শুক্রবার ৮ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

বোধিসত্ত্ব সেবার এক বণিক হয়ে জন্মেছেন। এমনিতেই বলা হয় বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী, আর বাণিজ্যের নিয়মনীতি, কৌশল নানারকম, তার মধ্যে একটা হল প্রতারণা। বণিকমাত্রেই এমন করবেন সেটা না হলেও, জটিল কৌশল আর মানুষের মন বুঝে তাকে নিজের জিনিসটা গছানোর একটা চেষ্টা কিংবা দায় থাকে। মহানগর চলচ্চিত্রে নায়িকা সেলসের চাকরি পেয়ে এই বাণিজ্যনীতির মুখোমুখি হয়েছিল।
সে যাই হোক, বোধিসত্ত্ব সেবার ফেরিওয়ালা, আমার এই ছোট্ট ঝুড়ি, এতে রাম রাবণ আছে ইত্যাদি বলে বোধহয় ফেরি করতেন পণ্যসম্ভার। তাঁর এক সহযোগী বণিককে নিয়ে সেবার তিনি এক নগরে এলেন পণ্য বিক্রি করতে। সমঝোতা হয়ে গেল কে কোন রাস্তায় যাবে। এরপর “পুতুল নেবে গো” বলে পথে পথে হাঁক পেড়ে ঘুরতে লাগলেন। তাঁদের ঝুড়িতে কী কী ছিল তা জানা যায় না, ছিল হয়তো নানারকম মণিহারি পশরা, প্রাজ্ঞ মানুষ বলেন এই জগত্টাই ক্রীড়নক, খেলার পুতুলমাত্র, মানুষের বাঁধা খেলাঘরে নিয়ত ভাঙা গড়ার লীলা চলছে। এ ভাবেই তো এক রাত্রে জরাব্যাধিমৃত্যুবিপন্ন ক্ষুদ্র সংসার থেকে বৃহতের পানে অভিনিষ্ক্রমণ ঘটবে। কিন্তু তার তখনও অনেক অনেক বিলম্ব। বোধিসত্ত্ব তখন মনের আলো জ্বেলে “এ সুযোগ পাবে না আর, বলো ভাই কী দাম দেবে”এইসব বলেই হয়তো নগরের রাস্তায় পণ্যজীবী।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৭: জননী সারদা সন্তানের দুঃখভার লাঘব করেন

শারদীয়ার গল্প: তখন বিকেল/৪

তাঁর সেই সহযোগী ছিল অর্থলিপ্সু ও প্রতারণাকুশল। সে পথে যেতে যেতে এমন এক গৃহের কাছে এল যে বাড়িটি এককালে নগরশ্রেষ্ঠ ধনীর ছিল, কিন্তু কালের করাল গ্রাসে, অদৃষ্টের পরিহাসে সেই গৃহ তখন শ্রীহীন, মৃত্যুপুরী। পুরুষ সদস্যরা সকলেই মৃত, জীবিত কেবল এক বৃদ্ধা ও এক বালিকা। জীবনের দুই ধারে দুটি বিন্দু যেন। তারা নির্ধন, হতদরিদ্র। বিলাসসামগ্রী কেনার ক্ষমতা তাদের নেই। এই সময়ে রাস্তায় হেঁকে উঠল এক ফেরিওয়ালা। বালিকা বায়না করল, গয়না কিনবে, কি করে কিনবে? টাকা কোথায়? কেন, ওই যে অবহেলায় অযত্নে পড়ে থাকা থালাটা, মধুমাঝির নৌকার মতো পড়ে আছে এক কোণে!
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৪: অরাজকতার ফল ও একটি দুঃস্বপ্ন

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

বালিকার হয়তো জানার কথা নয়, বৃদ্ধার-ও হয়তো বিস্মৃতির অতলে চলে গিয়েছে সে কথা, এই থালাতেই বাড়ির প্রধান পুরুষ অন্নগ্রহণ করতেন এককালে, নিয়মিত। বালিকা ভাবল কেবল, এটা তো কারও কোনও কাজে লাগছে নাতো, ওটা দিয়ে দিলেই তো….

