রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সারা পৃথিবী করোনা সংক্রমণ জনিত আতঙ্কে ভুগছে। এই প্রতিবেদন যখন লিখছি আমাদের দেশ তখন দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর ওমিক্রন নামক তৃতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত। এর সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি আগের সংক্রমণগুলো থেকে কম ক্ষতিকর হলেও হার কিন্তু অনেক বেশি। প্রথম ও দ্বিতীয় বারের সংক্রমণে প্রবীণদের আক্রান্ত হবার হার অনেক বেশি ছিল এটা যেমন সত্যি, তেমনি এবারেও কিন্তু অন্যান্য বয়সিরাও সঙ্গে সঙ্গে বেশ আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই এই সময়কালে বিশেষ করে বয়স্কদের সতর্কতা অবলম্বন করা এবং পরিবারের লোকজনের এই বিষয়ে দৃষ্টিপাত ভীষণভাবে জরুরি। তবে অযথা আতঙ্কিত হবেন না আর গুজবে কান দেবেন না। আর একটি আশাপ্রদ কথা হল একটি বিরাট অংশের প্রবীণ মানুষদের করোনা ভ্যাক্সিনের দুটি ডোজ এমনকী অনেকের বুস্টার ডোজও সম্পূর্ণ হয়ে গেছে।

কী কী লক্ষণ? বা কী হলে সতর্কতা নেবেন?

এবারের সংক্রমণে গতবারের লক্ষণ ছাড়াও আরও নানান উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, যেমন—
● জ্বর বা জ্বর এবারে উচ্চ তাপমাত্রা ১০৩/১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর উঠছে
● জ্বর ভাব
● হাঁচি ও সর্দি
● শুকনো বিরক্তিকর কাশি আবার ঘন কাশি
● গন্ধ না পাওয়া
● স্বাদ না পাওয়া
● গা হাত পা ব্যথা
● পেশি ও অস্থি সন্ধিতে ব্যথা
● মাথা ব্যথা
● শ্বাসকষ্ট হালকা থেকে বেশি
● হাঁটলে বা একটু কাজে হাঁপিয়ে যাওয়া
● দুর্বলতা সামান্য থেকে বেশি
● গলায় প্রদাহ বা ব্যথা
● ডায়রিয়া ও পেটের গণ্ডগোল
● ত্বকে র্যাপশ ওঠা
● চোখ লাল হয়ে যাওয়া
● কানে তালা লেগে যাওয়া

এছাড়া সংক্রমণ জনিত কোনও ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে বিশেষ করে আবদ্ধ জায়গায় ১৫ মিনিটের বেশি সময় কাটালে বিশেষ সতর্কতা নিতে হবে।
সাধারণ ক্ষেত্রে ২ সপ্তাহ, বেশি সংক্রমণে ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ এমনকী এর বেশি পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

কী পরীক্ষা করবেন?
কোনও রকম উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন সত্বর। অবহেলা করবেন না বিশেষ করে প্রবীণদের ক্ষেত্রে। আরটি পিসিআর এই পরীক্ষাটি করে নেওয়া প্রয়োজন যাতে বোঝা যাবে আপনি সংক্রমিত কি না। আর সিটি ভ্যালু জানতে পারলে খুব ভালো হয়। এছাড়া রক্তের কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (Complete Blood Count), নিউট্রোফিল অ্যান্ড লিম্ফোসাইটিস রেসিও (Neutrophil and Lymphocytes Ratio), সিআরপি, ডি ডিমার (D dimer), ফেরিটিন Ferritin, আইএল৬ (IL6), এলডিএইচ, ইউরিয়া ক্রিটিনাইন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, সুগার ফাস্টিং Sugar Fasting, পিপি, এলএফটি ইত্যাদি দেখে নিতে হবে কতটা ঝুঁকি বা রোগের প্রকৃতি জানতে। এছাড়াও চেস্ট এক্সরে (Chest X ray), ইসিজি, এইচআরসিটি চেস্ট উইথ সিটি ভ্যালু (HRCT Chest with CT value) ও প্রয়োজন বোধে দেখে নেবার দরকার হয়।

