শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


সুমিতার ফোনটা কেটে ধপ করে ফোনটাকে খাটে ছুড়ে ফেলল প্রিয়া। নিজের মনেই গজগজ করতে লাগল, “পিসিমণিটা যেন কী! এতবার করে বলে দিলাম দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করেই বেরিয়ে পড়বে, এখনও বেরোয়নি! আবার হাসতে হাসতে বলছে—এই দেখ না, এখুনি এসে পড়ছি। কী জানি কখন আসবে! পিসিমণি আসার আগেই না মায়েরা এসে পড়ে!”

‘মা’—জগতে এর চেয়ে মধুর ডাক আর একটাও নেই। তেইশ বছর প্রিয়া কষ্ট পেয়েছে। কাউকে মা বলে ডাকবার জন্য ভেতর ভেতর ছটফট করেছে। মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে চুপি চুপি ‘মা’ বলে ডেকে কেঁদেছে কত! আজ সে একজন মা পেয়েছে। মায়ের মতো মা, সত্যিকারের মা। শুধু ‘মা’ বলে ডাকবে বলেই এক একদিন দু’-তিনবার করে ফোন করে প্রিয়া। মা ওপাশ থেকে বলে ওঠে, “হ্যাঁ বল”। প্রিয়া শুধু ডাকে ‘মা’…। আর কিছু বলতে পারে না। মা বলে, “চুপ করে আছিস কেন? কী বলবি বল!” ধরা গলায় প্রিয়া বলে, “কিছু বলব না মা। কিছু তো বলার নেই! শুধু তোমাকে একবার ডাকব বলে, তোমার গলাটা একবার শুনব বলে ফোন করেছি।” মা বলে, “পাগলি মেয়ে আমার!” প্রিয়া চুপ করে থাকে। দু’গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

কী আশ্চর্য! মা ঠিক বুঝতে পারে। বলে, “কাঁদছিস কেন মা? আর তো ক’টা দিন পরেই আমার কাছে চলে আসবি। তখন যত ইচ্ছে ডাকিস। আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেব। সোনা মা আমার, কাঁদে না।” এক এক সময় প্রিয়া জিজ্ঞেস করে, “আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেবে মা? আমার অনেক বন্ধুদের মায়েরা এখনও ওদের খাইয়ে দেয়। আমার খুব লোভ হয়।” বলতে বলতে প্রিয়ার গলা ধরে আসে। ও প্রান্ত থেকে মা বলে, “হ্যাঁ, দেবো তো। বাবুকে তো এখনও খাইয়ে দিই, তোকেও দেবো। দু’জনকে একসঙ্গে খাইয়ে দেবো।” হেসে ওঠে কবিতা। এ দিক থেকে প্রিয়াও হাসে।

সেই ‘মা’ আজ আসছে ওদের বাড়ি। কী আনন্দ! কিন্তু শুধু নিজেদের আনন্দের কথাটা ভাবলে চলবে না। যে পরিকল্পনাটা করেছে, সেটাকে সত্যি করতেই হবে। সিদ্ধার্থও তাই চায়। পিসিমণি-পিসেমশাই সবাই তাই চায়। এখন আসল মানুষ দু’জন কী বলে সেটাই চিন্তার বিষয়।
ভাগ্যিস প্রিয়া সেদিন বাবার বইয়ের তাকটা গুছোতে গিয়েছিল। এমনিতে বাবার বইয়ের তাক বাবা নিজেই গুছোয়। প্রিয়া বা সুমিতাকে কখনোই বইয়ের সেলফে হাত দিতে দিত না বাবা। বাবার বক্তব্য, কোথায় কোন বইটা আছে সব তার জানা। ওরা হাত দিলেই নাকি সব উল্টোপাল্টা করে দেবে। সেবার বাবার অফিসে খুব কাজের চাপ ছিল। ফিরতে দেরি হত বাবার। ফিরে একটু কিছু খেয়েই আবার অফিসের কাজ নিয়ে বসে পড়ত। সেই সময়ে একদিন প্রিয়া খুব ধুলো জমে ছিল বলে বাবার বইয়ের তাক পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা পুরনো ডায়েরির মধ্যে ছবিটা পেয়েছিল। কী সুন্দর একজন ভদ্রমহিলা! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল প্রিয়া। ডায়েরির পাতাটায় লেখা ছিল দুটো লাইন—” ভুল বুঝো না, আমার প্রেমে নেই তো কোনো ফাঁকি / আজও তোমার স্মৃতিটুকুই আঁকড়ে বেঁচে থাকি।” ছবিটা রেখে দিয়েছিল যথাস্থানে। পরদিন দুপুরে পিসিমণি এলে দেখিয়েছিল। পিসিমণি অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। একবার ছবিটা দেখছিল, আর একবার প্রিয়াকে। দুটো চোখ জলে ভরে গিয়েছিল পিসিমণির। প্রিয়া জানতে চেয়েছিল, “বলো না পিসিমণি, কার ছবি এটা? কী সুন্দর দেখতে! কে এই ভদ্রমহিলা?” পিসিমণি আস্তে করে বলেছিল, “কবিতাদি।”
আরও পড়ুন:

