বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীমা।

ডাকাত আমজাদের ঘটনার পর আরও অনেক এমন ডাকাত শ্রীমার কাছে আসতে লাগল। আর তা দেখে গ্রামের লোকও ভরসা পেয়ে ওদের কাজ দিতে থাকে। ধীরে ধীরে শিরোমণিপুরের তুঁতেচাষিদের জীবনধারায়ও একটা পরিবর্তন ঘটতে থাকে। লোকে বলাবলি করতে শুরু করল যে, মায়ের ছোঁয়ায় ডাকাতগুলো পর্যন্ত ভালো হয়ে গেল! সন্ন্যাসীরা সেই গ্রামে সেবার কাজ করতে যেতেন। এই ব্যাপারে অবশ্য কুপিত হয়েছিল জয়রামবাটির সমাজপতিরা। সমাজের ‘যুগলালিত’ তাদের অচলায়তন কেঁপে উঠেছিল।

এ যে ছত্রিশ জাত একাকার করলে, এই গ্রামের ব্রাহ্মণ জমিদারের সমাজ-সভার বিচার বসল। বিচারে ঠিক হল যে, এই অনাচারের জন্য সমাজ-সভার সামনে সারদা মাকে ক্ষমা চেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, নাহলে অর্থদণ্ড দিতে হবে। কিন্তু দৃঢ়চেতা মা সারদা মাথা হেঁট করে ক্ষমা তো চাইলেনই না। তিনি জানালেন, হ্যাঁ, তিনি ছত্রিশ জাতেরই মা, তাই তিনি প্রায়শ্চিত্ত করবেন না। এমনই ছিল মমতাময়ী সারদা মায়ের নিজ আদর্শের প্রতি দৃঢ়তা।
শ্রীমার মানসিক দৃঢ়তা তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষিতে কতখানি ছিল, তা এই একটি উদাহরণে তুলে ধরা যায়। লোকমান্য তিলক ও রানাডে মহারাষ্ট্রের এক খ্রিষ্টান মিশনারিদের সভায় গিয়েছিলেন। সেখানে সকলের জন্যই ‘চা’ পরিবেশন করা হয়। আর তাই নিয়ে সমাজে কথা উঠল। সমাজের কাছে ওই বরেণ্য নেতা দুজন হেঁট হয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলেন। একজন গ্রাম্য, দরিদ্র ব্রাহ্মণবিধবা যে দৃঢ়তা ও তেজস্বিতা দেখিয়েছিলেন, তা তাঁরা দু’জন সেদিন দেখাতে পারলেন না। চিৎপুর ব্রিজের নীচে মুসলমান পীর ভূতসাহেবের দরগা ছিল। মা সারদা সেখানকার মাটি নিজের মাথায় ধারণ করে বলেন, “আহা, কতবড় সাধক এই পীর সাহেব”। তাঁর কাছে কোন জাতবিচার নেই। এমনকি ঠাকুরের সামনেও এ বিষয়ে শ্রীমা তাঁর স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৩: শ্রীমার বড় ভাইজিরা—নালু ও মাকু

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৬: সুন্দরবনের লৌকিক চিকিৎসায় ম্যানগ্রোভ—হরগোজা ও কেয়া

খাওয়ারের বিষয়ে ঠাকুরের বাদ-বিচার ছিল। লীলাপ্রসঙ্গে ঠাকুরের ভাগ্নে হৃদয়ের কথা আছে এই বিষয়ে। তিনি বলছেন, ‘মধ্যাহ্নে ঠাকুর সিধে নিয়ে পঞ্চবটীতে নিজহাতে পাক করে খেতেন। রাত্রে কিন্তু তিনি আমাদের মতো মাতা জগদম্বার প্রসাদী লুচি খেতেন। আর লুচি খেতে তাঁর চোখে জল আসত ও তিনি আক্ষেপ করে জগন্মাতাকে বলতেন, “মা, আমাকে কৈবর্তের অন্ন খাওয়ালি”। যখন দক্ষিণেশ্বরে শ্রীমা থাকতেন, তখন রোজ তিনি নিজের হাতে রান্না করে খাবার নিয়ে ঠাকুরের ঘরে যেতেন। একবার এক মহিলা শ্রীমার হাত থেকে খাবারের থালা নিয়ে ঠাকুরের কাছে রাখলেন।

ওই মহিলার স্বভাব ভালো ছিল না, এ কথা ঠাকুর জানতেন। তিনি ওর ছোঁয়া খেতে পারবেন না। শ্রীমা তখন অনুনয় করে বলেন, “আমি জানি, কিন্তু আজ খাও”। ঠাকুর তখন বললেন, “আর কোনওদিন কারও হাতে দেবে না, বল?” মা সারদা স্পষ্ট উত্তর দিলেন, “তা তো আমি পারব না, ঠাকুর। আমায় মা বলে চাইলে আমি তো থাকতে পারব না।” আর তারপরই শ্রীমার সেই প্রশ্ন ঠাকুরকে, “আচ্ছা, তুমি কি কেবল আমারই ঠাকুর, সকলের নও?” এই অকপট প্রশ্ন শুনে নির্বাক ঠাকুর। অন্তরে তিনি শ্রীমার জগদম্বা স্বরূপটি অনুধাবন করলেন। এমনই এক বৃদ্ধা শ্রীমার কাছে আসত। তার অতীত জীবনে কালিমা ছিল।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২১: গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী—এক শক্তির গল্প