কখন মারাত্মক?
এই সংক্রমণে ভাইরাসগুলো প্রথমে শ্বাসতন্ত্রের উপরের দিক বা আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট আক্রান্ত হলেও পরে নীচের অংশ অর্থাৎ লোয়ার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট-এ ছড়িয়ে পড়তে পারে, ফলে তার থেকে নিউমোনিয়া, সেপ্টিসেমিয়া, এআরডিএস (একিউট রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস সিন্ড্রোম) এবং মাল্টি অর্গ্যান ফেলিওর হয়। ফলে মৃত্যুর সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

বয়স্করা কেন বেশি আক্রান্ত?
নিম্নলিখিত কারণগুলোর জন্য বয়স্কদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি:
● ক্ষয়জনিত কারণে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় বলে।
● একাধিক রোগ বিশেষ করে দীর্ঘস্থায়ী ক্রনিক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, হৃৎপিণ্ডের রোগ যেমন ক্রনিক হার্ট ফেলিওর, ক্রনিক কিডনির রোগ, ক্রনিক লিভার রোগ, সিওপিডি এবং অন্যান্য শ্বাসজনিত রোগ থাকে যার ফলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
● অসুস্থ জীবনশৈলী, ধূমপায়ী, মদ্যপায়ী, কম পরিশ্রম ইত্যাদির কারণে।
● অপুষ্টির কারণে।
● অনেক ওষুধ সেবনের দরকার হয় এবং কিছু ওষুধ যেমন সিস্টেমিক কোরটিকোস্টেরয়েড (Systemic Corticosteroid) ইত্যাদির ক্ষেত্রে সম্ভাবনা বেশি থাকে।
● বয়সকালে ড্রাগ রেসিস্টেন্স বৃদ্ধি পায়, ফলে ওষুধ চট করে কাজ করতে চায় না।

প্রতিরোধের উপায়
সুনির্দিষ্ট
● কঠোর ভাবে এসএমএস (সোশ্যাল/ফিজিকাল দূরত্ব, মাস্ক পরিধান ও স্যানিটাইজার ব্যবহার) পালন করা।
● ভ্যাক্সিন নিয়ে নেওয়া।
● কিছু আড়াল করে কাশা (কাফিং এটিকেট), কনুই ভাঁজ করে বাহুতে মুখ ঢেকে কাশা। টিস্যু পেপার বা রুমাল ব্যবহার করে হাঁচি বা কাশা।
● বারবার হাত-মুখ ধোয়া। সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে।
● অপ্রয়োজনে চোখে, মুখে, নাকে হাত না দেওয়া।
● সর্দি-কাশি হলে বেশি অন্যের সঙ্গে না মেশা।
● সন্দেহভাজন রোগীদের থেকে অন্তত ২ মিটার/ ৬ ফুট দূরে থাকা।
● সাবধানতার জন্য বয়স্কদের বাড়ি থেকে না বেরোনো। কোনও কারণে দরকার হলে বেরোনোর সময় অবশ্যই মাস্ক পরা। একবার পরা হয়ে গেলে মাস্কটিকে বদ্ধ ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া।
● জ্বর কিংবা কাশি বা অন্যান্য উপসর্গ হয়েছে এমন মানুষদের বয়স্কদের ঘরে ঢুকতে না দেওয়া উচিত।
● অসুস্থ বয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রতিদিন তাঁর নিত্য ব্যবহৃত জিনিসকে জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করা উচিত।
● পুষ্টিকর, টাটকা খাবার খাওয়া দরকার।
● বাথরুম করার পর বা ঘরের অন্যত্র থেকে ফিরে আসার সময় হাত সাবান দিয়ে ধুতে হবে।
● পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করা।
● প্রাণায়াম বা ব্রিথিং এক্সারসাইজ করা। স্পাইরোমিটার-এর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। সম্ভব হলে দক্ষ ফিজিওথেরাপিস্টকে দিয়ে চেস্ট এক্সারসাইজ করানো।
● ভিড় জায়গা বা জমায়েত এড়িয়ে চলা।
● কোনও অবস্থাতেই মদ্যপান করবেন না। অভ্যাস আছে যাঁদের তাঁরা অবশ্যই পরিমিত পরিমাণে। ধূমপান থেকেও বিরত থাকুন বিশেষ করে সিওপিডি বা হাঁপানি যাঁদের রয়েছে।
● সন্ধ্যায় বা রাত্রিতে কোনও স্নান চলবে না।
● নিয়মিত যে ওষুধগুলো খান সেগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে সংগ্রহে রাখুন। কোনও ওষুধ নিজের থেকে বন্ধ করবেন না।
● প্রবীণ মানুষটির ঘরটি যেন খোলামেলা হয় এবং উপযুক্ত হাওয়া বাতাস খেলে।
● সম্ভব হলে নির্দিষ্ট সময় অন্তর বাড়িকে স্যানিটাইজ করুন।

