শুক্রবার ৮ নভেম্বর, ২০২৪


সিদ্ধার্থ মনে মনে খুব এক্সাইটেড। ও আর প্রিয়া মিলে যে পরিকল্পনাটা করেছে জানে না তা সত্যি হবে কিনা। সিদ্ধার্থ খুব চায় সত্যি হোক। প্রিয়াও চায়। আসলে পরিকল্পনাটা প্রিয়ারই। এমনকি প্রিয়ার পিসিমণিও চান তাদের পরিকল্পনাটা বাস্তবায়িত হোক। কী হবে জানে না ওরা। মা জীবনে কিচ্ছু পায়নি। অথচ মা কম সুন্দরী ছিল না। শিক্ষাগত যোগ্যতাও কম নয়, বাংলাতে মাস্টার ডিগ্রি করেছে। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে মা এতটুকু সম্মান পায়নি। না বাবার কাছে, না বাড়ির অন্য কারও কাছে। দাদু- ঠাকুমা কাকিমণিকে মাথায় করে রাখত, আর মাকে কথায় কথায় অপমান করত।
সিদ্ধার্থর মামার বাড়ির অবস্থা খুবই সাধারণ ছিল। কাকিমণির বাপের বাড়ি ছিল বড়লোক। তাই বোধহয় ব্যবহারের এই তারতম্য। সিদ্ধার্থের বাবা খুবই ভালো চাকরি করতেন। কিন্তু জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সিদ্ধার্থের একটা দিনের কথা মনে পড়ে না, যেদিন বাবা সুস্থ অবস্থায় অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছেন। প্রতিদিনই নেশায় চুর। ড্রাইভার কাকু ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যেত। আর তারপরই শুরু হতো মায়ের উদ্দেশে অকথ্য গালিগালাজ। এমনকি মাঝে মাঝে গায়েও হাত তুলেছে। বাবার জন্য সিদ্ধার্থের মনে এতটুকু জায়গা তখনও ছিল না, এখনও নেই।
আরও পড়ুন:

শারদীয়ার গল্প: তখন বিকেল/ ১

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৯: সুন্দরবনের পাখি—পানকৌড়ি

সিদ্ধার্থের যখন বয়স বারো, তখন একদিন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর সময় অ্যাক্সিডেন্টে ভীষণভাবে আহত হয় বাবা। দিন তিনেক নার্সিংহোমে শুয়ে থাকার পর মারা যায়। একটুও কষ্ট তো সিদ্ধার্থের হয়ইনি, বরং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল এই ভেবে, যে মাকে আর রোজ রোজ অপমানিত হতে হবে না। কিন্তু সিদ্ধার্থের ভাবনায় একটু ভুল ছিল। বাবার অপমানের হাত থেকে পরিত্রাণ পেলেও বাড়ির অন্যরা মাকে ছেড়ে কথা বলেনি। এমনকি বাবার মৃত্যুর জন্য পরোক্ষে তারা মাকেই দায়ী করেছে। মা নাকি একটা দিনও বাবাকে শান্তি দেয়নি। মা নাকি তাদের অফিসার ছেলের উপযুক্তই নয়।
আরও পড়ুন:

বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি: বাংলা বুকের ভিতরে

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

যাইহোক, বাবা মারা যাবার পর মাত্র দু’মাস ওই বাড়িতে ছিল তারা। এত অপমান সহ্য করে আর ও বাড়িতে থাকা সম্ভব হয়নি মায়ের পক্ষে। বারো বছরের সিদ্ধার্থের হাত ধরে বাড়ি ছেড়েছিল। সম্বল বলতে বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া কয়েকটি গয়না। প্রথম দিকে সেগুলো বিক্রি করেই কোনোরকমে সিদ্ধার্থের স্কুলের মাইনে,বাড়ি ভাড়া, খাওয়া খরচা চলেছে। কতদিন সিদ্ধার্থ দেখেছে তাকে রুটি খাইয়ে দু-গ্লাস জল খেয়ে রাতে মা শুয়ে পড়েছে। জিজ্ঞেস করলে বলেছে, “দুপুরের খাওয়াটা খুব বেশি হয়ে গিয়েছিল রে, তাই একটুও খিদে নেই।”
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার

কিছুদিন পর মা একটা প্রাইভেট স্কুলে চাকরি পায়। সামান্যই মাইনে। তারপর প্রাইভেট টিউশনি শুরু করে। পড়াবার দক্ষতায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সুনাম অর্জন করে। একটু একটু করে উপার্জন বাড়ে। কিন্তু খরচও তো বাড়তেই থাকে। সিদ্ধার্থের পড়ার খরচ তো কম ছিল না। ইকনমিকস নিয়ে পড়েছে ও। গ্রাজুয়েশন পর্যন্ত মা ওকে প্রাইভেট টিউশনি করতে দেয়নি। গ্রাজুয়েশনে ফার্স্ট ক্লাস পাবার খবর শোনার পর আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল মা। বিড়বিড় করে বলেছিল, “আমাকে তুমি শক্তি দিও। তোমার ভালোবাসাই আমার শক্তি।” কার ভালোবাসা জিজ্ঞেস করায় মা চমকে উঠেছিল। আমতা আমতা করে বলেছিল, “কার আবার! ঈশ্বরের।” আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি সিদ্ধার্থ। আজ বোঝে মা আসলে কার ভালোবাসার কথা বলেছিল।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

এমএসসি-তে ভর্তি হবার পর জোর করেই সিদ্ধার্থ টিউশনি করতে শুরু করে। মা প্রথমটায় আপত্তি করে বলেছিল, “কেন বাবু? আমি তো এখনও পারছি।” কিন্তু কোনও কথা শোনেনি সিদ্ধার্থ। বলেছে, “আমার এখন যথেষ্ট বয়েস হয়েছে তোমার পাশে দাঁড়ানোর। আমি আর কোনও কথা শুনবো না। এবার তুমি একবেলার টিউশনি বন্ধ করো, আমি শুরু করি।” এ ভাবেই একদিন প্রিয়া আসে তার জীবনে।

প্রিয়াও দারুণ ব্রিলিয়ান্ট। প্রথম থেকেই ওর মিষ্টি স্বভাব আকৃষ্ট করেছিল সিদ্ধার্থকে। তারপর ক্রমশ কোনও এক অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা পড়েছে দু’জনে। প্রিয়ার বাবাও খুব ভালো মানুষ। কী দারুণ রবীন্দ্রসংগীত গান! বড় আপন মনে হয়। কিন্তু কোথাও যেন মানুষটা বড় দুঃখী। কী যেন তাঁর পাওয়া হয়নি। ফাঁকা থেকে গিয়েছে হৃদয়ের গোপন কোনও জায়গা। ওনাকে দেখার পর, বা ওনার সঙ্গে কথা বলার পর এটাই মনে হত সিদ্ধার্থের। এখন বুঝতে পারছে কী ওনার পাওয়া হয়নি। যতই প্রিয়াদের বাড়ি এগিয়ে আসছে, ততই উত্তেজনা বাড়ছে সিদ্ধার্থের। তাদের পরিকল্পনা সত্যি হবে তো শেষ পর্যন্ত?—চলবে।
* শম্পা দত্ত সঞ্চালিকা ও আবৃত্তি শিল্পী।

Skip to content