রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।

ঠাকুরের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে থাকার সময় অনেক অসহায় ও বিপথগামী নারী শ্রীমায়ের কাছে তাদের জীবনের দুঃখ ও ব্যথার কথা বলেছেন। এ বিষয়ে কেনেথ ওয়াকারের মন্তব্য স্মরণীয়। তিনি বলেছেন, সারদা মা তাঁর ভক্তদের কাছে কখনও বেদান্তের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেননি। কিন্তু তাঁর উপদেশের মধ্যে বেদান্তের তত্ত্বই ক্রিয়াশীল ছিল। ঠাকুর বুঝতে পারছিলেন যে, ভবিষ্যতে সারদা মার ওপরেই তাঁর অবশিষ্ট কাজের ভার দিতে হবে। তাই তিনি শ্রীমাকে নানাভাবে তৈরি করে নিয়েছেন। সারদাও জীবনে হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের পথের নির্দেশ দিয়ে, মমতা দিয়ে তাদের মনোবল বাড়িয়ে তুলেছেন। এক রূপসী বিবাহিতা মহিলার নিজের সৌন্দর্যের প্রতি খুব অহংকার ছিল। সে জেনেছিল যে বিবাহিত হয়েও ঠাকুর এবং শ্রীমা একত্র বাস করেন না। মহিলাটির স্বামী দেখতে সুন্দর ছিল না। তার রং কালো, মোটা ও খাটো ছিল। যদিও সে ধনী ও সদাচারি ছিল।
মহিলাটি মা সারদার কাছে এসে বলে যে, সেও যদি তার স্বামীর থেকে দূরে থাকে ও তার স্বামী যদি তাকে ত্যাগ করে, তবে কোন অন্যায় হবে কিনা। একথা শুনে সারদা মেয়েটির রূপসচেতনতায় অবাক হন। তিনি জিভ কেটে বলেন যে, কুরূপ বলে যদি স্বামীকেই ত্যাগ করা হয়, তাহলে নারীর আর রইল কী? আরও বলেন, কদিন থাকে এই রূপ, তার বড়াই করতে নেই। মেয়েটি মর্মাহত হয়ে ফিরে যায় স্বামীর কাছে নয়, তার বাপের বাড়িতে। হঠাৎ বসন্তরোগে ভুগে তার রূপের গর্ব নাশ হয়। কিন্তু তার স্বামী তাকে বাড়িতে নিয়ে এসে উদারতার পরিচয় দিলে মেয়েটি সারদা মার কথার মর্ম বুঝতে পেরে মনে মনে অনুতপ্ত হয়। সে আবার দক্ষিণেশ্বরে আসে শ্রীমায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে। শ্রীমা তাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে বলেন, ‘পতি সেবায় সুখি হও মা’।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২২: ঠাকুর ও মা সারদার সংসার

তাঁর পঁয়তাল্লিশ বছরের নিরলস পরিশ্রম ও গভীর অধ্যবসায়ে উপকৃত হয়েছিল সমগ্র মানবসভ্যতা/১

সততা, সেবাপরায়ণতা, ত্যাগ, ক্ষমা ও স্নেহে মহীয়সী নারীস্বরূপা ছিলেন তিনি। তাই নর-নারী উভয়কেই ধর্মনিষ্ঠ হতে তিনি প্রেরণা দিয়েছেন। ভাগ্যের হাতে তাড়িত এক নারী সরযূ যে জীবনের লড়াইয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। ঐশ্বর্য, স্বামী, সংসার, এমনকি শিশুপুত্রকেও সে ভুলে যায়। ঘর ছেড়ে তার হুঁশ ফিরে আসে। জীবনযুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়েও সে হারিয়ে যায়নি। অনুতপ্ত হুয়ে ঈশ্বরকে ডাকে। হঠাৎ সে যেন দৈববাণীর মতো শুনতে পায়, ‘যা না, দক্ষিণেশ্বরে যে দেবী থাকেন, তাঁর কাছে গিয়ে কেঁদে পড়। তাঁর যদি করুণা হয়, তরে যাবি’। সে ছুটে আসে শ্রীমায়ের কাছে আর বলে, পাষাণী দেবীর প্রাণ তো টলানো যায় না। তাই মানবী রূপে সারদাই সেই দেবী-প্রতিমা।