শারদীয়ার গল্প: তখন বিকেল/৩

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৯: সুন্দরবনের পাখি—পানকৌড়ি

“কবিতাদি! উনি কে?” অবাক হয়ে জানতে চেয়েছে প্রিয়া। পিসিমণি প্রথমটা ইতস্তত করছিল। তারপর বলেছিল, “প্রিয়া, তুই এখন বড়ো হয়েছিস। এখন আর তোকে বলতে দ্বিধা নেই রে।”
“হ্যাঁ পিসিমণি, বল। আমারও ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে।” আগ্রহে ফেটে পড়ে প্রিয়া।
সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে পিসিমণি বলতে শুরু করে, “কবিতাদি আর দাদা দু’জন দু’জনাকে খুব ভালোবাসত। পরস্পরের প্রতি এত ভালোবাসা, এত শ্রদ্ধা আমি আর কোথাও দেখিনি প্রিয়া। আমাদের বাবা তো অনেকদিন আগেই মারা গিয়েছিলেন। আমার তো ভালো মনেই পড়ে না। দাদার তখন বছর আঠারো বয়স। সেই থেকে দাদার উপর সংসারের ভার। কী কষ্টই যে দাদা করেছে! দাদার গানের গলা ভালো বলে ছোটবেলা থেকেই বাবা দাদাকে গান শিখিয়েছিলেন। সেই গানই আমাদেরকে বাঁচিয়েছিল। চাকরি পাবার আগে গানের টিউশনি করত দাদা। দু- একজনকে পড়াতও। আবার রাত জেগে নিজের পড়া। সেই গান শেখাতে গিয়েই কবিতা দি’র সঙ্গে পরিচয়। কবিতা দিও দু-একজনকে পড়াত। সেই টিউশনির টাকায় আমার জন্য, মায়ের জন্য মাঝেমাঝেই এটা-ওটা কিনে আনত। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাদার জীবন-সংগ্রামের সঙ্গী হতে চেয়েছিল। তখন আমিও তো ছোট ছিলাম। অত বুঝতাম না। পরে বুঝেছি। তবে কবিতাদি এলেই বাড়িতে একটা খুশির হাওয়া বয়ে যেত। যতক্ষণ থাকত আমি গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকতাম।”
আরও পড়ুন:

বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি: বাংলা বুকের ভিতরে

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

“তাহলে উনি আর বাবা আলাদা হয়ে গেলেন কী করে?” উদগ্রীব হয়ে জানতে চেয়েছিল প্রিয়া।
পিসিমণি আবার বলতে থাকে,”দাদা তখনও চাকরি পায়নি। টিউশনিই সম্বল। আর কবিতাদির বাড়ি থেকেও বিয়ের জন্য খুব চাপ আসছিল। তখন তো বাবা-মা’র অমতে বিয়ে করার সাহস কারও ছিল না। আর দাদাও চায়নি কবিতাদি বাড়ির অমতে দাদাকে বিয়ে করুক।”
“তা বলে এভাবে একটা সম্পর্ক ভেঙে যাবে!” অসহিষ্ণু গলায় প্রিয়া বলে।
“এমন করে কত সম্পর্কই তো ভেঙে যায় রে প্রিয়া।” পিসিমণির গলায় গভীর হতাশা। “কবিতাদির বাবা একটা সামান্য প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতেন। রিটায়ারমেন্টের সময় হয়ে আসছিল। তাই তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছিলেন। ভালো চাকরি করা ছেলে পেলেন। সেই কারণেই আর দেরি করেননি।”
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার

