মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


নববর্ষ প্রতিবার আসে। শিব্রাম এই নিয়ে তাঁর অনাগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন। কারণ, যতই যা কিছু হোক না কেন, একবছরের বেশি টেকে না যে তা!!

যাঁরা এরকম বলতে পারেন, তাঁরা ঋষি। তাঁদের কথা মন্ত্র-ই।

তবুও নববর্ষ এলে কিছু বলতে হয়। রবিবাবুর গানে গানে নতুন পুরাতন সব অচলায়তন ভেঙে ভেঙে গ্রীষ্মের অগ্নিস্নানে শুদ্ধ হয়ে, বৈশাখের যাবতীয় তাপকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঘামতে ঘামতে “এর অপেক্ষাতেই তো ছিলাম” এরকম একটা নিস্পৃহ ভাব দেখানোই ইদানিং বর্ষবরণ। তারপর যে যার মতো শীতলতা খুঁজতে খুঁজতে এক সময় দেখা যায়, বছরটা আবার অচল হয়ে গিয়েছে।
সে-ভাবে দেখতে গেলে অতীতমাত্রেই তাহলে পরিত্যজ্য, তা আবর্জনার মতো, যা কিছু গিয়েছে, তা যাক! ভাঙা বাটি, ছেঁড়া কাগজ, পুরনো বছর, জীর্ণ পাতা। ছেড়ে যাওয়া ভাঙা দিনের ঢেলা, পুরনো অভ্যাস, সযত্নলালিত স্মৃতি, ভুলে যেতে বসা গান, গল্প, ভালোবাসা, স্পর্শ, বেদনা কিংবা ভোলা দিনের কাঁদন-হাসির রোজনামচা। মোট কথা, আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। চরৈবেতি। রোজ নতুন দিন। রোজ নতুন স্বপ্ন, বিশ্বাস, বেদনা কিংবা আনন্দের মাঝে পিছনের রাস্তার ধুলোবালি জমিয়ে লাভটা কী! বর্তমানটাই একমাত্র সত্য। বলা ভালো, ক্ষণিকের সুখটুকুই শাশ্বত।

অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ সব বর্তমানের বন্দরে নোঙর করে, আসে যায়। অতয়েব হে বন্ধুগণ, আমাদের মাঝে চলে এসেছে বহুপ্রতীক্ষিত সেই বাংলা নতুন বছর। কাল থেকেই তা একটু একটু করে পুরনো হবে। পরশু সে পুরনো হয়ে যাবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না কালের চিরচঞ্চল দুর্বার গতি। ভাঙা দিনের ঢেলা হওয়া তার নিতান্ত ভবিতব্য। তার এই ক্ষণকাল থেকে চিরকালের থাকাটা কে কীভাবে উদযাপন করতে চায় সেটাই সত্য হয়েও এক মস্ত আলেয়া। কিন্তু, মালা ধূপ চন্দন আর মিষ্টি কথা নিয়ে তার মঙ্গাচরণ করতে হয়। যাতে ভালো ভালো ব্যাপারের ঘাটতি না পড়ে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩২: কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত?

ত্রিপুরায় বছর সন্ধির কৃষিকেন্দ্রিক পার্বণ

সব যে কেমন ভালো হয়, তা নিয়ে কারও সন্দেহ-ই মেটে না। তার আগেই আরেকটা নতুন কিছু এসে যায়। কেন না, ভালোর যথার্থ সংজ্ঞা অভিধানে থাকে না। ধীমান মানুষ-ও ভালো জিনিসটা আসলে কী তা নিয়ে ধন্ধে থাকেন। তবু, নতুন কিছুর জন্য সকলের সবিশেষ উত্তেজনা থাকে। কালিদাসের ছিল। হরিদাসদের-ও আছে। নতুন ব্যাপারটা যে বেশ থ্রিলিং তা বেশ বোঝা যায়, যখন পাড়াতুতো সারমেয় একই বিস্কুটে নারাজ হয়। বিস্কুট বদলালে সে আহ্লাদিত হয়। সেই বিস্কুট চলতে থাকলে তাতে ভাঁটা পড়াটাই দস্তুর। কবি বলেছেন, হেসে নাও, দু’দিন বৈ তো নয়!