তিনি করুণা করলে সে তরে যাবে। সে তার দুঃখের কথা বলে সারদা মার কাছে জানতে চায়, তার খোকাকে কি করে ফিরে পাবে। তার কথা শুনে সারদার চোখে জল এসে যায়। তিনি সরযূকে বলেন, ‘উদ্ধারের পথ আছে মা, ওই ঘরে যিনি আছেন, তাঁকে একবার দূর থেকে প্রণাম করে এস’। সে ব্যাকুল হয়ে জানতে চায় শ্রীমায়ের কাছে, তার খোকাকে পাবে কিনা, ওই ঘরে কে আছেন! শ্রীমা তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, পাবে মা’। এরপর তিনি সরযূকে বাৎসল্যরসের মন্ত্র দেন। তাঁর আশীর্বাদেই সরযূ ফিরে পায় নিজের স্বামী-পুত্রকে।
আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসি, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে, পর্ব-৩: অবশেষে অভাবনীয় প্রাপ্তি ও স্বপ্নপূরণ

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৭: তেজস্ক্রিয় স্যান্ডউইচ

কথায় বলে ‘যার মা নেই, তার রা নেই’। দক্ষিণেশ্বরের ঝাড়ুদার রসিকলাল একথাটি ভালোভাবে বুঝেছিল। তার নীচুজাতের যন্ত্রণা তো ছিলই, তবুও সে সকলের মতন একবার তার ঠাকুরবাবাকে কাছ থেকে দেখতে চেয়েছিল। যদি ঠাকুরের কৃপা সে পায়, এই অভিলাষ ছিল মনে। কতজন তাঁর কৃপা পেয়ে ধন্য হয়েছে। কিন্তু নিজের মনের কথা সে কাকে জানাবে। তখনই তার মনে হয়, একবার যদি সে নহবতের মা-ঠাকুরণের দেখা পায়, তাহলে তার কপাল খুলে যেতে পারে। শ্রীমার মনে যে বড় দয়া। এরপর সে রোজ নহবতের সামনে দিয়ে যাওয়া-আসা শুরু করল। কিন্তু সারদা মা লোকের চোখের আড়ালে থাকতেন, তাই সে দেখা পেত না। সারদা মাও দেখলেন যে ঘরের সামনে দিয়ে রোজ একটি লোক যাতায়াত করছে। তাই তিনি একদিন দরজার বাইরে বেরিয়ে এসে দেখেন যে, কালীমন্দিরের জমাদার রসিক একদৃষ্টে নহবতের দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রীমাকে দেখেই সে প্রণাম করে বলে, ‘মাগো, সকল দুনিয়ার মানুষ বাবার কাছে আসে, তাঁর দয়ায় ঈশ্বর দর্শন করে। আর আমি জন্মের জন্য দায়ী নই মা, আমি বাবার এতটুকু কৃপা পাব না’? সারদার মায়ের মন ব্যাকুল হয়ে উঠল একথা শুনে। তাই তো বেচারা। দলিত সন্তানের ব্যথা মায়ের বুকেই বাজে। তিনি তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, বাবা, আমি বলব’।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৪: সে যেন অন্য এক ‘পূনর্মিলন’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৫: সুন্দরবনে বসন্ত রোগের দেবতা বসন্ত রায়

শ্রীমা রসিকের কথা ঠাকুরকে বলেন, শুনে ঠাকুর হুঁ বলে সম্মতি দেন। তারপর একদিন ভাবের ঘোরে ঠাকুর যখন পঞ্চবটির দিকে যাচ্ছিলেন, রসিক সেখানে ঝাঁট দিচ্ছিল। ঠাকুর তাকে দেখে তার দিকে এগিয়ে যান। সে ভয়ে তত পিছিয়ে যায়। ঠাকুর তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন যে সে নাকি ভগবান দেখতে চায়। একথা বলেই তিনি সমাধিস্থ হয়ে যান। তাঁর সেই দিব্য ভাবের স্পর্শে রসিক তখন আনন্দে পুলকিত। তার হাত থেকে ঝাঁটা-বালতি পড়ে যায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সেও। তারপর জ্ঞান ফিরতেই সে ছুটে যায় নহবতে, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মমতাময়ী জননী সারদার শ্রীচরণে অসংখ্য প্রণতি জানায়।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content