সাধারণ
● দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন ডায়াবেটিস, হাই প্রেশার প্রভৃতি রোগগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।
● মুখমণ্ডলের স্বাস্থ্যবিধিকে বজায় রাখা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা।
● সমস্ত ধরনের নেশা থেকে বিরত থাকা।
● পুষ্টিকর ও সহজপাচ্য খাবার। শাকসবজি ও মরশুমি ফল খাওয়া।
● পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম।
● খুব প্রয়োজন ছাড়া বহুবিধ ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকা।
● নিউমোকক্কাল ও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন না নেওয়া থাকলে নিয়ে নেওয়া৷

কখন নিতে হবে ভ্যাক্সিনের বুস্টার ডোজ?
দ্বিতীয় ডোজের ৩৯ সপ্তাহের পর। যদি কারওর করোনা হয়ে থাকে তাহলে তার তিন মাস পর।

পালস অক্সিমিটার আছে তো?
পালস অক্সিমিটার যন্ত্রটি এখন সকলের কাছেই খুব পরিচিত। এই যন্ত্রটির মাধ্যমে আমাদের শরীরে রক্তে অক্সিজেনের স্যাচুরেশনের মাত্রার জানান দেয় এবং পালসের মাত্রা জানায়। রক্তে সাধারণত ৯৫ শতাংশের বেশি অক্সিজেনের স্যাচুরেশন থাকে। যে সমস্ত রোগী সিওপিডি অসুখে ভোগেন তাঁদের একটু কমের দিকে থাকে ৯০ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু করোনার রোগীদের যদি অক্সিজেনের স্যাচুরেশন ৯৪ শতাংশ বা তার কমে যায় তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসক জানাতে হবে এবং প্রয়োজনে অক্সিজেন দিয়ে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এটি দেখার সময় আঙুলে যেন জল না থাকে বা ঠান্ডা না থাকে তাহলে একটু ঘষে নিয়ে তারপর লাগাতে হবে, ন্যূনতম ৩০ সেকেন্ড অপেক্ষা করে এক জায়গায় স্থিত রিডিংটা নিতে হবে। আঙুলে কোনও নেলপালিশ রাখা যাবে না। করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টায় একবার দেখা উচিত, বিশেষ করে ওঠানামা করলে।

হ্যাপি হাইপোকশিয়া নয় তো?
অনেক সময় রোগীর অজান্তেই কোনও রকমের শ্বাসকষ্ট ছাড়া অক্সিজেনের স্যাচুরেশন কমতে থাকে। একে বলা হয় হ্যাপি হাইপোকশিয়া। বয়স্কদের এই প্রবণতা বেশি। অনেকের বিশ্রাম বা বসে থাকা অবস্থায় অক্সিজেনের স্যাচুরেশন ঠিক থাকলেও হাঁটাচলার পর কমে যায়। সেটাও কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে ছয় মিনিট হাঁটার পর অক্সিজেনের স্যাচুরেশন যদি অনেকটা কমে যায় তাহলে কিন্তু সতর্ক হতে হবে এবং চিকিৎসককে জানাতে হবে। সেক্ষেত্রে রোগীকে কিন্তু অক্সিজেন দিতে হতে পারে।