আসলে নতুনের জগৎটা কী বা কেন তা নিয়ে ভাবনার অবসর বা মাথাব্যথা কমে গিয়েছে। পুরাতনের জগৎটা কী বা কেন তা নিয়ে ভাবনার অবসর বা মাথাব্যথা কমে গিয়েছে। ভাবি জগৎটা কী বা কেন তা নিয়ে ভাবনার অবসর বা মাথাব্যথা কমে গিয়েছে। তাই এখন সবসময় নতুনের যোগান না থাকলে জগৎ অচল। পুরাতন না থাকলে ভাঙানোর উপাদানের অভাব। আর যা কিছু করা সব তো ভবিষ্যতের জন্য।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৯: কামিনী রায়, জনৈক বঙ্গমহিলা

নতুন-পুরাতনের ফারাক ঊনিশ-বিশে। পুরাতনের পাশেই নতুনের বাস। তবুও, পয়লা নম্বর নিয়ে টানাটানি কম নয়। দোসরার দোসর হতে কেউ ততটা ইচ্ছুক নয়। খাঁটি মানেই এক নং। আর তার পরেই নকল, দুনম্বরি। তাই একলা বৈশাখ পয়লা বৈশাখ উদয় দিগন্তে শঙ্খ বাজিয়ে জীবনের জয় আর অসীমের চিরবিস্ময় হয়ে দেখা দেয়।

আর তাই, পড়ে পাওয়া অবশ্যম্ভাবী নতুনটাকে ঘষে ঘষে পালিশ তুলে কায়মনোবাক্যে পুরাতন করে খরচের খাতায় তোলাটাই জাগতিক কর্তব্য। একে অনেকে আবাহন বলেন। কেউ বলবেন, নিজের করে নেওয়া। সবটাই সত্য। বিসর্জনের শোভাযাত্রা বলতে চাইলেও তা মিথ্যা নয়।

তাই, হে বন্ধুগণ, হাই গাইজ!! প্রতি বছরের মতো নিয়ম করে পয়লা বৈশাখ এসে গিয়েছে। বঙ্গাব্দের ভাণ্ডারে আরেকটি নতুন বছর জমবে। বাঙালির বছর, বাংলা ভাষাভাষীর বছর, বাংলার সঙ্গে সম্পৃক্ত “যা কিছু” তাদের বছর। প্রাচীন বঙ্গলক্ষ্মীর গোলায় এ সময়ে ধানের সম্ভার, আজও। প্রাচীন বঙ্গজীবন এই সময়ের আনন্দঘন উৎসবকালকে মঙ্গলপ্রতীকে বিশেষ তাত্পর্যে আর অনিবার্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক দ্যোতনায় আত্মস্থ করেছে। কবিরা যুগে যুগে তাকে সম্পন্ন, সমৃদ্ধ করেছেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪১: মা সারদার অন্তরঙ্গ সেবক শরৎ মহারাজ

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৮: যুগান্তরেও রামচন্দ্র, পুরুষোত্তমরূপে প্রসিদ্ধ কেন?

বাঙালি তার পঞ্জিকায় নববর্ষকে জেনেছে, আলপনায় তাকে ভরিয়েছে। পুরনো কর্জ মিটিয়ে নতুন জমার হিসাব শুরু করেছে। নতুন নতুন স্বপ্নজাল বুনতে চেয়েছে। এর সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে তার জীবনশৈলীর চেনাবাঁধা ছক, পছন্দ অপছন্দের টুকিটাকি। তারপরেও নদী তার নিজের ছন্দে চলেছে। বাতাস বয়েছে আপন খেয়ালে। তার তুলসীতলার জলের ঝারা, সন্ধ্যাদীপ, গোষ্ঠের গান, মাটির সরা আর সানকির নস্টালজিয়া, বারপুজো, হালখাতা, হাতপাখা, কোঁচানো ধুতি আর গামছার বৈভবের বাঙালিয়ানা কালিঘাটের পটে আঁকা পটলচেরা চোখের বাবুবিবির মতো পঞ্জিকা হাতে জেগে আছে।

গতবছর কিংবা তার আগের বছরের মতোই নতুন বছর, নববর্ষ ১৪৩১ আজ নতুন সূর্যের হাত ধরে এসে গেছে তার নতুন ক্যালেন্ডার, জমা-খরচের হিসেব, মিষ্টির বাক্স, হাফ ও ফুল পঞ্জিকা নিয়ে। সারা বছরের অমাবস্যা, পূর্ণিমা, একাদশী আর উৎসবের খবর সালতামামি নিয়ে ঢুকছে আপ ১৪৩১, চারিদিকে উত্সব। সূয্যিমামা বৈশাখী বেলায় দুরন্ত ব্যাট করবেন। সকলে তৈরি তো?
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content