শনিবার ৬ জুলাই, ২০২৪


শ্রীমা।

মাতা শ্যামাসুন্দরী দেবী বলতেন যে, তাঁর হল ভক্ত আর ভগবানের সংসার। তাই তিনি সারা বছরভর সব জিনিস, ভালো চাল যা পেতেন, সব গুছিয়ে রাখতেন। তিনি বলতেন, ‘আমার সারদা হয়ত কখন আসবে, যোগীন আসবে, এ সব দরকার। আমি যতক্ষণ আছি, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, জগদম্বা, শিব—সব আছেন। আমিও যাব, এঁরাও সঙ্গে সঙ্গে যাবেন। তোরা কি যত্ন কত্তে পারবি’?
গিরিজানন্দকে শ্রীমা বলেছিলেন যে, তাঁর মা শরৎ মহারাজকে খুব ভালবাসতেন। শরৎ মহারাজ আমেরিকা যাবেন বলে সারদা মায়ের অনুমতি নিতে আসেন। শ্রীমা তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন যে, কোন ভয় নেই, ঠাকুর তাঁদের সর্বদা রক্ষা করছেন। শ্রীমা গিরিজানন্দকে বলেন, “শরৎ চলে গেলে মা আমাকে বলতে লাগলেন,” “হ্যাঁ, মা সারু, তুই মা হয়ে কোন প্রাণে শরৎকে সাত সমুদ্র তের নদী দূরে পাঠালি? তোর প্রাণ কি কঠিন”।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৭: শ্যামাসুন্দরী দেবীর লোকান্তর গমন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৫: ধর্ম, অর্থ, কাম—এই ত্রিবর্গের সাধন, ভীমসেনের আচরণে কী প্রতিফলিত হয়েছে?

কাঁকুড়গাছির যোগোদ্যান মঠের স্বামী যোগবিনোদ ঠাকুরের জন্মস্থানে তাঁর জম্মোৎসব পালন করার ইচ্ছায় বহু ভক্তকে সঙ্গে নিয়ে ১৩১৫ সালের ফাল্গুনের শেষের দিকে কামারপুকুরে যান। সেইসময় জয়রামবাটি থেকে শ্রীমাকেও নিয়ে আসা হয়। ব্রহ্মচারি অক্ষয়চৈতন্য বলেছেন যে, মায়ের উপস্থিতিতে এই অনুষ্ঠানটি সুষ্ঠু এবং আনন্দদায়ক হয়ে উঠেছিল। শ্যামাসুন্দরী দেবীর দেহান্তরের পর থেকেই মা সারদা তাঁর ভাইদের সংসারে যথার্থ অভিভাবিকার দায়িত্ব পালন করেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৩: ত্রিপুরা সমৃদ্ধিতে রাজা বিজয় মাণিক্যের ভূমিকা অপরিসীম

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৫: ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা

বড়ভাই প্রসন্নকুমারের দুই মেয়ে নলিনী ও সুশীলা। রামপ্রিয়া প্রসন্নের স্ত্রী। তখন সারদাজননী জীবিত, যখন শিশুকন্যা নলিনীর জন্ম হয়। সারদা মা পিতৃগৃহে এলে রামপ্রিয়া শিশুকোলে নিয়ে তাঁকে প্রণাম করেন। শ্রীমা রামপ্রিয়াকে জিজ্ঞাসা করেন যে, এই কি প্রসন্নের মেয়ে নলিনী। রামপ্রিয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলে যে, আগেরবার সারদা যখন এখানে আসেন, তখন নলিনী সদ্য জন্মেছে। এখন সেই মেয়ে একটু বড় হয়েছে, কি টকটক করে কথা বলে। প্রসন্ন কলকাতার কাজ থেকে ফিরে এলেই শোনে তার মেয়ে নতুন কিছু কথা শিখেছে। শিশু নলিনীও সবাইকে ঠেলে সারদা মায়ের কোলে এসে বসে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৬: কল্যাণী—অন্দরমহলের সরস্বতী

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

শ্যামাসুন্দরীর মৃত্যুর সময় প্রসন্নের দুই মেয়েই বড় হয়েছে। পরের ভাই কালীকুমারের দুই ছেলে ভূদেব ও রাধারমণ। এরাও এখন বড় হয়েছে। সেজভাই বরদাপ্রসাদের খুদিরাম ও বিজয়কৃষ্ণ নামে দুই ছেলে তখন নিতান্তই শিশু। এরা সকলেই মা সারদার স্নেহচ্ছায়া পেয়েছে। মেজভাই উমেশের অকালমৃত্যু সারদার মাতা ঠাকুরণ শ্যামাসুন্দরী দেবীকে গভীর কষ্টে বিদীর্ণ করেছে, যা মা সারদা ছাড়া আর কেউই তেমনভাবে বুঝতে পারেনি। তখন থেকে উমেশের পরের ভাই কালীকুমারকেই মেজভাই বলা হত। যখন ঠাকুরের তিরোভাবের কিছু পরে গিরীশ জয়রামবাটিতে গিয়ে থেকেছিলেন, তখনও উমেশ জীবিত।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭১: ইংরেজের চোখে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘দাগী আসামী’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪০: স্বভাবে অনন্য সুন্দরবনের বাঘ

শ্রীমার সব ভাইদের সঙ্গে এবং পাড়ার লোকজনের সঙ্গেও গিরীশের সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মা সারদাও তাঁর ভাইদের কাছে ও অন্যদের কাছে গিরীশের বিষয়ে পরিচিতি করিয়েছিলেন। শ্যামাসুন্দরীর চোখ বন্ধ করার আগেই নলিনী, প্রসন্নের বড়মেয়ে নানাকারণে, বিশেষ করে তার শুচিবাইয়ের জন্য শ্বশুরগৃহে বাস করতে পারেননি। পিতার গৃহেও সে বেশিদিন থাকতে পারেনি। কারণ, তার মা রামপ্রিয়া স্বর্গতা হলে তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। সৎমাকে নলিনী ভালভাবে নিতে পারেননি। যদিও এখানে তার সৎমার কোন ত্রুটি ছিল না।

শেষে নলিনী শ্রীমার কাছেই থাকেন। প্রসন্নের ছোট মেয়ে সুশীলা, যার ডাকনাম ‘মাকু’, তার অবস্থাও প্রায় নলিনীর মতন। তাকেও অনেক সময় শ্রীমা নিজের কাছেই রাখতেন। তাই মা সারদা যখন দেশ থেকে কোন তীর্থে যেতেন, তখন তাঁর বড় পরিবার, যারা তাঁর সঙ্গে থাকত, তাদেরও নিতে হত।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content