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

ঠাকুর একদিন তার আসা নিয়ে শ্রীমার কাছে আপত্তি জানালেন। কিন্তু মা সারদা বললেন, “অতীত- অতীত। এখন ও ধর্মপথে চলতে চায়, আমি ওকে আগের জীবনে ঠেলে দিতে পারব না। ও আমাকে মায়ের মতো মনে করে আসে। আমি ওকে ঠেলতে পারব না।” সেই সময় মা সারদার কতই বা বয়স, তিরিশের মধ্যে হবে। অথচ, তখনই তাঁর মধ্যে যথার্থ মাতৃভাবের স্ফূরণ ঘটেছে যে, মার কাছে সবাই সমান। শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন ঠাকুরও। তিনি আর কোন আপত্তি করেননি। পরে এক শিষ্যের প্রশ্নে শ্রীমা বলেন যে, তিনি ঠাকুরকেও সন্তানভাবে দেখতেন। ব্রহ্মচারী অমরচৈতন্য এবিষয়ে বলেছেন, “এই মাতৃত্বের শক্তিতে তিনি অনেকসময় ঠাকুরের ইচ্ছাকেও উপেক্ষা করেছেন।” ঠাকুরও শ্রীমার কথাকে মায়ের ইচ্ছা মনে করে পালন করতেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৬: যন্ত্রণাদগ্ধ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচিতে পেয়েছিলেন সান্ত্বনার প্রলেপ

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬০: আধুনিক ভারতীয় রাজনীতির চালচিত্রে কি দশরথ ও কৈকেয়ীর ছায়া?

একইভাবে সারদা মা স্বামীজির সিদ্ধান্তকেও নির্দ্বিধায় উপেক্ষা করতে পারতেন। এক ওড়িশি ভৃত্যকে চুরি করার অপরাধে স্বামীজি মঠ থেকে তাড়িয়ে দেন। সারদা মা তখন ১০/২, বোসপাড়া লেনের বাড়িতে থাকতেন। বিতাড়িত ভৃত্যটি কাঁদতে কাঁদতে শ্রীমার কাছে এসে বলে যে, সে গরীব, কাজ না থাকলে তার সংসার ভেসে যাবে। সব শুনে শ্রীমা তাকে স্নান করিয়ে খেতে দিলেন ও বিশ্রাম নিতে বলেন। সেদিনই মা সারদাকে প্রণাম জানাতে স্বামী প্রেমানন্দ আসেন। শ্রীমা তাঁকে বলেন, “দেখ, বাবুরাম, লোকটি গরীব, অভাবের তাড়নায় ওরকম করেছে। তাই বলে নরেন ওকে তাড়িয়ে দিলে? সংসারে বড় জ্বালা। তোমরা সন্ন্যাসী, তোমরা তার কিছু বোঝ না। একে ফিরিয়ে নিয়ে যাও।”

বাবুরাম ভয়ে ভয়ে শ্রীমাকে বললেন, “কিন্তু ওকে ফের নিয়ে গেলে স্বামীজি রুষ্ট হবেন।” শ্রীমার কণ্ঠ এ বার দৃঢ় নির্দেশের মতো শোনাল, “আমি বলছি, নিয়ে যাও”। অগত্যা স্বামী প্রেমানন্দ তাকে মঠে নিয়ে এলেন। ওকে দেখেই স্বামীজি চটে গিয়ে বললেন, “ওকে আবার নিয়ে এসেছ?” কিন্তু মায়ের নির্দেশের কথা শুনে স্বামীজি হেসে ফেলেন ও বলেন, “ব্যাটা হাইকোর্ট চিনেছে!’ স্বামীজির শ্রদ্ধা শ্রীমার প্রতি অপরিসীম ছিল। বলাবাহুল্য, হাইকোর্টের রায়ে ভৃত্যটি আবার কাজে বহাল হল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪২: রাজকোষে সঞ্চিত সোনা-রূপা-ধান্যাদি সবই প্রজাবর্গের, রাজার ব্যক্তিগত নয়

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৮: স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়

পুরুষের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল না হয়ে শ্রীমা চাইতেন যে, মেয়েরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে শিখুক। এই জন্যই জমিদারের কাছে প্রতিবাদ জানাতে তিনি পুরুষভক্তদের না পাঠিয়ে মহিলাভক্তদের পাঠিয়েছিলেন। তবে তিনি জানতেন যে, মেয়েদের আত্মনির্ভরশীলতার জন্য চাই শিক্ষার শক্ত ভিত। তাই তিনি বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া মেয়েদের জন্য এদেশে শিক্ষার প্রসারে উৎসাহী ছিলেন। নিবেদিতা যখন বাগবাজারে মেয়েদের বিদ্যালয় খুলতে চান, তখন তিনি তাঁকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করেন ও উৎসাহ দেন। স্বয়ং উপস্থিত থেকে তিনি এই বিদ্যালয় উদ্বোধন করেন। রাধুকে নিয়ে একবার নিজেই কিছুদিন এই স্কুলের বোর্ডিং-এ থাকেন। কেউ যদি মেয়ের বিয়ে দিতে পারছে না বলে তাঁর কাছে আসত। তিনি স্পষ্ট বলতেন, “বিয়ে দিতে পারছ না তো ভাবনা করে কি হবে? খুকির স্কুলে রেখে দাও, লেখাপড়া শিখবে, বেশ থাকবে।”—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content