শুক্রবার ৮ নভেম্বর, ২০২৪


“আবার ওলা করতে গেলি কেন রে বাবু? বাসেই তো দিব্যি যাওয়া যেত। শুধু শুধু এতগুলো টাকা খরচ।” গাড়িতে বসতে বসতে সিদ্ধার্থকে কথাগুলো বলল কবিতা।
সিদ্ধার্থ হেসে উত্তর দেয়, “কী যে বলো না মা, তুমি! ছেলের হবু শ্বশুরবাড়িতে প্রথম যাচ্ছ, বাসে করে কী যাবে! তোমার একটা সম্মান নেই?”
“বাসে করে গেলে সম্মান নষ্ট হয়, এ কথা তোকে কে বলল রে? ট্রেনে-বাসে চেপেই তো এতখানি জীবন কাটল।”
“সে যখন আমাদের উপায় ছিল না, তখন চেপেছ। তখন ট্যাক্সিতে করে যাতায়াতের কথা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না মা! আর শুধু বাসে-ট্রেনে কেন, এক-দেড় মাইল রাস্তা তো তুমি পায়ে হেঁটেও যাতায়াত করেছ। আমায় মানুষ করতে অনেক কষ্ট তুমি করেছ মা। এখন আমি চাকরি পেয়েছি, এখন আর তোমায় একটুও কষ্ট পেতে দেব না, বুঝলে?” কথাগুলো বলে মাকে জড়িয়ে ধরে সিদ্ধার্থ।
ছেলের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে কবিতা। মনে মনে গর্বিত হয়। না, তার এতদিনের পরিশ্রম, কৃচ্ছসাধন ব্যর্থ হয়নি। ঈশ্বর তাকে সবদিক থেকে নিরাশ করেননি। ছেলে যদি মায়ের দুঃখ বোঝে, তাহলে সেই মায়ের চেয়ে বেশি সুখী আর কে? আর কারও ভালোবাসা সে না পাক, তার সিদ্ধার্থ অন্তত তাকে ভালোবাসে। না…না আরও একজন। সিদ্ধার্থের ডাকে ভাবনায় ছেদ হয়।
“কী ভাবছ মা এত!” সিদ্ধার্থ জানতে চায়।
“কিছু না তেমন, এই আরকি।” হেসে উত্তর দেয় কবিতা।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪১: ফয়জুন্নেসা— প্রথম মুসলমান মহিলা সাহিত্যিক

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৯: সুন্দরবনের পাখি—পানকৌড়ি

ভারি মিষ্টি মেয়ে প্রিয়া। সিদ্ধার্থের যখন এমএ ফাইনাল ইয়ার, তখন ওর এক বন্ধু প্রিয়াকে পড়াবার কথা বলেছিল ওকে। প্রিয়ার তখন বিএ ফার্স্ট ইয়ার। একদিন বিকেলে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে সিদ্ধার্থ কবিতাকে বলেছিল, “মা, একটা টিউশনি পেয়েছি। মেয়েটি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। লেকটাউনে বাড়ি। ভাবছি নিয়েই নিই। তুমি আর কত পরিশ্রম করবে! আমার টিউশনির টাকাগুলো দিয়ে যদি বাড়ি ভাড়াটাও হয়ে যায়, তাও তো অনেকটা রিলিফ হবে তোমার।”
লেকটাউন শুনে একটু চমকে ছিল কবিতা। পরক্ষণেই মনে হয়েছিল, লেকটাউনে কি শুধু একজনের বাড়ি! মুখে বলেছিল, “এ বছর তোর ফাইনাল ইয়ার। এত টিউশনি নিলে নিজে কখন পড়বি রে?”
“আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব।” সিদ্ধার্থ জানিয়েছিল।
আরও পড়ুন:

বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি: বাংলা বুকের ভিতরে

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

সেই থেকে প্রিয়ার সঙ্গে সিদ্ধার্থের পরিচয়। ছাত্রীটি যে শুধুমাত্র আর ছাত্রী নেই, ক্রমশ বিশেষ কেউ হয়ে উঠছে, এটা টের পাচ্ছিল কবিতা। সিদ্ধার্থের মুখেই শুনেছিল, প্রিয়ার মা নেই। বাবা আর মেয়ের সংসার। এক পিসি ছিল। মা মারা যাবার পর সে-ই প্রিয়াকে মানুষ করেছে। প্রিয়ার যখন দশ বছর বয়স, তখন বোনের বিয়ে দেন প্রিয়ার বাবা। সেই থেকে বাড়িতে দুটি প্রাণী– প্রিয়া আর তার বাবা।

ক’দিন ধরেই সিদ্ধার্থ বলছিল, “প্রিয়া একবার আমাদের বাড়ি আসতে চেয়েছে মা। তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছা ওর। মা নেই তো! তাই আমার মুখে তোমার কথা শুনে শুনে তোমাকে বোধহয় ও ওর মায়ের জায়গায় বসিয়ে ফেলেছে। রোজই প্রায় আমাকে জিজ্ঞেস করে তোমার কথা।”
“একদিন নিয়ে আয় না। আমারও ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। তোর মুখে ওর গল্প শুনে শুনে ও তো আমার আপনজনই হয়ে গিয়েছে।” হেসে বলেছিল কবিতা।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার

