সারদা দেবী।
ডাক্তারির পরীক্ষা দিয়ে অভয় চলে যাওয়ার ছ’ মাসের মধ্যে রাধারানি অর্থাৎ শ্রীমায়ের রাধুর জন্ম। মা সারদা ভেবেছিলেন যে, বাচ্চার জন্মের পর হয়ত সুরবালার মাথার ব্যামো ঠিক হয়ে যাবে। পরে বুঝেছেন যে সে আশা নেই। রাধুর আড়াই বছর পেরিয়ে তিন বছর হতে চলল, তবু মা ও মেয়ের মধ্যে তেমন সম্পর্ক হল না। মা সারদাই এখন রাধুর ভরসা। পাড়ার ছেলেরা সুরবালার নামই রেখে দিয়েছে ‘পাগলী মামী’। শ্রীমার ভাই হল তাদের মামা, আর তার স্ত্রী মামী। বিধবা ছোট ভাজের জন্য সারদা মা মনে মনে কষ্ট পান। তার কথা বলা, কাপড়-জামা সবই অগোছালো, কোন কিছুর ঠিক থাকে না। তার মাথার চুল ছেঁটে ন্যাঁড়া করে দেওয়া হয়েছে। মাথা খারাপ হলেও তাকে ছাড়তে পারেন না শ্রীমা। মায়ের যত্নই এখন প্রয়োজন সুরবালার।
একবার তো বদনগঞ্জের এক মেলায় তরজা দেখতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সবাই তার অবস্থা দেখে যখন হাসছিল, শ্রীমাই বুঝেছিলেন যে পেটের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে সুরবালা। তিনি তার মাথায় জল ঢেলে, পরিচ্ছন্ন করে, জামা-কাপড় ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সারা রাত মা সারদা নিজের কোলের কাছে তাকে নিয়ে বসেছিলেন। পাগল মানুষ মুখে বুঝিয়ে বলতে না পারলেও তার চোখের করুণ আর্তি দেখে শ্রীমা ঠিক বুঝে নেন। মনে মনে তিনি ঠাকুরকে ডেকে বলেন, ‘অসহায় মেয়ে, রক্ষে কর, ঠাকুর’। দু’ দিন পর সুরবালা সুস্থ হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৬: শ্রীমায়ের দুই ভ্রাতৃবধূর কথা
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৯: ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ওড়া, কেওড়া, চাক কেওড়া ও কৃপাল
শ্রীমা ভেবেছিলেন, সুরোকে তিরোলের ক্ষ্যাপা কালীর বালা পরাবেন। তিনি জেনেছিলেন যে, অনেকের মাথার ব্যামো নাকি সেরে গিয়েছে। রাধু তার মার ন্যাড়া মাথা বলে তাকে ‘নেড়িমা’ বলে ডাকত আর শ্রীমাকে ‘মা’ বলত। সুরবালা মেয়ের ওপর রাগ করলে রাধু খিলখিল করে হাসত। সারদা মা ভাবেন, পাড়া-প্রতিবেশিদের এ বার বলে দিতে হবে, সুরবালাকে তারা কখনও পাগলী মামী না বলে। ও কি কথা, মানুষের অসুখ বা খুঁত কি তার পরিচয় হয় নাকি! সে এমনিতেই কত দুঃখী, আবার ডেকে কেন তাকে কষ্ট দেওয়া।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৩: মহাভারতে উল্লিখিত মিথ্যাশ্রয়ের প্রাসঙ্গিকতা কী আজও আছে?
এ দিকে রাধুকে সুরবালার হাতে দিয়েও শ্রীমা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন না। শ্রীমা সুরবালাকে একটি গরদের শাড়ি দিয়েছিলেন। মেয়ে রাধুর জন্য কথা কাটাকাটি হওয়ায় সে কাপড়টি নিয়ে শ্রীমার গায়ে ছুঁড়ে দিয়ে বললে, ‘এই লাও, তোমার কাপড়, তোমার ভাল ভাজকে (ইন্দুমতী) দাওগে’। শ্রীমা শান্তভাবে বলেন, ‘তোর চেয়ে আমার কে ভাল ভাজ আছে’? শ্রীমা কখনও কখনও তাঁর রাধুকে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘রাধু, তুই সিঙ্গীর দুধ খেয়ে শিয়ালই রইলি? আমি যে তোকে এত করে মানুষ কল্লুম, আমার ভাব কিছু নিলি নি মা, তোর মায়ের ভাবই সব নিলি’? রাধু চুপ করে থাকত, রাগ করে মাথায় কাপড় দিয়ে মুখ ফিরিয়ে থাকত। আর শ্রীমা তাই দেখে হেসে বলতেন, ‘আমায় না হলে তোর চলবেক নাই, আমাকে দেখে মাথায় কাপড় দিচ্ছ’?
