সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


শ্রীমা।

মা সারদার প্রভাব তাঁর গ্রামের মানুষেরাও তাঁকে নিত্য দর্শন করে বুঝতে পারতেন না। তিনি চিরকাল তাদের আপনজন মাসি, পিসি, দিদি হয়েই থেকে গিয়েছেন। নিজের স্বরূপ গোপন রাখার সহজ প্রবৃত্তিই মা সারদাকে সকলের কাছে দুর্জ্ঞেয় করে তুলেছিল। অবতার যখন মানবরূপে এই ধরাধামে আসেন, তখন তাঁরা মানুষের মাঝে প্রকৃত স্বরূপ অন্তরালে রেখে মানুষোচিত আচরণই করে থাকেন। যেমন করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বাল্যলীলার মাধ্যমে। স্বয়ং ঠাকুরও সকলের সামনে তাঁর স্বরূপ প্রকাশ করতে চাইতেন না। সকলের সঙ্গে সাধারণভাবে মিশে যেতে পারতেন, যা তাঁরও বালক বয়সে দেখা যায়।

একদিন জয়রামবাটির কোনও একজন লোক শ্রীমাকে বলেন যে, তাঁকে দেখতে কত লোক কত দূরদেশ থেকে আসছে। আর তারা কাছে থেকেও মা সারদাকে বুঝতে পারছে না কেন? তার উত্তরে শ্রীমা বলেন, ‘তা নাই বা বুঝলে, তোমরা আমার সখা, তোমরা আমার সখী’। এ যেন শ্রীকৃষ্ণের কথারই প্রতিধ্বনি। তাঁর গ্রামের প্রবীণ চৌকিদার অম্বিকাচরণ বাগদি একবার শ্রীমাকে বলেছিল, ‘লোকে তোমাকে ভগবতী, দেবী, কত কি বলে, আমি তো কিছু বুঝতে পারি না’। শুনে শ্রীমা বলেন, ‘তোমার বুঝে দরকার নেই। তুমি আমার অম্বিকে-দাদা আর আমি তোমার সারদা-বোন’।
বিজয়া দশমীর দিন দেখা যেত যে, সন্ধ্যা থেকে সারদা মার শোবার আগে পর্যন্ত গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সার বেধে তাঁকে প্রণাম করতে আসছে। আর শ্রীমাও সকলের প্রণাম গ্রহণ করছেন ও আশীর্বাদ করছেন। এমন কি অন্য গ্রামের প্রতিমা শিল্পী কুঞ্জমিস্ত্রীকেও তিনি কুঞ্জকাকা বলে সম্বোধন করে বহু আদরযত্নে আপ্যায়িত করতেন। নিজের গ্রামের মানুষদের অজ্ঞাতেই তাদের দিয়ে সেবারূপ কর্ম করিয়ে শ্রীমা তাদের পুণ্যসঞ্চয় করাতেন। তাঁর কাছে অনেক সেবক থাকলেও তিনি এক অনিচ্ছুক বালককেই ফুল তুলে আনার জন্য আবদার করতেন, ‘দে বাবা, চারটি ফুল তুলে, লক্ষ্মী ধন আমার’। আর সেই ছেলেও শুনবে না, বলছে, ‘আমি পারব নি’।

ছেলেটি যেমন শুনবে না, শ্রীমাও তাকে ছাড়বে না। শেষে তাকে দিয়েই তিনি পুজোর ফুল তোলালেন। এইরকমই তাঁর নিজের ঘরে মেয়ে, বউরা আছে, তাঁর কাছের স্ত্রীভক্তরা আছে, তবু তাদের না বলে একবার শ্রীমা তাঁর গ্রামের এক বৃদ্ধার কাছে মিনতি করছেন, ‘দে মা, পায়ে একটু হাত বুলিয়ে, পাটা বড় কামরাচ্চে’। সেই বৃদ্ধাও শ্রীমাকে বলছে, ‘আমি পারবনি বাছা, সমস্ত দিন গেল আর এই রেতের বেলা পায়ে হাত বুলিয়ে দাও, আমি পারবনি’।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯১: এক আলমারি বই : রাণুর বিয়েতে কবির উপহার

মা সারদাও সঙ্গে সঙ্গে বলছেন, ‘কি আর করবি বাছা বল, দে মা, একটু হাত বুলিয়ে’। শেষকালে মা সারদা সেই বৃদ্ধাকে দিয়েই হাত বুলিয়ে নিলেন। তিনি হয়ত ঘরের দাওয়ায় আঁচল পেতে শুয়ে আছেন। একজন ভক্ত তা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মা, এ ধুলোমাটিতে শুয়েছেন যে?’ তার উত্তরে শ্রীমা যেন পাঁচবছরের মেয়েটির মতো হাসতে হাসতে বলে ওঠেন, ‘বাবা, একদিন তো মাটিতেই মিশতে হবে!’