তাই-ই হোক। তাই-ই হল। কিন্তু সেই ধূর্ত চতুর ফেরিওয়ালা থালাটা দেখে ভ্রূ কুঁচকে দেখল খানিক। তারপর সূঁচ দিয়ে ঘষে দেখল, যা ভেবেছে তা-ই। এ যে সোনা!! অর্থলিপ্সু সেই বণিক তখন ফন্দি এঁটে বলল, ধুর! এর কোনও নয়া পয়সাও দাম নেই, এর বিনিময়ে কিছু মিলবে না। ঠং করে উঠোনে আছড়ে রেখে চলে গেল সে।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭০: সুন্দরবনের পাখি: লাল কাঁক

এরপর পথের বাঁকে আরেক বণিকের দেখা মিলল। বালিকা তার হাঁক শুনে আবারও বায়না করল। কিন্তু ঐ থালাটি তো মূল্যহীন, বৃদ্ধা তাকে বুঝিয়ে বললেন। বালিকা যুক্তি দিল, এই বণিক সৌম্যসুন্দর, আগের জনের মতো কুটিল নয়, তাছাড়া এর আহ্বানে যে মাধুর্য আছে, তাকে উপেক্ষা করে সাধ্য কার। অতঃপর একইভাবে ঘটল আগের মতো। বিক্রেতা থালাটা দেখেই বলল, সেটি কেনার মতো অর্থ তার কাছে নেই, এর দাম লক্ষমুদ্রা বটে! ক্রেতারা অবাক হয়ে নির্বাক হয়ে গেল। তারপর কোনওক্রমে বলল, আপনার স্পর্শে এই থালা মহামূল্যবান হয়েছে, আপনি একে গ্রহণ করুন। আপনার যা সামর্থ্য তাই দিয়ে কিনে নিন এটি। সেই পণ্যজীবী তখন তার পাঁচশ কাহনের দ্রব্য এবং সমপরিমাণ অর্থ তাদের দিয়ে কেবলমাত্র আটকাহন সঙ্গে রেখে সেই পাত্র নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন। দ্রুত নদীর ঘাটে এসে মাঝিকে আট কাহন দিয়ে অবিলম্বে নদী পার করতে বললেন।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩২: কল্যাণ মাণিক্যের সনদে বাংলা গদ্য

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

সিনেমার শেষে ভিলেন আসে না? সেই চতুর বণিক আবার ফিরে এসে বলল, “ভেবে দেখলাম একেবারে কিছু না দেওয়াটা খারাপ দেখায়, কই গো, বের করোতো তোমাদের থালাটা” আর শুনল যা ঘটে গেছে সব। শুনে তার মাথা গেল ঘুরে। অন্য এক বণিক নাকি সহস্রমুদ্রার দামে সে থালা কিনে নিয়ে গেছে। সেই ধূর্ত বণিক তখন নিষ্ফল ক্রোধে পাগল হয়ে গেল, তার সব পণ্য ছড়িয়ে ছুড়ে ফেলে কেঁদে কেটে শাপশাপান্ত সে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিল। তারপর ছুটল নদীর দিকে। নৌকা তখন মাঝনদীতে। তাকে উপেক্ষা করেই নৌকা হারিয়ে গেল যেন অনন্তে। সেই দুষ্টবুদ্ধি বণিক নিদাঘে শতধাবিদীর্ণ ঊষর মৃত্তিকার মতোই বুক ফেটে প্রাণ হারালো।

দুর্বুদ্ধি মহাকালকে অতিক্রম করতে পারে না। আপাতঃ রমণীয়, যাকে প্রেয়ঃ বলে তা আত্যন্তিক কল্যাণবিধান করে না, দুষ্ট বণিক তার লোভ ও আত্মকেন্দ্রিক চাতুর্যের ফলকে নিবারণ করতে পেরেছে কি? আত্মগ্লানি, অপরাধবোধ নাকি নিষ্ফল হতাশা তার জীবনের অবসান ঘটাল তা কে বলতে পারে! কিন্তু একই পরিস্থিতিতে শুদ্ধচিত্ত অন্য বণিক যে সংযম ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেখিয়েছে, তা-ই শিক্ষণীয় হওয়া উচিত, সাধারণ মানুষের মধ্যেই এই ঐশ্বরিক বোধ জেগে ওঠে, জাতকমালার এই কাহিনী সেকথাই বলে যায়।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content