শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ভেটিভার ঘাস ও দামোদর নদী। ছবি: সংগৃহীত।

সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এই ধরিত্রীর বুকে তৃণভূমি এমন এক অঞ্চল যেখানে গাছপালার মধ্যে ঘাসের আধিক্য বেশি থাকে। দূর্বাঘাস, মুথাঘাস, ভেটিভার, নলখাগড়া, শর, ধানগাছ, বাঁশ, ক্লোভার-সহ অসংখ্য নাম না জানা ঘাসে পরিপূর্ণ ‘ভগবানের রুমাল’ নামে পরিচিত এই তৃণভূমি পৃথিবীর জৈববৈচিত্র ধারণে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অসংখ্য অমেরুদণ্ডী ও মেরুদণ্ডী প্রাণীরা খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য তৃণভূমির ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল।

মানুষকে নান্দনিক আনন্দ দেওয়ার জন্য তৃণভূমির জুড়ি মেলা ভার। কুমেরু অঞ্চল বাদে পৃথিবীর সমস্ত মহাদেশেই তৃণভূমি প্রাকৃতিক ভাবেই দেখা যায়। সব ধরনের জলবায়ু এবং পরিবেশের সঙ্গে এরা সমানভাবে অভিযোজিত। তবে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ যেটা তা হল, পৃথিবীর বৃহত্তম বায়োম সমূহের মধ্যে একটি হল তৃণভূমি। বলতে গেলে, বিশ্ব জুড়েই এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে এই বায়োম। পৃথিবীর প্রায় ১০ শতাংশ অঞ্চল জুড়ে রয়েছে এই তৃণভূমি। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৫ থেকে ৭৫ শতাংশ হলেই সেখানে বিভিন্ন ঘাসের জন্ম হতে পারে, যা পৃথিবীর অন্যতম উৎপাদনশীল অঞ্চলও। এত স্বল্প বৃষ্টিপাতে বড় বড় বৃক্ষযুক্ত অরণ্য সৃষ্টি হয় না। কিন্তু সেখানে অনায়াসেই জন্ম হয় অসংখ্য ঘাসের। পৃথিবীতে নানা ধরনের তৃণভূমি অঞ্চল রয়েছে, যথা প্রাকৃতিক, আধা প্রাকৃতিক এবং কৃষিজ তৃণভূমি।
বৃষ্টিপাত, জলবায়ু ও আবহাওয়ার অন্যান্য বিষয়ের উপর নির্ভর করে সমগ্র পৃথিবীতেই কম-বেশি ক্রান্তীয়, উপক্রান্তীয় ও নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমি দেখা যায়। পৃথিবীর স্বাভাবিক তৃণভূমি অঞ্চলগুলির মধ্যে বিখ্যাত হল— ইউরোপ ও এশিয়ার স্টেপস, উত্তর আমেরিকার প্রেইরি, দক্ষিণ আমেরিকার পম্পাস ও ল্যাননোস, দক্ষিণ আফ্রিকার ভেল্ট, অস্ট্রেলিয়ার ডাউনস, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে চ্যাাপেরেল ইত্যাদি।

সমগ্র ভারতবর্ষের হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা বনভূমি দেখা যায় ভারতের মাটি হল ‘ন্যাচারাল সিড ব্যাংক’ বা স্বাভাবিক বীজ ব্যাংক হিসেবে কাজ করে। উত্তরে হিমালয় পর্বতে হিমালায়ান তৃণভূমি, বাকি ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে স্টেপস ও সাভানা তৃণভূমি এবং বালুকাময় এবং লবণাক্ত জমিতে স্টেপস তৃণভূমি লক্ষ্য করা যায়। আধা প্রাকৃতিক তৃণভূমি বিশ্বের সর্বাধিক প্রজাতির বাসস্থান হিসেবে কাজ করে। কৃষিজ বা মনুষ্য কর্তৃক সৃষ্ট তৃণভূমি আজ পৃথিবীর অন্যতম তৃণভূমি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এখন সচেতন মানুষ কোন ফাঁকা স্থান পেলে সেই জায়গায় ঘাসের বীজ ছড়িয়ে দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে প্রচুর ঘাসের জন্ম হয় ও খন্ড খন্ড তৃণভূমি তৈরি হয়।
আরও পড়ুন:

দূষণ যখন অন্দরমহলে, সুরক্ষিত থাকতে কী করবেন, কী করবেন না?