খাবারের সতর্কতা কী নেবেন?
● কোনওভাবেই যেন মশলাদার খাবার না খাওয়া হয়।
● অনেক পদের খাবারও কোনওভাবেই সমীচীন নয়। এসবের কারণে হঠাৎ পেট খারাপ বা বদহজম এমনকী হাইপার অ্যাসিডিটি হতে পারে।
● তেল, ঝাল, মশলা কম ব্যবহার করে রান্না করুন।
● ফ্রিজে রাখা বাসি খাবার একেবারেই নয়।
● যতটা সম্ভব সহজ পাচ্য ও নরম খাবার খেতে হবে।
● পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খেতে হবে। কোনওভাবেই যেন ডিহাইড্রেশন না হয়। কোনওরকম নিষেধ না থাকলে দিনে অন্তত তিন লিটার জল ও জলীয় দ্রব্য পান করুন। কোন অবস্থাতেই ঠান্ডাজল বা কোল্ডড্রিংক্স খাবেন না।
● ভিটামিন সি সমৃদ্ধ যেমন পাতিলেবু, মুসাম্বি লেবু, পেয়ারা, আঙুর, আপেল, কিউই, বেরিস, পেঁপে ইত্যাদি খেতে পারেন।
● আ্যলমন্ড, ছানা, দই (ঘরের তাপমাত্রায়), ডালিয়া খিচুড়ি, উপমা, পোহা ইত্যাদি ও খুব ভালো।
● প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন সেদ্ধ ডিম, পাতলা চিকেন স্যুপ, পাতলা মাছের ঝোল ইত্যাদি খুব উপকারী।
● প্রয়োজন হলে নিউট্রিশনাল সাপ্লিমেন্ট পাউডার চিকিৎসকের পরামর্শে নিতে হবে।

গৃহভিত্তিক প্রতিষেধক?
চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত করোনাকে প্রতিহত করার জন্য কোনও ওষুধ (হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, ডক্সিসাইক্লিন, আইভারমেকটিন ইত্যাদি) বা জরিবুটি কোনওভাবেই খাওয়া শুরু করবেন না। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, সর্দি বা গলা খুসখুসের জন্য সেটিরিজিন বা লিভসেটিরিজন বা ক্লোরফেনিরামিন সমন্বিত জাতীয় ওষুধ ছাড়া অন্য কোনও ওষুধ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া খাবেন না। পেট ঠিক রাখতে এই সময়টা প্রোবায়োটিকের (বিফিডোব্যাক্টেরিয়াম, ল্যাক্টব্যাসিলাস জাতীয়) ৭/১০ দিনের কোর্স করে রাখতে পারেন। ভিটামিন সি ও জিঙ্ক খেতে পারেন ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করে। দুবেলা নুন জলে গার্গল বা উষ্ণ ভাপ নিতে পারেন। গ্রিন টি খেতে পারেন। কিন্তু এর বেশি নিজের থেকে কোনও চিকিৎসা না করাই শ্রেয়।

পারলে প্রোনিং অভ্যাস করুন
উপুড় হয়ে শুয়ে অর্থাৎ পেট ও বুক নীচে আর পিছন উপরে রেখে মাথা ও বুকের কাছে, পেটের নীচে আর পায়ের নীচে বালিশ রেখে ১৫-৩০ মিনিট শুয়ে থাকতে পারলে ফুসফুসের বায়ু ধারণ ক্ষমতা বাড়ে ফলে অক্সিজেন স্যাচুরেশন বাড়ে। এর জন্য ইউটিউবে সুন্দর করে দেখানো আছে। সেটা দেখে অভ্যাস করতে পারলে বয়স্কদের শ্বাসজনিত সমস্যায় উপকার পাওয়া যাবে।

