রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

সমগ্র বিশ্বব্যাপী সঙ্গীতশাস্ত্র সর্বাপেক্ষা প্রাচীন শাস্ত্র বলে গণ্য। প্রাচীন ভারতে কাব্য, মহাকাব্য, পুরান, উপনিষদ ও দর্শনের মধ্যে সংগীতের নানান উদাহরণ পাই। মহারিশি যাগ্যবল্ক বলেছেন—
‘বীণাবাদন তত্ত্বজ্ঞ: শ্রুতিজাতি বিশারদ:।
তলঞ্গশ্চাপ্রয়াসেন মোক্ষমার্গ চ গচ্ছাতি’।


অর্থাৎ যিনি বীণা বাদনের তত্ত্ব অবগত আছেন, শ্রুতি ও জাতি সম্বন্ধে বিশেষভাবে জ্ঞাত আছেন এবং তাল বিষয়েও জ্ঞাত আছেন, তিনি অনায়েসে মোক্ষ বা নিবৃত্তিমার্গের অধিকারী হন।

বর্তমান সময়ের মতো পূর্বেও হর্ষ-বিষাদ সবেতেই সংগীতচর্চার চল ছিল। মধ্যযুগের আলাউদ্দিন খিলজি ও আকবরের সময়ে সঙ্গীতচর্চার বেশ চল ছিল। অসাধারণ সংগীত সাধক তানসেনের নাম আমরা সকলেই জানি। ইনি ছিলেন আকবরের সভাগায়ক। ১২১০-১২৪৭ সালের মধ্যে রচিত হয়েছিল সংগীত বিষয়ক প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘সংগীত রত্নাকর’। এখানে সংগীত নিয়ে প্রাচীনকালের ও মধ্যকালের বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য লিপিবদ্ধ আছে। এখানে আছে পঞ্চম স্বর সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। কোকিলের কণ্ঠস্বর এর মিষ্টতা আমাদের পরম তৃপ্তি ও আনন্দ দেয়। তাই মধুর কণ্ঠী কোনও গায়িকাদের আমরা কোকিল কণ্ঠী বলে থাকি।

সঙ্গীত বলতে কেবল গীত নয়, বাদ্য ও নৃত্য ও এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ভরত বলেছেন, স্ত্রীলোক গান গাইবেন, পুরুষ বাদ‍্য বাজাবে এবং নারী এবং পুরুষ উভয়ই নৃত্য করবে। যদিও সিন্ধু সভ্যতার আমরা নৃত‍্য ভঙ্গিমায় নারীমূর্তিই পাই যা নর্তকী নামেই পরিচিত।
এ তো গেল প্রাচীন কালের ঘটনা, বর্তমানকালেও সংগীত চর্চা বিপুলভাবে প্রচলিত। নানান ঘরানার মধ্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ঘরানা, লঘু ও রাগাশ্রয়ী ঘরানা এবং আধুনিক সংগীতের নানান ঘরানা বর্তমানে প্রচলিত। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে ২০০০ সালের পর থেকে সংগীতের শ্রোতার সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বহুকাল পূর্ব থেকেই সংগীত আমাদের মনের শান্তি ও প্রাণের আরাম দিয়ে আসছে। তাই সংগীত আমাদের কাছে এত আদরণীয়, এত আকর্ষণীয়। এখনও ক্রন্দনরত শিশু মায়ের ঘুম পাড়ানি গান শুনে ঘুমিয়ে যায়, বিষাদগ্রস্ত মানুষ জীবনে আনন্দ অনুভব করে, বিকারগ্রস্ত মানুষ জীবনের শাস্তি ও স্বাভাবিকত্ব অনুভব করে এবং সন্তানহারা মা সাময়িক সুস্থিতি পায় সংগীত থেকে।

আমেরিকা ও ফ্রান্সের মতো উন্নত দেশে ভারতের দুই সুসন্তান নৃত্য ও বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে সেখানকার বাসিন্দাদের মনে আনন্দের স্ফুরণ ঘটিয়েছিলেন, তারা হলেন উদয়শংকর ও রবিশংকর। সুতরাং সংগীত কেবল ভারতবর্ষ নয়, প্রচলিত বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই। পাখির গান বা কলকাকলি মানসিক ও শারীরিক নানান সমস্যা দূরীকরণে সাহায্য করে, সারিয়ে দেয় নানান কঠিন ব্যধি, সহজ সমাধান ঘটায় নানান জটিল সমস্যার। সম্পূর্ণ সত্য হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থাকলেও দেখা গিয়েছে সুমধুর সংগীত গাভীর দুগ্ধ বাড়াতে সাহায্য করে। সুশৃঙ্খলিত নাদ্ বা শব্দ যা পক্ষান্তরে সংগীত নামেই পরিচিত। এটি আমাদের শরীরে স্বাভাবিক বেদনানাশক বিটা এনডরর্ফিন নামক রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরণে সাহায্য করে। ইনসুলিনের ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়, ফলে ডায়াবেটিস কমাতে সাহায্য করে। ওষুধবর্জিত, কেবলমাত্র সংগীতের মাধ্যমে যে চিকিৎসাপদ্ধতি তাই মিউজিক থেরাপি বা সঙ্গীত থেরাপি নামে পরিচিত।
আরও পড়ুন:

স্বয়ং শিক্ষিত জ্যোতির্বিদ রাধাগোবিন্দ চন্দ্র প্রতিদিন হ্যালির ধূমকেতু দেখতেন আর খুঁটিনাটি লিখে রাখতেন

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-১: প্রকৃতি অসমকে সাজাতে কোনও কার্পণ্যই করেনি