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা
অপ্রকৃতিস্থ হলেও শ্রীমার মহত্ত্ব সম্পর্কে সুরবালা একেবারে অজ্ঞ ছিলেন না। শ্রীমা টাকা-কড়ি অন্যকে দিয়ে দিচ্ছেন দেখলে তিনি অসন্তুষ্ট হতেন, কিন্তু কখনও নিজের জন্য তা চাইতেন না। এমনকি, শ্রীমা দিতে চাইলেও নিতেন না। শ্রীমার যখন নতুন বাড়ি হয়, তখন তিনি আনন্দিত হয়ে বলেছিলেন, ‘ঠাকুরঝি, তুমি চব্বিশ-প্রহর করাও’! এক-এক সময় তাঁর কথাও বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠত। ঠাকুরের ছবিতে ফুল দিয়ে শ্রীমার সাজানো দেখে তিনি খানিক হেসে স্ত্রীভক্তদের বলতেন, ‘দেখ, তোমাদের মার কি কাণ্ড! নিজের স্বামীকে নিজেই সাজাচ্চে’।
রাধারানিকে মা সারদা ছোট থেকে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করেছিলেন। তাই তার উপর তাঁর মাতৃসুলভ টান থাকাই স্বাভাবিক। তিনি যখন কলকাতায় তাঁর নতুন বাড়িতে প্রথম আসেন, তখন রাধু বড় হয়েছে। একই তক্তপোষে তার সঙ্গে শ্রীমার শোয়ার অসুবিধে হবে ভেবে শরৎ মহারাজ গণেন্দ্রনাথকে দিয়ে তাঁর জন্য একটি খাট তৈরি করিয়ে দেন। তক্তপোষ আর খাট একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলে শ্রীমা সেই খাটে দিনকতক শয়ন করলেন। তারপর গণেন্দ্রনাথকে বললেন, ‘বড় অসুবিধে হচ্চে, রাধি কাছে না শুলে আমার ভাল ঘুম হয় না। আমি তো এ খাটে দিনকয়েক শুলুম। এ খাট তোমাকে দিলুম, তুমি শোবে’।
রাধারানিকে মা সারদা ছোট থেকে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করেছিলেন। তাই তার উপর তাঁর মাতৃসুলভ টান থাকাই স্বাভাবিক। তিনি যখন কলকাতায় তাঁর নতুন বাড়িতে প্রথম আসেন, তখন রাধু বড় হয়েছে। একই তক্তপোষে তার সঙ্গে শ্রীমার শোয়ার অসুবিধে হবে ভেবে শরৎ মহারাজ গণেন্দ্রনাথকে দিয়ে তাঁর জন্য একটি খাট তৈরি করিয়ে দেন। তক্তপোষ আর খাট একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলে শ্রীমা সেই খাটে দিনকতক শয়ন করলেন। তারপর গণেন্দ্রনাথকে বললেন, ‘বড় অসুবিধে হচ্চে, রাধি কাছে না শুলে আমার ভাল ঘুম হয় না। আমি তো এ খাটে দিনকয়েক শুলুম। এ খাট তোমাকে দিলুম, তুমি শোবে’।
আরও পড়ুন:
বদলে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর নাটক এবং চলচ্চিত্রের ভাষা
ভোটস্য পরিবেদনা
সন্ধ্যার পরে শ্রীমা বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে আছেন আর তাঁর কাছে রাধু শুয়ে পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শ্রীমা তাকে সুন্দর আবৃত্তি করে শেখাচ্ছেন, “ওরে রসনা রে, পুরা বাসনা রে, রাধাগোবিন্দ গোবিন্দ বলে নেরে। জয় রাধাগোবিন্দ, শ্যামসুন্দর, মদনমোহন, বৃন্দাবনচন্দ্র”। রাধুর জন্য তাজপুর থেকে একটি পাত্রের সন্ধান এসেছে। পাত্রের নাম মন্মথনাথ চট্টোপাধ্যায়। খুব যে অবস্থাপন্ন পরিবার, তা নয়। তবে পালটিঘর, মানুষও ভালো। তাই বর্ষা আরম্ভ হওয়ার আগেই সব আয়োজন সম্পন্ন করে ফেললেন মা সারদা। দান-দক্ষিণা কোনও ব্যাপারেই রাধুর বিয়েতে ত্রুটি রাখলেন না তিনি, তাঁরই যে সব দায়িত্ব। শরৎ মহারাজ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে রাধুর বিয়ের সব ব্যবস্থা করলেন। এ ভাবে রাধুর বিবাহ সুসম্পন্ন হল।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।