কোন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতেই হবে?
● শ্বসকষ্ট হলে
● অক্সিজেনের স্যাচুরেশন ৯৪ শতাংশ বা তার নীচে নেমে গেলে
● জ্বর দুদিনের বেশি হলে
● কাশি দুদিনের বেশি হলে
● অত্যধিক দুর্বলতা হলে
● কিন্তু প্রবীণদের ক্ষেত্রে আমরা বলব করোনার সম্ভাব্য যে কোনও উপসর্গ দেখা দিলেই সেটা যত সামান্যই হোক না কেন অনতিবিলম্বে চিকিৎসককে জানানো বা দেখানো উচিত।
কখন বাড়িতে অবশ্যই মাস্ক পরবেন?
যাঁরা করোনা রোগী বা সন্দেহভাজন করোনা রোগীর সংস্পর্শে আছেন তাঁদের অবশ্যই বাড়িতে মাস্ক পরতে হবে। বয়স্করা মেডিক্যাল মাস্ক বা এন ৯৫ মাস্ক পরতে পারেন। তাছাড়া বাড়িতে কোনও কাজের লোক বা আয়া বা কোনও কারণে বাইরের লোক এলে অবশ্যই মাস্ক পরবেন। বর্তমানে সতর্ক থাকতে বাড়িতে এমনি সময়েও মাস্ক পরার কথা বলা হচ্ছে। ত্রিস্তরীয় সার্জিক্যাল বা মেডিক্যাল মাস্কের উপর সুতির আর একটি মাস্ক পরতে বলা হচ্ছে এখন। কোনওভাবেই যেন মাস্কের সামনে বা অন্য অংশে হাত না দেওয়া হয়।

আপনার কেয়ার গিভার বা আয়ারা সতর্ক তো?
যাঁদের কেয়ার গিভার বা আয়ার পরিষেবা নিতে হয়, তাঁরা এবং পরিবারের সদস্যদের লক্ষ রাখতে হবে যেন বাইরে থেকে আসার পর জামাকাপড় খুলে পরিষ্কার জামাকাপড় পরে সঠিকভাবে হাত ধুয়ে যেন কাজ শুরু করে। মুখে যেন মাস্ক নিয়ে কাজ করে। প্রয়োজন হলে বাড়ির লোককে মাস্ক ও স্যানিটাইজার কিনে দিতে হবে। বারবার যেন হাত ধোয়া হয়। যদি সম্ভব হয় একজনই যদি ২৪ ঘণ্টা অন্তত এই সময়ের জন্য ডিউটি করে খুব ভালো হয়। কারণ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে যদি আসে তাহলে বাহক হয়ে সংক্রমণ বয়ে নিয়ে আসার সম্ভাবনা থাকে। তার থেকে বয়স্ক মানুষদের সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

অযথা প্যানিক নয়
অযথা আতঙ্কিত হবেন না। গুজবে কান দেবেন না। নিজেকে গুটিয়ে রাখবেন না। তাতে ভয়, অবসাদগ্রস্থতা আপনাকে পেয়ে বসবে, যেটা কোনওভাবেই কাম্য নয়। অযথা হাসপাতালে ভর্তি, বেড, ওষুধ, খাবার এসব নিয়ে আতঙ্কিত হবেন না। সবসময় করোনা সংক্রান্ত খবর শোনা বা পড়া থেকে বিরত থাকুন। গবেষণায় দেখা গেছে প্যানিক অ্যাটাকের কারণে অযথা শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আর করোনা হলে সেটা সেরে উঠতেও প্রলম্বিত হচ্ছে। তাই প্যানিক একদম নয়। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

বয়স্করা সকলের সঙ্গে গল্পগুজব করে আনন্দ করুন, মনকে ভালো রাখুন
পরিস্থিতির কারণে গৃহবন্দি হয়ে যাওয়ার দরুন হয়তো বয়স্কদের মন খারাপ লাগতে পারে এমনকী অবসাদ ও আসতে পারে। তাই মন ভালো রাখার জন্য সুস্থ বয়স্করা বাড়ির অন্য সদস্যদের সঙ্গে গল্পগুজব করে বা গানবাজনা ইত্যাদি মাধ্যমে নিজেকে সচল রাখার চেষ্টা করুন। শুয়ে বসে এক্কেবারে অলস জীবন কাটাবেন না। বরং এই সময়টাকে বিশেষ করে নাতিনাতনিদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে উপভোগ্য করে তুলুন। এতে দেখবেন দুই প্রজন্মই এই সময়টা ভালো কাটাবেন। ঘরের মধ্যেই হালকা জগিং, ব্যায়াম বা যোগব্যায়াম ইত্যাদি করুন। যাতে আপনি এই সময়টায় ভালো ও স্বাস্থ্যকর থাকেন।