প্রিয়া অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করেছিল,”আর আমার মা?”
“তোর মাও ভালো ছিল। তাকে আমি কিছুতেই খারাপ বলতে পারি না। তবে দাদা কিছুতেই বিয়ে করতে চায়নি। নেহাৎ মায়ের পীড়াপীড়িতেই বাধ্য হয়ে…” শেষ করে না পিসিমণি কথাটা।
প্রিয়ার খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন। বাবার জন্য, ওই ভদ্রমহিলার জন্য, মায়ের জন্যও। শুধু চাকরি না পাওয়ার জন্য একটা সম্পর্ক এভাবে ভেঙে গেল! সিদ্ধার্থও তাদের পরিচয়ের অনেক দিন পরে চাকরি পেয়েছে। বহুদিন টিউশনিই ওরও সম্বল ছিল। কিন্তু বাবা তো কখনও ওকে অপছন্দ করেনি! আসলে নিজের জীবনে যা ঘটেছে, বাবা চায়নি ওদের জীবনেও সেটা ঘটুক। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণাটা যে বাবা বোঝে!
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

আজ আবার মনে পড়ে গেল প্রিয়ার সেসব কথা। বাবার ডায়রির ভিতরে ছবিটা পেয়েছিল বলেই না সিদ্ধার্থদের বাড়ি গিয়ে ওর মায়ের পুরনো ছবিটা দেখে চমকে উঠেছিল। সব পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল ওর চোখে। পরের দিন সিদ্ধার্থকে সব বলেছে। সিদ্ধার্থও আবাক হয়েছে। ওরা দু’জনেই চায় এই হারিয়ে যাওয়া মানুষ দু’জন আবার কাছে আসুক। সব শুনে সিদ্ধার্থ বলেছিল,”আমার মা বাবার কাছ থেকে কিচ্ছু পায়নি প্রিয়া, শুধু অপমান আর লাঞ্ছনা ছাড়া। মায়ের সব কাজের প্রেরণা একজন মানুষই— তোমার বাবা। ওনার ভালোবাসার স্মৃতিটুকু সম্বল করেই মা আজও বেঁচে আছে। আমিও চাই প্রিয়া ওঁদেরকে আবার মিলিয়ে দিতে। ওঁদের দু’জনেরই জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় পার হয়ে গিয়েছে। বাকি জীবনটা অন্তত একটু শান্তিতে থাকুন ওঁরা।”
আবেগে সিদ্ধার্থকে জড়িয়ে ধরেছিল প্রিয়া। পরদিনই পিসিমণিকে ডেকে পাঠিয়েছিল। প্রিয়ার জরুরি তলব পিসিমণির কাছে সর্বদাই শিরোধার্য। এবার হুকুম ছিল,”শুধু তুমি নয়, পিসেমশাইকেও নিয়ে আসবে। বাবা অফিস থেকে ফেরার আগেই আসবে।”
পিসিমণি বলেছিল, “তার চেয়ে তুইই বরং কলেজ থেকে ফেরার সময় চলে আসিস আমাদের বাড়ি। পিসেমশাই তোকে পৌঁছে দেবে।”
পরদিন শুধু প্রিয়া নয়, সিদ্ধার্থও গেছিল পিসিমণির বাড়ি। চারজনে মিলে আলোচনা হয়েছিল। পিসিমণি তো সব শুনে ভীষণ অবাক,খুশিও। আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল। ওরাও চায় এই দু’জন মানুষকে আবার মিলিয়ে দিতে। সেই সব পরিকল্পনা করেই আজ সিদ্ধার্থ ওর মাকে নিয়ে আসছে প্রিয়াদের বাড়ি। “কিন্তু এখনও আসছে না কেন!” অস্থির হয় প্রিয়া। ঠিক তখনই শোনে গাড়ির শব্দ। সিদ্ধার্থের গলা।
“দেখেছ, ওরা এসে গেল! পিসিমণি এখনও এল না।” অস্থির হয়ে দৌড়ে বারান্দায় এল প্রিয়া। “ওঃ যাক্! পিসিমণিও এসে গেছে। ওই তো পিসিমণির গাড়ি।”—চলবে।
* শম্পা দত্ত সঞ্চালিকা ও আবৃত্তি শিল্পী।

Skip to content