সেই প্রিয়া গত সপ্তাহে এসেছিল ওদের বাড়ি। প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছিল কবিতার। বেশ একটা আলগা শ্রী আছে। আর চেহারার থেকেও বেশি মিষ্টি ওর ব্যবহার। কাকিমা না,জেঠিমা না, মাসিমা না, এমনকি আন্টিও না; একেবারে ‘মা’ ডাকল।
“আমার মা বলে ডাকার কেউ নেই। তোমাকে মা বলে ডাকি?” ছলছল দুটো চোখ মেলে জিজ্ঞেস করেছিল প্রিয়া।

এ মেয়েকে ভালো না বেসে পারা যায়! ওকে বুকে টেনে নিয়েছিল কবিতা। তারপর এ ঘর, ও ঘর, রান্নাঘর কবিতার পেছনে পিছনে ঘুরঘুর করেছে। মা নেই বলে সংসারের অনেক কাজই ও শিখে গেছে। বাবার গল্প করছিল। বাবা খুব ভালো গান করেন নাকি। চা করতে করতে আপন মনেই একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছিল প্রিয়া— “তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম”। কবিতা অবাক হয়ে শুনছিল। এ গান ওর খুব চেনা। অনেক বছর আগে কেউ প্রায়ই শোনাত। অনেক গানই শোনাত। কিন্তু এই গানটা বড়ো প্রিয় ছিল কবিতার। প্রায়ই শুনতে চাইত। প্রিয়াকে বলেছিল, “বাঃ, তুমি তো খুব সুন্দর গান করো! কার কাছে শেখো?”
“বাবার কাছে। জানো মা, আমার বাবা খুব সুন্দর গান করেন। আমাদের বাড়ি যেদিন যাবে, বাবাকে বলব তোমাকে গান শোনাতে।”
“ওমা, তোমাদের বাড়ি আমি যাব কেন?”
“কেন যাবে না? আমি যেমন তোমার কাছে এলাম, তোমাদের বাড়ি এলাম, তোমাকেও আমাদের বাড়ি যেতে হবে।”
“সে হবে একদিন।এত তাড়া কীসের!”
“না একদিন নয়। আগামী সপ্তাহেই একটা ছুটি আছে। আমার বাবার ছুটি, তোমার ছেলেরও ছুটি। ওইদিনই তুমি যাবে। পিসিমণিকেও সেদিন আসতে বলব।”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

কী নাছোড়বান্দা মেয়ে! কথা আদায় করে তবে ছেড়েছে। তবে মেয়েটার একটা আচরণ খুব অবাক করেছিল কবিতাকে। দেওয়ালের একটা তাকে কবিতার আইবুড়ো বেলার একটা ছবি আছে। একটা বিয়ের ছবিও ছিল, সিদ্ধার্থের বাবার সাথে। সিদ্ধার্থ ওটা কিছুতেই ঘরে রাখতে দেয়নি। কোথায় সরিয়েছে কে জানে! কবিতার ওই ছবিটা দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল প্রিয়া। শুধু অবাক নয়, চমকে উঠেছিল। বারবার জিজ্ঞেস করছিল, “মা,এটা তোমার ছবি? সত্যি করে বলো না মা, এটা সত্যিই তোমার ছবি?”

সিদ্ধার্থ খুব হেসেছিল। “আরে, হ্যাঁ রে বাবা। মায়ের ছবি। দেখেছিস,কী রকম সুন্দরী ছিল আমার মা! তোর থেকে ঢের বেশি সুন্দর।”
কবিতা হেসে বলেছিল,”কী যে বলিস বাবু! আমার মেয়েটা অনেক বেশি সুন্দর।”
কিন্তু ওদের মা-ছেলের কথাবার্তা যেন প্রিয়ার কানেই ঢোকেনি। অপলকে তাকিয়ে ছিল ছবিটার দিকে। সেদিনের পর থেকে রোজ ফোন। “কেমন আছ? আসছ তো আমাদের বাড়ি? আমি পিসিমণিকেও আসতে বলেছি। না এলে কিন্তু খুব কষ্ট পাবো মা।” বাপরে বাপ! পাগল করে দিয়েছে মেয়ে। অবশেষে আজ আসা।
কী জানি বাড়ি গেলে কী করবে ওই মেয়ে! কবিতা মনে মনে হাসে। জড়িয়ে ধরে হয়তো লাফালাফি শুরু করে দেবে। আচ্ছা পাগল মেয়ে। কিন্তু খুব মিষ্টি। সিদ্ধার্থ খুব সুখী হবে ওকে নিয়ে। —চলবে।
* শম্পা দত্ত সঞ্চালিকা ও আবৃত্তি শিল্পী।

Skip to content