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-২: ভারতের স্থাপত্যশৈলীতে ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিব মন্দিরের অবদান অপরিসীম

এই গ্রাসল্যান্ডগুলি স্বাভাবিক উদ্ভিদের মতোই সৌরশক্তিকে সংবন্ধন করে, খাদ্য তৈরি করে। বহু গবাদি পশুর চারণভূমি হিসেবে কাজ করে এই অঞ্চলগুলি। যেহেতু এখানে বড় বড় বৃক্ষ থাকে না, তাই জেব্রা, বাইসন সহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীরা সচ্ছন্দে এখানে ঘুরে বেড়াতে পারে। এদেরকে বলা হয়, প্রাথমিক খাদক। এই প্রাথমিক খাদককে খেয়ে বেঁচে থাকে গৌণ এবং প্রগৌণ খাদক। গড়ে ওঠে খাদ্য-খাদক সম্পর্কিত জটিল খাদ্যজাল এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ, সুস্থিত এক বাস্তুতন্ত্র।

এই বাস্তুতন্ত্রের মায়াবী সৌন্দর্য উপভোগ করে মানুষের মন ভাল হয়ে ওঠে। বিভিন্ন ধরনের গাছ ভূমিক্ষয় রোধ করে, পৃথিবীকে সবুজ শ্যামলিমায় ভরিয়ে তোলে। ভেটিভার ঘাস ভূমিক্ষয় রোধ করে, নদীর তীরের ভাঙ্গনকে বন্ধ করে। কুশঘাস, বেনাঘাস ও ভেটিভার ঘাস থেকে দড়ি বানানো হয়ে থাকে, যা পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব। সিট্রোনিলা ও ভেটিভারের এক প্রজাতি থেকে সুগন্ধি তেল পাওয়া যায়। এই তেল বাড়ি থেকে মশা, মাছির মতো পতঙ্গ দূর করতে, মেঝে পরিষ্কার ও জীবাণুনাশক হিসেবেও কাজ করে। বাঁশও এক ধরনের ঘাসের প্রজাতি। এই বাঁশ, ঘাস ইত্যাদি থেকে কাগজ তৈরি করা হয়ে থাকে, যা অর্থনৈতিক উন্নতি সহ-শিক্ষা জগতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৫: রাজবাড়ি এবং অভিনব বিবাহপর্ব

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭০: অন্য বাইশে শ্রাবণ

লম্বা ঘাসকে একত্রিত করে বানানো হয়ে থাকে খড়-খড়ি, যা আগেকার দিনে সরকারি অফিস ও অন্যান্য অফিসে ঝুলিয়ে রাখা হতো। এতে মাঝে মধ্যে জল ছিটিয়ে দুপুরের দিকে তীব্র গরমের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। এইগুলি অনেকটা বর্তমান দিনের কুলারের মত কাজ করতো। নানান সৌখিন জিনিসপত্র, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র ইত্যাদি বানাতে ঘাসের কোনও জুড়ি নেই। সুতরাং কেবলমাত্র প্রকৃতি রক্ষা করতে নয়, মানব সভ্যতার উন্নতিকল্পেও ক্ষুদ্র এই তৃণের কোনো জুড়ি নেই।

বর্তমানে ভেটিভার ঘাসের ওপর ব্যাপকভাবে গবেষণার কাজ চলছে। জীববিজ্ঞানীদের মতে, কংক্রিট দিয়ে নদীর পাড় বাঁধানোর পরিবর্তে ভেটিভার ঘাস লাগিয়ে দিলে, তা শক্তভাবে পাড় ধরে রাখতে সাহায্য করে, বন্যার কবল থেকে আশেপাশের অঞ্চলকে বাঁচায়। বর্ধমান জেলার আরামবাগ, খানাকুলসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নদীর পাড়ে পরীক্ষামূলকভাবে এই ঘাস চাষ করে যথেষ্ট উপকার পাওয়া গিয়েছে।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-২: কাজের আশায়, তারকা অশোককুমারের গাড়িতে নয়, লোকাল ট্রেনে-বাসে ঘুরে বেড়াতেন কিশোর

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৪: রিমঝিম ঘিরে শাওন…আবার লতা, কিশোর ও পঞ্চমের সেই জাদু

নদী বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দামোদরের বন্যার কবল থেকে পূর্ব এবং পশ্চিম বর্ধমান জেলাকে রক্ষা করতে গেলে এই ঘাস আরও ব্যাপকভাবে চাষ করা দরকার। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে আরও সুসংহতভাবে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ভেটিভার ঘাস লাগিয়ে নদীর ভাঙ্গন থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হবে। এই দায়িত্ব কেবলমাত্র সরকারের একার নয়, সাধারণ মানুষ থেকে পরিবেশপ্রেমী সকলকে হাতে হাত ধরে কাজ করতে হবে।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content