মা সারদা জয়রামবাটি থেকে কলকাতায় যাবেন। তাই সকল জিনিসপত্র গাড়িতে তোলা হয়েছে, শুধু ‘ঠাকুরের বাক্স’ তুলতে বাকি আছে। বিভূতিবাবু ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখেন যে, ন্যাড়া, সে তখন সুস্থ ছিল, ঠাকুরের বাক্সের উপর বসে আছে আর শ্রীমা হাততালি দিচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখামাত্র তাঁর মনে হল যে, বাক্সের ভিতরে যিনি, বাইরেও তিনি, তা দেখেই যেন মা সারদা হাততালি দিচ্ছেন। আর একবার, কলকাতা থেকে শ্রীমা জয়রামবাটি ফিরবেন, কিন্তু একের পর এক অসুখের জন্য বাধা আসছে। মা সারদা তখন ঠাকুরকে বলছেন, ‘জয়রামবাটির বড় পুকুরের জল আর তুলসী কি মনে লাগে না তোমার, জয়রামবাটি চল’।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৫: বসু পরিবার-এ উত্তমকুমার দিনভর একটি শব্দই রিহার্সাল করেছিলেন, কোনটি?

জয়রামবাটিতে অনেক সময়ই ফুল পাওয়া যেত না বলে শ্রীমা কেবল তুলসীপাতা ও জল দিয়ে ঠাকুরের পুজো করতেন। সেখানে থাকার সময় শরৎ মহারাজ গণেন্দ্রনাথকে নিয়ে কখনও শিহড়ে, কখনও আমোদর নদের তীরে যেতেন শ্রীমার পুজোর ফুল সংগ্রহ করার জন্য। শিহড়ে কাঞ্চনগাছে ও আমোদরতীরে গুলঞ্চগাছে চড়ে গণেন্দ্রনাথ ফুল পাড়তেন আর শরৎ মহারাজ নীচে থেকে তা কুঁড়োতেন। এমনকি, মা সারদা যখন বেলুড়ে নীলাম্বর বাবুর বাড়িতে থাকতেন, তখন, তাঁর পুজোর ফুল জোগাড় করার জন্য স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ রাত চারটে উঠে শিউলিতলায় চাদর বিছিয়ে রাখতেন।

মা সারদার মেজোভাই কালীকুমার যে জমিতে বাড়ি করেন, আগে সেখানে অনেক ফুলের গাছ ছিল। শ্রীমা তখন নিজহাতে ফুল তুলে ঠাকুরের পুজো করতেন। তাঁর আচরণ দেখে ভক্তদের মনে হত, তিনি যেন ঠাকুরকে প্রত্যক্ষ করে কথা বলছেন। প্রকৃতপক্ষে, ঠাকুরকে তিনি আর পাঁচজনের মতো শুধু ছবিমাত্র দেখতেন না। সাক্ষাৎ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর মিলন ও কথা হত। কলকাতায় তাঁর নিজের বাড়িতে যখন প্রথম শুভাগমন হয়, তখন ঠাকুরঘরের পাশের ঘরেই তাঁর শোবার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। তাই দেখেই শ্রীমা বলেছিলেন, ‘ঠাকুরকে ছেড়ে কি আমি থাকতে পারি? আমাকে ঠাকুরঘরেই দাও’।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

একবার মহাদেবানন্দ মোটা দুগাছি গোড়ে মালা গেঁথে কোয়ালপাড়া থেকে বিদ্যানন্দের হাত দিয়ে পাঠিয়েছেন। শ্রীমা সেই মালা ঠাকুরের ছবিতে পরিয়ে বলেন, ‘মতিকে বোলো, এত ভারী মালা যেন না হয়, ঠাকুরকে ভারী লাগবে’। ঠাকুরকে নিবেদিত অন্নাদি তিনি গ্রহণ করেন কিনা তাও শ্রীমা দেখতে পেতেন। যে নৈবেদ্য ঠাকুর গ্রহণ করলেন না দেখলেন, তা তিনি নিজেও খেতেন না। এমনকি, কতবার সেই অগৃহীত খাদ্য পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, হয়, তাতে চুল, নয়ত, মৃত কীটাদি পাওয়া গিয়েছে। অথবা, সেই খাবারের অগ্রভাগ কেউ গ্রহণ করেছে আগেই। একবার জয়রামবাটিতে পেটের অসুখ হওয়ায় লালবিহারী সেন খিচুড়ি খেতে আপত্তি জানান। তখন শ্রীমা বলেন, ‘একটু খাও, স্বয়ং ঠাকুর খেয়েচেন’। লালবিহারীবাবু জিজ্ঞাসা করেন যে, ঠাকুরকে কি দেখতে পাওয়া যায়?
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৬: কুসুমকুমারী দাশ—লক্ষ্মী সরস্বতীর যুগ্ম মূর্তি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬৯: আবার সত্যব্রত

মা সারদা বললেন, ‘হ্যাঁ, আজকাল মাঝে মাঝে এসে খিচুড়ি আর ছানা খেতে চান’। মনে করা যাক, ঠাকুরের সেই অন্তিম দিনের কথা, সেদিনও তিনি শ্রীমার কাছে খিচুড়ি খেতে চেয়েছিলেন। একবার জগদম্বা আশ্রমে অসিতানন্দ শ্রীমাকে বলেন, ‘ঠাকুরকে তো ভোগ নিবেদন করি, তিনি খান কিনা কিছুই বুঝতে পারিনা’। উত্তরে শ্রীমা বলেন, ‘খান বইকি বাবা, প্রাণের ভিতর থেকে নিবেদন কল্লে নিশ্চয়ই খান, আমি যখন গোপালকে খেতে দিয়ে আদর করে ডাকি তখনই দেখি, গোপাল নূপুর পায়ে ঝুনঝুন করে এসে হাজির হয় আর আবদার করে খায়’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content