি — শালিক

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭১: ধর্মকার্যের জন্য টাকা জোগাড় করা আর সাদা কাপড়ে ময়লা লাগিয়ে ধোয়া, দুই-ই সমান

এই হল কাহিনি এবং বলা বাহুল্য যে এর অতিপরিচিত প্যাটার্নটিতে শুভবোধের জয়ের উদ্ঘোষণ শোনা যায়। তবে কাহিনি এখানেই শেষ নয়। এই গল্পের প্রত্যক্ষ উপদেশ, অন্তর্নিহিত তাত্পর্যকে অতিক্রম মুখ্য হয়ে ওঠে। কুক্কুটরূপী বোধিসত্ত্ব এরপরে দৈবলব্ধ বোধকে মহানিনাদে গাথায় গাথায় জানাতে থাকবেন, ভাঙাবেন রাত্রিতে জমে ওঠা সুষুপ্তি।

কাদের সঙ্গে মৈত্রী অনুচিত?
পাপকর্মা, মিথ্যাবাদী, স্বার্থপর এবং অতি সাধু সেজে যে জন এগিয়ে আসে, এই চতুর্বিধ মানুষ একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

পিপাসার্ত গরুর মতো যারা আগ্রাসী আরক্তচোখে সামনে যে থাকে তাকেই আহত করে, যাদের তৃষ্ণা অল্পতে পরিতৃপ্ত হয় না, মিত্রের সর্বস্ব হরণ করে মিষ্টি মিষ্টি কথায় যারা ভুলিয়ে রাখতে চায়, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে একেবারেই তা নয় যারা, যারা হাত পেতে দান গ্রহণ করেও সেই দানে সুখী নয়, যাদের শুষ্ক করপুটকে কোনও দানই সিক্ত করতে পারে না, বাক্যালাপে যারা মনোভাব সঙ্গোপনে লুকিয়ে রাখে, সেই অসার প্রকৃতির অকৃতজ্ঞদের সঙ্গে বন্ধুত্ব? নিষিদ্ধ। তাদের সঙ্গে সাবধানে দূরত্ব রক্ষা করতে হবে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৩: গ্রহের ফের

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা/৫

এছাড়াও যারা নিজের বোধ-বুদ্ধিকে প্রয়োগ না করে অন্যের কথায় স্বকর্মে প্রবৃত্ত হয়, প্ররোচিত হয় এমন দুর্বলচিত্ত মূঢ়চেতা মানুষ, পূর্বে প্রতিজ্ঞাত বিষয় থেকে নানা ছলাকলায় সরে যায় যারা এমন কথা দিয়েও কথা না রাখা ব্যক্তি কখনোই বিশ্বাসের যোগ্য নয়।

নানা অকর্ম-দুষ্কর্ম করাই যাদের স্বাভাবিক প্রবণতা, নিজের কথার ওপরেই যাদের কোনও শ্রদ্ধা নেই, সুযোগ পেলেই যারা মানুষের ক্ষতি করতে উন্মুখ, কোশবদ্ধ তরোয়ালের মতো প্রচ্ছন্নস্বভাব যে, তাকে বর্জন করতে হয়।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১৬: পূতিমাংসজাতক—শেয়ালের বুদ্ধি না ছাগলের বুদ্ধি?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৬: জীবন নিয়ে কৌতুক আর ‘যৌতুক’

যারা মধুরবচনে বন্ধু সেজে থাকে, অথচ মনে-মুখে যারা এক নয়, নানা ছলে কৌশলে মনোহরণের উপায় অবলম্বন করে যারা তারা বন্ধু হয় না। পরশ্রীকাতর যারা বন্ধুর সম্পন্নতায় লুব্ধ হয়ে তা হরণের চেষ্টা করে, যারা রক্ষকের বেশে ভক্ষক হয়ে বিশ্বাসঘাতন করে, তাদের সঙ্গে মৈত্রী নিষিদ্ধ।

কুক্কুট সেই বিপদ্‌সঙ্কুল ঘোর অরণ্যে শ্যেনের মৈত্রীপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। যে আসন্ন বিপদকে চিনতে পেরে তাকে নিবারণ করতে পারে সে যথার্থ প্রাজ্ঞ। যে পারে না সে শত্রুর কবলে ঘোর বিপন্ন হয়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০১: অর্জুন প্রমাণ করলেন, রাজধর্ম পালনের ক্ষেত্রে মিথ্যাচারের কোনও স্থান নেই

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১২: দারুণ এক গগনবিহারী খেলনা বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ

সমাজের বনে বনে ঝোপে ঝোপে এমন সর্বনাশপরায়ণ, বকধার্মিক, ধূর্ত, ভাজা মাছ উল্টে খেতে না পারা মিষ্টভাষী মিত্রবেশী শত্রু, ভণ্ডের দল ঘুরছে। ঘুরছে হীনবল, মূঢ়, সুযোগসন্ধানী কাপুরুষের দল। বিচক্ষণ মানুষ সেই দুর্জনদের বিলক্ষণ চিনে নিতে পারেন। যেমন কুক্কুট চিনেছিল শ্যেনকে, তাকে সাবধান করে বলেছিল “যদি আর এই বনে বাস করো, তবে দেখবে আমি কী করি!” আলোয় যেমন অজ্ঞানের আঁধার মুছে যায়, তেমনই তার এই অকৃত্রিম সত্যবুদ্ধির সামনে ভণ্ড বাজপাখি বিচলিত হয়েছিল, ভীত হয়ে অচিরেই সেই বন ত্যাগ করে পালিয়ে গেল সে।

জীবনে নিয়তই অজানার হাতছানি। আজ পথেঘাটে, সমাজমাধ্যমে, কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র বন্ধু হতে চাওয়ার দৌড়, এগিয়ে আসছে বন্ধুত্বের হাত সর্বত্র। তার পিছু পিছুই কখনও আসে বিপদ। অথচ, বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না! তাই সেই হাত আদৌ ধরা যায় কীনা, তা নিজেকেই বুঝে নিতে হবে, গল্পে গল্পেই জেগে উঠবে চেতনা।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content