বুধবার ২৯ জানুয়ারি, ২০২৫


প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত, মূল্যবান এবং স্বতন্ত্র সাহিত্যিক ঐতিহ্য সম্বলিত ভারতীয় ভাষা যার সঙ্গে অন্য কোনও সাহিত্যিক ঐতিহ্যের পরম্পরা নয়, বরং স্বাধীন এবং সাবলম্বীভাবে গড়ে উঠেছিল তেমন ভাষাই ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আশ্বিনের শারদপ্রাতে বাংলা ভাষা বহুকাঙ্খিত ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেল।

চলতি বছর ভারত সরকার কয়েকটি ভাষাকে শাস্ত্রীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে তামিল, তেলেগু এবং সংস্কৃত ভাষা ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পেলেও বাংলা ভাষাকে অপেক্ষা করতে হল ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর পর্যন্ত। মারাঠি, পালি, অসমীয়া ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষাও সরকারি মানদণ্ডের নানা স্তর পেরিয়ে তার ঐতিহ্য রক্ষার লড়াইয়ে ছিনিয়ে নিয়েছে নিজস্ব মুকুট। তবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলার মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি পেলেও এই স্বীকৃতির জন্য যে অপেক্ষা বাঙালিকে করতে হয়েছে তাও বেশ দুঃখের এবং বেদনার।
সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি যে ভাষার কথা হয় সেই তালিকায় বাংলার স্থান পঞ্চমে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলা বলতে পারেন ২৫ কোটি মানুষ। সেই ২৫ কোটি মানুষ কি বাংলায় কথা বলেন এবং লেখেন? তাই যদি হতো তাহলে কি আজ বাংলা ভাষার পিঠ দেয়ালে ঠেকে যেত? কি মর্মান্তিক পরিণতি আজ বাংলা ভাষার। সেই ভাষাকে একটি মুকুট পরিয়ে কি বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব? আজ এই প্রশ্ন বারংবার ধ্বনিত হচ্ছে আনাচে-কানাচে।

বিদ্যাসাগর, রামমোহন যে ভাষাকে বাঙালির প্রাণের ভাষা করে তুলেছিলেন, লালন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি যে ভাষায় সুর তুলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল যে ভাষায় আপামর জনগণের প্রাণে দোলা লাগিয়েছিলেন সেই ভাষার অস্তিত্ব যে প্রায় নষ্ট হতে বসেছে, এ কথা আজ কোনও বাঙালি অস্বীকার করবে না। বরং আজকাল মধ্যবিত্ত বাঙালির মুখে প্রায়শই শোনা যাচ্ছে, গর্বিত আশ্বাস বাণী “জানেন দাদা আমার ছেলে বা মেয়ের বাংলাটা ঠিক আসে না।” (ভবানীপ্রসাদ মজুমদার) মাতৃভাষা বাংলার চর্চা আজ যে তলানিতে এসে ঠেকেছে তা আমরা অনুভব করি ছাত্র পড়ানোর দৌলতে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৯: সুন্দরবনের পাখি—পানকৌড়ি

আজকের প্রজন্মকে ইঁদুর দৌড়ে সামিল করতে গিয়ে আমরা অভিভাবকরাই তাদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করে দিচ্ছি। নিজেদের মান বজায় রাখতে অভিভাবকদের দেওয়া বোঝা মাথায় নিয়ে ছেলেমেয়েরা অংক, ইংরেজি বা অন্য বিষয়ের উপর যত জোর দিচ্ছে, বাংলা বিষয়ের প্রতি তাদের ততটাই উদাসীন্য বাড়ছে।

ছাত্রদের পাশাপাশি স্কুলের একাংশও তাদের দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। ফলত কোথাও গিয়ে ছাত্রদের একটা অনিহা তৈরি হচ্ছে বাংলা ভাষার প্রতি। কেউ কেউ তো বাংলা ভাষায় কথা বলতেও লজ্জা পান। বাংলা ভাষার সঙ্গে এই প্রজন্মের প্রেমহীন সম্পর্ককে মুছে ফেলা আমাদেরই কর্তব্য নয় কি? শুধু ইংরেজি মাধ্যম নয়, বাংলা মাধ্যমের ছাত্রদের মধ্যেও বাংলা ভাষা নিয়ে চরম অবহেলা, দিন দিন বাংলা ভাষার শিকড়ে ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে। এ আমাদের চরম লজ্জা। নিজের সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। এই বোধ জাগ্রত না হলে বাংলা বিষয়ের প্রতি ছাত্রদের এই উদাসীনতা কোনওদিনই ঘুচবে না। অন্তরের দেবতা জাগ্রত না হলে বাইরে থেকে তকমা এঁটে বা স্বীকৃতি দিয়ে কোনও মৃতপ্রায় ভাষাকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন:

বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি: বাংলা বুকের ভিতরে

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে ভাষার সঙ্গে আত্মীয়তা গভীর থেকে গভীরতর হতে হয়। এর জন্য দরকার ভাষাকে চর্চা করা। সেই সঙ্গে পেশাগত প্রয়োজনের বাইরে এবং ভাষার যে একটা অস্তিত্ব আছে তাকে স্বীকার করে নিয়ে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির গভীরে গিয়ে সেই ভাষাকে লালন করা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার

চর্যাগীতি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন যে বাংলা ভাষাকে একসময় লালন করতে শিখিয়েছিল, সেই সংস্কৃতি সে ঐতিহ্যকে ধারণ করার অসম্ভব ধৈর্য আর স্থিতি যদি না আসে আজকের প্রজন্মের মধ্যে, তাহলে এত অপেক্ষার পর প্রাপ্ত ফসল হয়তো আমরা হারিয়ে ফেলব। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতির পাশাপাশি প্রতিটি মানুষকে বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। অ আ ক খ বর্ণ চেনানোর পাশাপাশি অভিভাবক এবং শিক্ষকদের সমান যত্নে শিশুকে তার মাতৃভাষা বাংলাকে লালনের প্রতিটি পাঠ দিতে হবে। ছোটবেলা থেকেই যে শিশু বাংলা গান, বাংলা সিনেমা, বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বড় হয়ে উঠবে, আর যাই হোক হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষার সঙ্গে সে অন্তত নিজের মাতৃভাষা বাংলাকে সমান গুরুত্ব দেবে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

তাই শুধু রাষ্ট্র এবং সমাজের ওপর দোষ না চাপিয়ে প্রত্যেক বাঙালি যদি তার নিজের কর্তব্যবোধ থেকে বাংলা ভাষার প্রতি যত্নশীল হয়ে উঠতে পারে। নিত্যযাপনের সঙ্গী করে নিতে পারে বাংলা ভাষাকে, পারিপার্শ্বিক মানুষের মধ্যে জ্বালিয়ে রাখতে পারে বাংলা ভাষা নামক মশালটিকে। তাহলেই সর্বত্র সেরার সেরা হয়ে উঠবে বাংলা ভাষা—এই বিশ্বাস রাখা একজন বাঙালি হিসেবে হয়তো ভুল হবে না। কবির সঙ্গে আমাদের কণ্ঠেও ধ্বনিত হোক—’মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা’।
* ড. কৃষ্ণা নন্দী ভৌমিক, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, হুগলি মহসিন কলেজ।

Skip to content