রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

আজকাল শিরদাঁড়া নিয়ে খুব আলোচনা চলছে। মাইতিবাবু নিশ্চিত তাঁর শিরদাঁড়া আর সোজা নেই। বাড়ি করা ছেলেমেয়ে মানুষ করা তাদের বিয়ে-থা এ সব সামলে সোজা শিরদাঁড়া বেঁকে গিয়েছে। এখন শোবার সময় পিঠের চালাটা একটু টিপে দেবার জন্য বৌকে সাধ্যসাধনা করতে হয়। তাই বোধহয় আজকাল সামান্য একটু ঝুঁকেও চলতে হয়। আর একটা আলোচ্য শব্দবন্ধ হলো থ্রেট। সবল চিরকাল দূর্বলকে ভয় দেখিয়ে এসেছে। এও নতুন কিছু নয়। দূর্বাসা মুনিকে রাজা থেকে প্রজা সক্কলে ভয় পেত। কখন চটেমটে পৈতে ছুঁয়ে ফস করে অভিশাপ দিয়ে দেবেন। সকলে তটস্থ। একসময় ডাকাতির খুব ভয় ছিল, গৃহস্থ ভয়ে কাঁটা। ধনীলোকের মাইনেকরা পাহারাদার আছে। গৃহস্থের মানসম্মান আর সামান্য সঞ্চয় ছাড়া আর তো কিছুই নেই।
সেই ভয়ের সামাজিক উত্তরাধিকার নিয়ে মাইতিবাবু নির্বিরোধী ভীতু বাঙালি। রিটায়ার করেছেন স্বামী-স্ত্রী নিয়ে এখন দুটি প্রাণীর সংসার। ভারত সরকারের ডাক ও তার বিভাগের কর্মী ছিলেন বছর দুই অবসর নিয়েছেন। ছেড়ে আসার আগে অন্ধকার ধুলোবোঝাই পোস্টঅফিসগুলোর ঝাঁ চকচকে চেহারা হয়ে গেল। চিরকালীন চেনা পোস্টঅফিস নতুন লোগোতে যেন অচেনা। ওপরে নিচে ভারতীয় ডাক ও ইন্ডিয়ান পোস্ট লেখা মাঝে গাঢ় মেরুন রঙের চৌখুপি। ঢেউ খেলানো হলুদ রঙের তিন লাইন এপার থেকে ওপারে ভেসে গিয়েছে গতির চিহ্ন। কম্পিউটার বসেছে স্পিডপোস্ট এখন ক্যুরিয়ার সার্ভিসের ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এখন আর এসবে কী লাভ! হ্যাঁ, লাভ একটাই আগেকার দিনকালে পেনশনের টাকা ঠিকমতো পাওয়া যেত না। এখন সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত। পোস্ট অফিসেই ব্যাংক খুলে ফেলেছে। অনেকদিন ধরে অনেক কষ্ট করে হরিদেবপুরের বনমালী ব্যানার্জি লেনে সামনে চিলতে ছাদসমেত এই দোতলা বাড়িটা বানিয়েছেন বিমলেন্দু মাইতি।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৬: সুযোগ্য প্রশাসকের মৃত্যুর অভিঘাত

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৩: ভাবিয়া করিও কাজ

প্রথমে ছিল একতলায় দুটিঘর রান্নাঘর কলঘর, তারপর দোতলার সিঁড়ি ছাদ, তারও পরে দোতলায় দুটি ঘর লাগোয়া কলঘর। একেবারেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি সংগ্রামের সাফল্যের ইতিহাস। দুটি সন্তান। বড়টি মেয়ে। সে বিয়ের পর থেকে বম্বের থানেতে থাকে। পুজোর সময় বড়মেয়ে জামাই-নাতিকে নিয়ে কলকাতায় আসে। ছেলেবৌমা চাকরিসূত্রে এখন ব্যাঙ্গালোরে। গতবছর পুজোতে তারাও এসেছিল। একতলা দোতলা মিলে গোটা বাড়িটা যেন খুশিতে গমগম করছিল। এ বছর আসতে পারেনি। তাদের মাত্র দু’বছর বিয়ে হয়েছে। দু’জনেই এখন ক্যারিয়ার গড়তে ব্যস্ত তাই এক্ষুনি মা-বাবা হবার ইচ্ছে নেই বলেই মনে হয়। পুজোর আগে ছেলে এক চাকরি ছেড়ে বেশি মাইনেতে অন্য চাকরি নিয়েছে। সুতরাং এত কম সময়ে লম্বা ছুটি পাওয়াটা নিশ্চয়ই অসুবিধের।

মাইতিবাবুর ছেলেমেয়ে স্কুলকলেজে ভালই রেজাল্ট করতো, দুজনেরই ভালো বিয়ে হয়েছে। মেয়ে যখন কলেজে পড়তো তখন কখনওসখনও শহরতলীর বন্ধুরা পুজোর সময় দু-একজন এক-দুদিন এসে একসঙ্গে কলকাতায় ঠাকুর দেখতে বেরতো। সেবার ছাদের একটা ঘর হয়েছে। জানলার দরজা বসেছে কিন্তু ভেতরের প্লাস্টার, ফ্যানলাইট এসব লাগেনি। রাতে মাইতিবাবু ছেলেকে নিয়ে ওপরের ঘরে গেলেন শুতে নিচের থেকে তার টেনে উপরে গিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে টেবিলফ্যান চালানো হলো। কী লড়াই করে দিনগুলো কেটেছে! এখন অবাক লাগে!
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬২: মঠ-মন্দির তৈরি করার চিন্তা বেশি করলে প্রকৃত ধর্মচর্চা থেকে মানুষ দূরে চলে যায়

