বৃহস্পতিবার ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


জাতকমালার যে কাহিনি আজকের প্রতিপাদ্য সেখানে বোধিসত্ত্বের প্রত্যক্ষ ভূমিকা দেখা যাবে না। কাল বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্তের শাসনকাল, স্থান হিমালয়ের গহন বন। বোধিসত্ত্ব সেবার নাকি ওই বনের কোনও এক বনস্পতিতে বৃক্ষদেবতা হয়ে জন্মান্তর লাভ করেছেন। তিনি এই কথার নীরব সাক্ষী, মুখ্য চরিত্রগুলির মধ্যে তাঁর অন্তর্ভাব নেই।

মুখ্য চরিত্রগুলিও মানুষ নয়, মনুষ্যেতর। সে যাই হোক, জাতকমালার প্রসিদ্ধ কাহিনিগুলির মতো এখানেও তত্ত্ব, কৌশল ও জীবনবোধের সমাপতন ঘটেছে। কাহিনি একরৈখিক, জটিলতাহীন কিন্তু গভীর।
হিমালয়ের ওই অরণ্যে এক শেয়াল তার প্রেয়সীকে নিয়ে বাস করতো। তার নাম পূতিমাংস, তার পত্নীর নাম বেণী। দু’জনে গুহায় থাকে, কাছেই আরেকটি পার্বত্যগুহায় অসংখ্য ছাগের বসবাস। শেয়াল আর তার বৌ মহাচাতুর্যে ছাগ হত্যা করে মহাসুখে তাদের মাংস খেয়ে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে। দেখতে দেখতে ছাগলের সংখ্যা কমে গেল। ছাগবংশের ক্ষয় হল, কিন্তু এক বুদ্ধিমতী ছাগী বেঁচে গেল বারংবার। উপায়কুশল শেয়ালও তার ক্ষতি করতে পারল না।

এরপর একদিন শেয়াল ভার্যার সঙ্গে মন্ত্রণা করল, যেমন তেমন করেই হোক ছাগীটিকে হত্যা করতে হবে। এরপর শেয়ালের পরামর্শে তার ভার্যা ছাগীর সঙ্গে সই পাতালো। তার বিশ্বাস অর্জনে সমর্থ হল। তারপর এল সেই দিন।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১৫: লৌহকুম্ভী জাতক

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭১: ধর্মকার্যের জন্য টাকা জোগাড় করা আর সাদা কাপড়ে ময়লা লাগিয়ে ধোয়া, দুই-ই সমান

শুধু গল্পসাহিত্যেই নয়, বৃহত্তর সাহিত্যের পরিসরেই এই বিশ্বাস অর্জনের ক্ষেত্রটি লক্ষ্য করা যায়। রাজনীতিশাস্ত্রে যদি অসমগোত্রীয় সখ্যে বিধিনিষেধ থাকে, আবেগে থাকে নিয়ন্ত্রণ, কার্য-কারণ বুঝে দেখার পরামর্শ থাকে, মানবীয় জীবননির্ভর সাহিত্যে সেই আবেগটাও অন্যতম মুখ্য। অপাত্রে বিশ্বাসস্থাপনের পর যে ঝড়টা ওঠে সেটাও থেমে গেলে উত্তরণ দেখা যায়। হয় বোকা তখন চালাক হয়ে ওঠে, কিংবা শঠ হয় সাধু। কিন্তু যেখানে রাজনীতির রসে জারিত হয়ে জীবনের পাঠ, যেখানে যথার্থপাত্রে সমর্পণ না হলে যোগক্ষেম সম্পন্ন হয় না, সেখানে এই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয়টি ভিন্নতর।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০২: অন্ধকারে কে?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১১: মৃণালিনীর মৃত্যুর পর বিবাহ-প্রস্তাবের মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ

ছাগী শেয়ালের বৌকে বিশ্বাস করেছিল। তারপর একদিন জানতে পারলো শেয়াল মরে গিয়েছে। মরে গেছে, মানে একদম মরেই গেছে আর কী! আরও জানলো, অনাথা শেয়াল-বৌয়ের এখন সে ছাড়া আর কেউ নেই গো! অতয়েব চলো, কেঁদেকেটে শেয়ালের সত্কার করতে হবে।

