মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

করাল দূষণের দূষিত আমাদের এই বসুন্ধরা। দূষণের থাবা যখন বাইরে ছেড়ে গৃহে প্রবেশ করে, তখন চিন্তার ছাপ পড়ে গৃহস্থের কপালে। পরিবেশের যে কোনও ধরনের অবাঞ্ছিত পরিবর্তন, যা মানুষের স্বাস্থ্য ও সম্পদের পক্ষে হানিকর, তাকেই বলে দূষণ। পরিবেশবিদ ও গবেষকদের নানা গবেষণায় জানা যাচ্ছে, দূষণ কেবল বাইরে নয়, হয়ে থাকে গৃহেও। আর একেই বলে গৃহদূষণ।

গৃহের বাতাস-সহ শব্দ ও আলো ইত্যাদি প্রতি মুহূর্তে দূষিত হচ্ছে। সময় ও স্থানভেদে বাতাসে দূষণের মাত্রার হেরফের হয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে গৃহে দূষণ এতটাই ভয়াবহ যে, তা দূষিত শহরের দূষণকেও হার মানায়। আমেরিকার এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি (ইপিএ), প্রস্পেক্টিভ আরবান অ্যান্ড রুরাল এপিডেমিওলজি বা পিওর, ইউরোপিয়ান সোসাইটি অফ কার্ডিয়লজি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য সংস্থা প্রতি মুহূর্তে বাড়ির দূষণ নিয়ে কাজ করে চলেছে।
বাতাসে জলীয় বাষ্প, রান্না ও দহন ক্রিয়ায় উৎপন্ন নানান বিষাক্ত গ্যাস, উদ্বায়ী জৈব যৌগ, ধূলিকণা, নানান কীটনাশক, ছত্রাক, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া এবং গৃহস্থলীর কাজে ব্যবহৃত নানা দ্রব্য ও তেজস্ক্রিয় রেডন গ্যাস হল দূষণের প্রধান কারণ। ইপিএ-এর মতে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ তাদের জীবনের প্রায় ৯০ শতাংশ সময় কাটায় নিজের গৃহে অথবা অন্য কোনও চার দেয়ালে ঘেরা স্থানে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ যত বৃদ্ধি পাবে ততই তারমধ্যে ধূলিকণা, বিভিন্ন ফুলের রেণু, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। ফলে হতে পারে হাঁপানি, টিবি ও নিউমোনিয়ার মতো মারাত্মক ব্যাধি।

রান্নার গ্যাস, কয়লা ও অন্যান্য জ্বালানি ব্যবহারের সময় বাতাসের দ্রুত কমতে থাকে অক্সিজেন ও বাড়তে থাকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং কার্বন-মনোক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস যা অনেক সময় মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। হতে পারে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যাও। রান্নার সময় বিশেষ করে নানান মশলাজাতীয় খাবার ও ভাজাভুজি সময় উৎপন্ন হয় উদ্বায়ী জৈব পদার্থ যাকে সংক্ষেপে বলে ভস। এ থেকে চোখের সমস্যা, ফুসফুসের সমস্যা ও কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ হতে পারে।
আরও পড়ুন:

গৃহস্থের হেঁশেলে সাজানো সাদা বিষ, নিয়মিত খাওয়ার ফলে বিষ জমছে শরীরে

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-১: ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিবমন্দির এক অনন্যসাধারণ কোচ স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ

এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বিশ্বের নানান দেশের মতো ভারতীয়দেরও এই হৃদরোগ ও তার কারণে মৃত্যু উদ্বেগজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক সমীক্ষা বলছে, ২০১২ সালে গৃহে দূষণের ফলে প্রায় ১৩ লখ ভারতীয়ের মৃত্যু হয়েছে। বিভিন্ন কীটনাশকের ধোঁয়া ও বিষাক্ত পদার্থ থেকে হতে পারে শ্বাসকষ্ট, বমিবমি ভাব। এমনকি শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশও বাধা প্রাপ্ত হয়। সন্ধের সময় ভারতে এই দূষণের মাত্রা মারাত্মক বৃদ্ধি পায়। গৃহ যত পুরনো হবে, তার মধ্যে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে এবং তার মধ্যে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে হতে পারে ছূলি ও দাদের মত ছোঁয়াচে রোগ এবং অন্যান্য ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১: পরিযায়ীর বিপর্যয়

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৪: রাজ পরিবারের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক ও ব্রাহ্মবাদ

ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায় এইসব রোগবালাই। বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও গৃহস্থালী কাজে ব্যবহৃত স্বল্পমূল্যের দ্রব্যাদি থেকে হতে পারে ত্বকের রোগ থেকে শুরু করে ক্যানসার পর্যন্ত। কিছু রুম ফ্রেশনারের মধ্যে থাকে ফ্যালেট নামক জটিল যৌগ, যা কিছু হরমোনের কার্যকারিতাকে নষ্ট করে দেয়। নন-স্টিকের বাসনে পাওয়া যায় আর পারফ্লুরো অ্যালকক্সি বা পিএফএ, এই জাতীয় পদার্থ শরীরে দীর্ঘদিন ধরে ঢুকলে হতে পারে বন্ধ্যাত্ব ও বিপাকজাত সমস্যা এবং ক্যানসারের মতো মারাত্মক ব্যাধি।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১: একটু শুরুর কথা হলে ক্ষতি কী…

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩১: বিড়াল ঘাঁটলেই কি ডিপথেরিয়া হতে পারে?

বাড়িতে তারস্বরে গান শোনা, চিৎকার করা ইত্যাদির কারণে হয় শব্দদূষণ। এই উচ্চশব্দে হৃদপিণ্ডের সমস্যা, বুক ধড়ফড় করা ও মানসিক হতাশার জন্ম দেয়। অন্ধকার ঘরে সর্বদা আলো জ্বালা, সারারাত নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে রাখা ও স্ট্রিটলাইট থেকে গৃহে হতে পারে আলোক দূষণ, যার ফল স্বরূপ হতে পারে ডায়াবেটিস, অনিদ্রা ও অন্যান্য রোগ।

গৃহের দূষণ কমানোর জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সচেতনতা। পুরাতন বাড়ির ভিতরে নির্দিষ্ট সময় অন্তর রং করা প্রয়োজন, প্রয়োজন ইনডোর গাছ লাগানো, রান্নাঘরে চিমনি ও ঘরের ঘুলঘুলিতে এক্সজস্ট ফ্যান লাগানো, একটি পাত্রের মধ্যে চুনজল রাখা, ফলে ভবনের মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষিত হবে। সর্বদা জানালা দরজা খুলে রাখা প্রয়োজন। এই খোলামেলা পরিবেশ শরীর ও মন ভালো রাখে। আবার দূষণের হার অনেক কমে যায়।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content