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৯: শ্রীমার সন্তানস্নেহ

মেয়েজামাই থানে ছেড়ে দিওয়ালীতে আসে না, কালীপূজোর সময় বাড়িটা একদম খালি। ভাইবোন ভিডিওকলে ভাইফোঁটা সারে। ছেলেমেয়ে দুজনেই শিক্ষিত, তারা দুজনেই স্বাভাবিক সুখীবিবাহিত জীবনযাপন করছে। স্বামীস্ত্রী মিলে মোটামুটি সুস্থভাবে অবসর জীবনযাপন করছেন মাইতিবাবু। শিক্ষা শান্তি আর সুস্থতা। এছাড়া শিক্ষিত মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী আর কী-ই বা চাইতে পারেন।তাই প্রতিদিন করুণাময়ী বাজার যাওয়া-আসার সময় করুণাময়ী কালীমন্দিরের বাইরে থেকেই জাগ্রত মাকে তাঁর কৃতজ্ঞতা জানান।

প্রতিদিন যে বাজার যাবার দরকার পড়ে তেমন নয়, কাছাকাছি দু-এক জায়গায় শাকসবজি মিলেও যায়। কিন্তু মাইতিবাবু শরীর ঠিক রাখতেই রোজ থলিহাতে হাঁটাপথে এতটা রাস্তা যাওয়াআসা করেন। কখনো কখনো হাঁটতে ভালো না লাগলে অটোতে উঠে পড়েন। এই মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে প্রতিমুহূর্তে শয়ে শয়ে অটো করুণাময়ী ব্রিজ টপকে টালিগঞ্জ মেট্রোর সামনে মহানায়ক দর্শন করে আসছে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭১: সুন্দরবনের পাখি: সবুজ বক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

দুর্গাপুজোর সময় তো এই রাস্তায় চলাফেরা করা দুঃসাধ্য। সামনেই অজেয় সংহতি ক্লাবের বিশাল দুর্গাপুজো। ছোটবেলা থেকে এই পরিবেশে বড় হয়েছে ছেলেমেয়ে। তারা দু’জনেই কলকাতার দুর্গাপুজো ভীষণভাবে মিস করে।

জামাইয়ের থানেতে পৈতৃক ব্যবসা। ভাইয়েরা রয়েছে। সে নিয়ম করে পুজোর সময়ে সপরিবারের কলকাতায় চলে আসে। কিন্তু এবার পুজোতে না আসতে পেরে ছেলেবৌমার খুব মন খারাপ। ছেলে প্রায়ই বলে দুজনের কাজের সুযোগ থাকলে মাইনে একটু কম হলেও তারা কলকাতায় চলে আসতো। বাড়িভাড়া দিতে হতো না। কলকাতায় অনেক কমপয়সায় জীবনযাপন করা যায়। গাড়িভাড়া বেশ কম। কিন্তু মাইতি বাবু বলেন—খবরদার ও সমস্ত কল্পনার মধ্যে স্থান দিও না! বাইরে থেকে চাঁদের জ্যোৎস্নাটুকু দেখছো তাই
আফসোস করছ! কাছে এলে বড় বড় অন্ধকার খানাখন্দগুলো দেখতে পাবে, বুঝতে পারবে, তখন পালাবার পথ পাবে না ।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

সামনের চিলতে ছাদে অনেক গাছপালা করেছেন সেখানে গাঁদা গোলাপ চন্দ্রমল্লিকা বেলফুল জুঁই নয়নতারা ফোটে সঙ্গে লঙ্কা টমেটোও ফলে। নিচের গ্রিল বারান্দায় রয়েছে নানান বাহারি সবুজ পাতার ইনডোর প্লান্ট। যাদের চড়া রোদ সহ্য হয় না, তেমন সুখী গাছেরা বারান্দার ছায়ায় বড় হয়। গাছে জল দেওয়ার এক অদ্ভুত ব্যবস্থা করেছেন মাইতিবাবু। দোতলার ছাদে এবং একতলার গ্রিল বারান্দায় জলের পাইপ আছে। সেই পাইপ জোড়া একটি পাত্রে। ট্যাংক বোঝাই হয়ে গেলে প্রথমে জল পাইপ দিয়ে সেই পাত্র পড়ে। সেই পাত্র থেকে উপচে পড়া জল ছাদে এবং একতলার গ্রিলবারান্দায় টবে টবে চালান হয়ে যায়। সে পাত্রও ভরে উঠলে আর গায়ের সরু পাইপ বেয়ে জল রান্নাঘরের নর্দমায় পড়ে রান্নাঘরেই পাম্পের সুইচ। জলের সুচারু ব্যবহার। ছেলে নাম দিয়েছে ট্যাংক ওয়াটার হারভেস্টিং! সকালে গিন্নি বিকেলে কত্তা পাম্প চালানোর ডিউটি রোস্টার। বন্ধ করতে ভুলে গিয়ে আগের দাম্পত্যকলহ এখন আর নেই। দেরি হলেও টবের ছ্যাঁদার মতো সামান্য তিরতির করে জল পড়ে। তবে এই পাম্পের জলই কিভবে জ্বলন্ত বিপ্লব ঘটাল সে এক আশ্চর্য আখ্যান।— (পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content