অতি প্রাচীনকাল থেকেই জাপান এবং কম্বোডিয়ায় সংগীতকে থেরাপির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। চিন-সহ ওই সকল দেশগুলিতে এমন অনেক চেম্বার আছে যেখানে কোনও জরিবুটি বা ওষুধ, পথ্য ছাড়াই নানান সরল ও জটিল রোগের চিকিৎসা করা হয় কেবল সঙ্গীতের সাহায্যেই। অ্যালজাইমার্স, পার্কিনসন্স বা স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের ক্ষেত্রে কোনও সফট বা হারস মিউজিকের সাহায্যে তাদের স্নায়ুতন্ত্রের উন্নতি সাধন করা হয়। মানসিক ট্রমা বা কোমায় চলে যাওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে সংগীত চিকিৎসার জুড়ি নেই।

এ সব ক্ষেত্রে মিউজিককে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিষাদ ও মনের গ্লানি দূর করতে সর্বপ্রথম মিউজিক থেরাপির ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৪৪ সালে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি সর্বপ্রথম মিউজিক থেরাপির ডিগ্রি প্রদান করে। তবে গ্রিক দার্শনিক প্লেটোও মিউজিকের শক্তি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি সেই সময়ের সাপেক্ষে বলেছিলেন ‘সংগীত একদিকে যেমন যোদ্ধাদের মনোবল বাড়ায়, অন্যদিকে মনোবল ভাঙতেও সাহায্য করে’।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৫: সুন্দরবনে বসন্ত রোগের দেবতা বসন্ত রায়

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৭: জয়রামবাটির জগদ্ধাত্রীপুজো

অতি উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতিতে মদ ও ড্রাগের নেশা কাটানোর জন্য ওষুধ, কাউন্সেলিংয়ের সঙ্গে মিউজিক থেরাপিও করা হয়। ধর্ষণের ন‍্যায় নানান বীভৎস অভিজ্ঞতা বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার থেকে রোগীকে স্বাভাবিক ছন্দে নিয়ে আসার জন্য তাদের প্রিয় গান শোনানো হয়। যে সকল ব্যক্তির স্মৃতিলোপ পায় তাদেরকেও তাদের পূর্বের স্বাভাবিক জীবনের নানান গান শোনানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে এটি মিরাকলের ন‍্যায় কাজ দেয়। কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, সংগীত আমাদের শরীরে ডোপামিন নামক একটি বিশেষ হরমোন ক্ষরণে সাহায্য করে, যা আমাদের আনন্দের কারণ রূপে চিহ্নিত হয়। যারা নিয়মিত সংগীতচর্চা করেন তাদের হিউম্যান গ্রোথ হরমোনের ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়।

অ্যালঝেইমার ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মিউজিক থেরাপি এই ধরনের রোগীদের নিরাময়ে বিশেষ সাহায্য করে। চিন ও জাপান দীর্ঘদিন ধরে ইনসোমিয়া রোগীদের ক্ষেত্রে ধীরলয়ের সঙ্গীত চালিয়ে তাদের ঘুমের দেশে নিয়ে যেতে ব্যবহার করে। ইংল্যান্ডের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় প্রমাণিত যে, কেউ যদি আধঘণ্টা সংগীত যন্ত্র বাজায় তার মস্তিষ্কের বামদিকের অংশে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায়, ফলে মানব মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতাও বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে পড়াশুনায় মনোযোগ বাড়ে।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৪: মাটি তোদের ডাক দিয়েছে…

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৮৩: পাঁকাল মাছের প্রোটিনের গুণমাণ তো ভালোই, সঙ্গে ফ্যাটের পরিমাণও যৎসামান্য

বিশ্ববিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, রক্তচাপ ও হাইপারটেনশন কমাতে মিউজিক থেরাপির জুড়ি নেই। এছাড়াও গ্রেট ব্রিটেন কার্ডিওভাসকুলার সোসাইটি রিপোর্ট বলছে, টানা ১০ সেকেন্ড মিউজিক শুনলে রক্তচাপ হ্রাস পায়। আরও এক গবেষণায় প্রমাণিত, অস্ত্রোপচারের সময় একদল শিশুকে গান শোনানো হয় ও আরেকদল শিশুদের গান শোনানো হয় না। বাকি সমস্ত ব্যবস্থাপনা একই রাখা হয়েছিল। এক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, যেসব শিশুরা গান শুনতে শুনতে অস্ত্রোপচার করেছে তাদের ব্যাথা-বেদনা অনুভব অনেক কম হয়েছে। এই কারণেই অতি আধুনিক কিছু হসপিটাল, নার্সিংহোমে মিষ্ট আবহ সঙ্গীত বাজানো হয়।

অটিজম রোগীদেরও সংগীত বিশেষ উপযোগী। এছাড়াও মিউজিক থেরাপিতে রোগীদের কেবল গান শোনানো নয়, গান লিখতে, গান শিখতে, বাদ্যযন্ত্র বাজাতে এবং একক বা দলবদ্ধভাবে গান গাইতেও উৎসাহিত করা হয়। এর ফলে তাদের মনের যাবতীয় ব্যথা-বেদনা যেমন বের হয়, তেমনি মন আনন্দে ভরে ওঠেও। ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। এ ভাবে মন ভালো হলে শরীরও ধীরে ধীরে ভালো হয়ে ওঠে। নিয়মিত সংগীত শ্রাবণে গর্ভবতী মায়েদের গর্ভের শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ ভালো হয়। করোনা ভাইরাসের বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে আমাদের গৃহবন্দির বন্দিদশা কাটিয়ে অনেকটাই মুক্তির ও আনন্দের স্বাদ এনে দিতে পারে সুন্দর আনন্দময় সংগীত। তাই হয় তো বা সঙ্গীতকেই বলা হয় শ্রেষ্ঠ কলা।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content