রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

তখন অগ্নিযুগ। এক মধ্যাহ্নের দহনক্লান্ত দ্বিপ্রহর। একটি লোক শহরের একটি অপ্রশস্ত গলিপথে সতর্কগতিতে চলছিল। তার কাঁধে পশরার ঝুলি, হাতেও একটি ঝুড়িতে সাজানো বই। রাজপথের মুখে পথ আটকে খোঁজ চলছে কিছুর। খাকি পোষাক লাল পাগড়ি সেপাই এসে তল্লাশি নিল। ছোটদের ছড়ার বই, সস্তা কাগজে ছাপানো আরব্যরজনী, পঞ্চতন্ত্রের অনুবাদ কিংবা রাজা হরিশ্চন্দ্র, ভক্ত প্রহ্লাদের গল্প। লোকটাকে একবার দেখে নিল সেপাই সাহেব। রোগা একহারা গড়ন, ময়লা পোষাক, মাথায় রুক্ষ কেশ, চোখে একটা ভারি কাচের চশমা, এতটাই পুরু যে, চোখ দেখা যায় না প্রায়।
শহরে বিপ্লব চলছে, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বোমা, গুলি। এর কাছে শুকনো কটা কাগজের স্তূপ। অবহেলাভরে লোকটাকে পথ দেখিয়ে দিল সেপাইজি। লোকটা পাশের গলিতে বাতাসের সঙ্গে যেন মিশে গেল। চশমার আড়ালের ধারালো চোখদুটোয় তখন মুক্তির ডানা, শুকনো কাগজের স্তূপের নিচে অগ্নিগর্ভ সময়ের অগ্নিপরীক্ষার শাণিত তূণ। একটি লোডেড রিভলভার আর, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। পাতলা হলুদ দু’মলাটের বই, ওপরে ঝাপসা হয়ে আসা কালো রেখায় এক বিরাট পুরুষের পদপ্রান্তে শরণার্থী যুগন্ধর যোদ্ধা, যেমন করে ভারতভূমি আনত হয়েছে মহামানবের মহাসমরের সাগরতীর কুরুক্ষেত্রে।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৩: দুই মহর্ষির দ্বন্দ্বে কি ‘ইতি ও নেতি’র বিরোধেরই প্রতিফলন?

সেই যুগপুরুষ তখন বলছিলেন, যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি… হে ভারত, যখন অধর্মের উত্থান, তখনই আমি আসি। যা কিছু শাশ্বত সত্যবোধের বিরোধী তা-ই অধর্ম। তবুও ব্যাঘ্র বা সিংহ যখন নরহত্যা করে তখন সেই ধর্মবোধের আদর্শ অটুট থাকে তো? ব্যাঘ্র তো তার জীবধর্মের বশবর্তী হয়েই হত্যা করে, তবুও মানুষ তাতে কি আহ্লাদিত হয়? এই যে আসন্ন মহাসংগ্রাম, এ তো হত্যালীলাই। তবুও সম্মুখসমরে ধর্মপথে যুদ্ধ করে হত বীরের স্বর্গপ্রাপ্তি তো শ্লাঘনীয় বলেই কথিত। এই যে যজ্ঞশালায় পশুবধ, তা অন্যায় মনে করো? যদি করো, যদি না করো তবে ধর্ম কী, অধর্ম কী, কোনটা তোমার কাছে ধর্ম, কোনটা অন্যের কাছে অধর্ম তার বোধ তোমার কাছে আচ্ছন্নপ্রায়, এই অজ্ঞান-ই তোমার ঋজুতাকে খর্ব করেছে, দৃঢ়তাকে নমনীয় করে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করেছে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৬: নান্দনিক শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন শ্রীমা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫০: পুত্রস্নেহে অন্ধ হলে পিতাকেও ধৃতরাষ্ট্রের মতো দুর্দশা ভোগ করতে হয়

তবে এই সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হতে তোমার কীসের দ্বিধা? তুমি ভাবছো তুমি সামনে যা দেখছো এই বুঝি সত্য, এই চিরন্তন? নভোলোকের ওই সূর্য সত্য নাকি, জলাশয়ে দেদীপ্যমান তার প্রতিচ্ছায়া? সত্য তো এক, অখণ্ড, অনিবার্য ও কালাতীত? তবে নভোলোকে যা সত্য, ওই তড়াগেও তা সত্য তো? তুমি যদি বলো তড়াগের ওই জ্বলন্ত প্রতিবিম্ব মিথ্যা, তা-ও কি গ্রাহ্য? যা প্রত্যক্ষদৃশ্য, তাতো অনুমেয় নয়, চর্মচক্ষু তাকে অভ্রান্ত বলেই অনুধাবন করছে। তবে কি ওই প্রতিমিম্ব-ও মূলের তুল্য অভ্রান্ত? এখন যদি বলো, সত্য, তা-ও কি গ্রাহ্য হবে? যদি তড়াগের ওই সূর্যবিম্ব সত্য হয়, তবে সমকালেই নভোলোকে জ্যোতির্ময় ওই সত্তা কি? সে-ই তো প্রকৃত আদিত্য, তা-ই নয় কি? তবে কী সিদ্ধান্ত হল, ওই বিম্ব সত্য নাকি মিথ্যা?
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৫: বার্নার্ড শ ও শার্লটি—যদি প্রেম দিলে না প্রাণে/১

এই যে তুমি রাজ্যভাগ থেকে বঞ্চিত হয়ে ত্রয়োদশ বর্ষ ক্লেশ সহ্য করেছো, অধিকারবোধ তোমাকে তাড়িত করেছে দিবারাত্র, আর, পরীক্ষায় উপনীত হয়ে তোমার চেতনা শিথিল হচ্ছে, এই দুয়ের মধ্যে সত্য কি? কোনটি? তোমার অধিকারের দাবি নাকি স্বজননাশের অবশ্যম্ভাবী ভবিতব্য?

ওই সূর্যবিম্ব যদি সত্য হয়, তবে তোমার চারপাশে ঘনীভূত এই হতাশাও সত্য, যদি না হয়, তবে হতাশা কীসের?
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৮: কালীর হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে মহানায়ক বলেছিলেন, ‘কাউকে বলো না’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

প্রকৃত সত্য হল ওই গগনের সূর্যমণ্ডল, জলে তার প্রতিবিম্ব মিথ্যা, কিন্তু অজ্ঞানের ভার তাকে সত্য বলে মনে করায়। এই হল মোহ, সেই মোহ তোমাকে আচ্ছন্ন করেছে। তোমার ঐ অধিকার সত্য নয়, তোমার ওই হতাশাও সত্য নয়, যাদের অবশ্যম্ভাবী বিনাশ তোমাকে হীনবল করছে তারাও সত্য নয়, সত্য একমাত্র কর্ম, এই কর্ম-ই তোমাকে ধারণ করে আছে। সোনার তরীতে একমাত্র শুদ্ধ কর্ম-ই স্থান পাবে। এই বোধ যে অর্জন করেছে, শোক-দুঃখ-মোহভার তাকে গ্রাস করতে পারে না। ওই কর্ম-ই পরম সত্যে, পরম জ্ঞানের অনন্তে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সোনার তরীকে। —চলবে।
* গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে (A Special Write Up on Shrimad Bhagwat Gita): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content