টেলি কনসালটেশনের সহায়তা নিন
কোনও অবস্থাতেই খুব প্রয়োজন না হলে চিকিৎসককে দেখাতে হাসপাতালে বা চেম্বারে যাবেন না। আমরা চিকিৎসকরা বারংবার সেটা নিষেধ করছি। প্রায় বেশিরভাগ চিকিৎসকই কিন্তু পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে টেলি কনসালটেশন করছেন। তাই রেগুলার ফলোআপ করার জন্য চিকিৎসকদের সঙ্গে টেলি কনসালটেশনের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করুন। তার জন্য বাড়ির লোকজনকে সহায়তা করতে হবে। আর ন্যূনতম ভাইটাল দেখার জন্য ব্লাড প্রেশার যন্ত্র, পালস অক্সিমিটার, থার্মোমিটার, সিবিজি মেশিন (ব্লাড গ্লুকোজ দেখার জন্য) এই মেশিনগুলো বাড়িতে রাখবেন।

পরামর্শের জন্য যোগাযোগ
● নিকটবর্তী প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র
● সরকারি হাসপাতাল
● সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
● বেসরকারি হাসপাতাল
● সরকারি হাসপাতালে ভর্তির জন্য, ফোন: – ০৩৩২৩৫৭৬০০০/ ১৮০০৩১৩৪৪৪২২২
● সরকারি ভার্চুয়াল চিকিৎসা, ফোন: ০৩৩২৩৫৭৬০০১
● কলকাতা পৌরসভা, ফোন: ০৩৩২২৮৬১২১২/ ১৩১৩
● কলকাতা পৌরসভার হোয়াটসআ্যপ, ৮৩৩৫৯৮৮৮৮৮
● মানসিক সমস্যার সহায়তা, ফোন: ১৮০০৩১৩৪৪৪২২২
● স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, বাঁচবো, ফোন: ৯১২৩৬৮৭০৪৭ (প্রবীণদের জন্য)
● টেলি কনসালটেশন ওয়েবসাইট : www.banchbohealingtouch.org
● জেরিয়াট্রিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া পশ্চিমবঙ্গ শাখা, ফোন: ৯৪৩৩৮৮৯৪৫৮ (প্রবীণদের জন্য)
● স্পর্শ (প্রোটেক্ট দ্যা ওয়ারিয়র্স), ফোন: ৭৪৩৯৫৯৬৪৬০
● ২৪/৭ কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্ক, ফোন: ১৮০০৮৮৯১৮১৯

পরিশেষে বলি এই যুদ্ধে আমরা জয়ী হবই। শুধু সময়ের অপেক্ষা। আর এর জন্য দরকার সকলের সহযোগিতা ও মিলিত প্রয়াস। আমরা প্রত্যেকেই কিন্তু এই যুদ্ধে এক একজন সেনানী। আর এই সময় প্রবীণদের ভালো থাকার ক্ষেত্রে যেমন নিজেদের ভূমিকা আছে, তেমনি সমাজের অন্যান্য সকলেরই কিন্তু বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। আর ভালো থাকতে হবে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে আর তার জন্য রবিঠাকুরের হাত ধরেই বলি—

বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা—
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়॥…

কারণ বড্ড দুঃসময়েও যে তাকে ভুলতে পারা যায় না। সুখে দুঃখে তিনিই যে আশ্রয় ও সাহস।

লেখক: কর্ণধার ‘বাঁচবো’, সহ সম্পাদক জেরিয়াট্রিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া, পশ্চিমবঙ্গ শাখা৷ উপদেষ্টা, প্রোটেক্ট দ্যা ওয়ারিয়ার্স। যোগাযোগ : ‘বাঁচবো’, ফোন : ৯৯০৩৩৮৮৫৫৬

Skip to content