ছাগী জানালো, না ভাই! তোর স্বামীটি ভালো লোক নয় রে! আমার জ্ঞাতিস্বজন তার উদরেই প্রবিষ্ট হয়েছে। আমি যাবো না। কিন্তু বারংবার শৃগালীর উপরোধে সে ভাবলো, তবে সত্যিই মরেছে বোধহয়, তবুও পথে সাবধানে দৃষ্টিপাত করতে করতে চলল। দেখা গেল পথপ্রান্তে শেয়াল মরে পড়ে আছে।

বারবার একই বিজ্ঞাপনে রাতকেও দিন মনে হয়। মানুষমাত্রেই এমনটা হতে পারে। কিন্তু সচেতন মানুষ কেমন হবে? এই ছাগী তার দৃষ্টান্ত রেখেছিল।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৭: সুন্দরবনের পাখি — ফিঙে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৬: জীবন নিয়ে কৌতুক আর ‘যৌতুক’

শেয়ালের পরিকল্পনা ছিল, ছাগী কাছে এলেই তার কণ্ঠা কামড়ে ধরবে। কিন্তু আগ্রহের আতিশয্যে পায়ের শব্দ শুনেই পথে শুয়ে শুয়ে সে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ পিটপিট করে দেখছিল। সে দৃশ্য ছাগীর চোখ এড়ালো না, সে এদের অভিসন্ধি বুঝে দৌড় দিল।

এরপর শেয়াল ও তার বউ মূর্খতার জন্য একে অপরকে দোষ দিতে লাগলো। শেয়াল তার বৌকে ক্ষেপী বলে গাল দিল। বউ তাকে বোকারাম বলে ভর্তসনা করল। অকালদর্শিতার জন্য ধূর্ত অথচ মূর্খ শেয়াল নিতান্তই জব্দ হল। এরপর শেয়ালের সুযোগ্য সহধর্মিণী তাকে আশ্বস্ত করেছিল। তারপর আবার ভুলিয়ে ছাগীকে ধরে আনবে বলে উপস্থিত হল ছাগীর গৃহে। এবার আর ভুল করলে চলবে না।

ছাগী তাকে দেখেই বুঝলে ব্যাপারখানি। ভাবলো, এদের সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধ যুক্তিযুক্ত নয়। তাই অবলম্বন করতে হবে কৌশল। ততক্ষণে শৃগালী বেণী জানিয়েছে যে তার সখীর শুভাগমনে তার স্বামী প্রাণ ফিরে পেয়েছে। অতয়েব হে বন্ধু! হে প্রিয়! তোমার সঙ্গে মিষ্টালাপ করবে বলে স্বামী আমার মুখিয়ে আছে। চলো একটিবার।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০১: অর্জুন প্রমাণ করলেন, রাজধর্ম পালনের ক্ষেত্রে মিথ্যাচারের কোনও স্থান নেই

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৪: ‘…জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়’, লরেন্স ও ফ্রিডা/২

ছাগী বলল, তুই সুখী হ, যাবো রে সখী। আমার অনুচরদের নিয়ে এখনই পৌঁছবো তোর ওখানে, ওদের জন্য খাদ্য প্রস্তুত কর ভাই! খেতে না পেলে ওরা কিন্তু তোদের ছিঁড়ে খাবে। কি বলছিস? জানিস না কারা তারা? চারটি কুকুর। দুটি যমের অনুচর, মালিক আর চতুরক্ষ। দুজন কার্ত্তিকের সঙ্গী। নাম পিঙ্গিক আর জম্বুক। এদের প্রত্যেকের আবার পাঁচশো করে অনুচর আছে। এই দু’হাজারের মতো লোক নিয়ে তোর বাড়ি। এখনই যাচ্ছি। তোর যা সাধ্য, সেইমতো খাবার যোগাড় কর তাড়াতাড়ি ভাই!

এসব শুনে ভয়ে শৃগালীর অন্তর্লোক শুকিয়ে গেল। সে অনুনয় করে সখীকে ঘরেই থেকে যেতে অনুরোধ করলো। বলা তো যায় না, কোন্ দুষ্ট এসে তার ভাণ্ডার লুটে নিয়ে যাবে কখন! এরপর সে মরণভয়ে ছুটে পালালো, স্বামীকে নিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করলো নিমেষেই। এরপর কেউ আর তাদের সেই স্থানে দেখেনি।

এমন প্রতিবেশী থাকলে মস্তিষ্ক না হৃদয় কার জয়, কিংবা শেয়ালের মতো বুদ্ধি নাকি ছাগলের মতো বুদ্ধি কোনটা কার্যকরী হয় যথাকালে এই পাঠটুকুই এই গল্পের প্রাণবস্তু।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content